
সিরিয়ায় বাশার আল–আসাদের পতনের পর মধ্যপ্রাচ্যে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার নতুন ক্ষেত্র উন্মোচিত হয়েছে।
সিরিয়ায় এখন ইরান ও রাশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী ভূমিকার পরিবর্তে ইসরায়েল ও তুরস্ক তাদের সংঘাতময় জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা স্বার্থকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাবে।
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের নেতৃত্বে ইসরায়েল ও তুরস্কের সম্পর্ক সাম্প্রতিককালে বেশ অবনতি হয়েছে। সিরিয়ায় তাঁরা একটি তিক্ত প্রতিযোগিতায় নেমে পড়বেন।
আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সুন্নি বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহির আল–শামের আক্রমণ অভিযানে তুরস্ক পৃষ্ঠপোষকতা করেছে বলে ব্যাপকভাবে খবর বেরিয়েছে। এটা সিরিয়ার প্রথাগত মিত্র ইরান ও রাশিয়ার পিঠে পেছন থেকে ছুরি মারার মতো ঘটনা।
তেহরানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তুরস্কের সমর্থন ছাড়া এইচটিএসের পক্ষে এমন বিজয় সম্ভব ছিল না।
এখন, সুন্নি মুসলিম বিশ্বে এরদোয়ান নিজেকে ডি ফ্যাক্টো নেতা হিসেবে দেখতে চাইবেন। তিনি তুরস্ককে আঞ্চলিক আধিপত্যশীল শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইবেন।
এরদোয়ান বলেছেন যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর অটোমান সাম্রাজ্য যদি ভিন্নভাবে বিভক্ত হতো, তাহলে আলেপ্পো, দামেস্কসহ সিরিয়ার শহরগুলো আধুনিক তুরস্কের অংশ হতো।
আসাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে দামেস্কে দূতাবাস খুলেছে তুরস্ক। এইচটিএস যাতে ইসলামি ব্যবস্থায় সিরিয়াকে সাজাতে পারে, সেই সহযোগিতার প্রস্তাব চেয়েছে।
এর অংশ হিসেবে এরদোয়ান সিরিয়ার উত্তর–পূর্বাংশের যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দি সংখ্যালঘুদের এইচটিএস যেন কোনো ছাড় না দেয়, সে কথা বলেছেন। এরদোয়ান তাদেরকে তুরস্কের কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থক বলে মনে করেন।
অন্যদিকে সিরিয়ার রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগে ইসরায়েল সেখানে তার সীমানাগত ও নিরাপত্তা উচ্চকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন এগিয়ে নিয়ে চলেছে। কৌশলগত গোলান মালভূমিতে ইসরায়েল স্থল আগ্রাসন চালিয়েছে। সিরিয়ার সামরিক স্থাপনাগুলোতে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে চলেছে।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সিরিয়ার গোলাবারুদের ভান্ডার, যুদ্ধবিমান, মিসাইল, রাসায়নিক অস্ত্রাগারে তারা বোমা হামলা করছে তার কারণ হলো, এসব অস্ত্র যেন চরমপন্থীদের হাতে না যায় এবং তা যেন তাদের ইহুদি রাষ্ট্রের প্রতি হুমকি তৈরি না করতে পারে।
সিরিয়া ও দখলকৃত গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলের এসব কর্মকাণ্ডকে তুরস্ক ভূমি দখল হিসেবে দেখছে।
ইসরায়েলের এসব কর্মকাণ্ডের নিন্দা করেছে আরব দেশগুলোও। দেশগুলো বলছে, এটা সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় অখণ্ডতা লঙ্ঘন।
৪৫ বছর ধরে ইরান তার জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার একেবারে গোড়ার অংশ হিসেবে এই নেটওয়ার্কটি তৈরিতে কঠোর পরিশ্রম করেছে। ২০১১ সালে অভ্যুত্থানের পর থেকে আসাদ সরকারকে রক্ষার জন্য ইরান সিরিয়ায় ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে।
ইসরায়েল স্পষ্টত সিরিয়ায় ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর ক্ষমতার উত্থানে উদ্বিগ্ন। এইচটিএসের নেতা আহমদ আল–শারা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতে জড়াবেন না। তিনি এই প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন যে সিরিয়ার ভূখণ্ড ব্যবহার করে কোনো গোষ্ঠীকে ইসরায়েলে হামলা করতে দেবেন না।
একই সঙ্গে আল–শারা ১৯৭৩ সালের ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধের পর ১৯৭৪ সালের চুক্তি অনুযায়ী ইসরায়েলকে সিরিয়ার ভূখণ্ড থেকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
এরদোয়ান তুরস্কের মধ্যপন্থী ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই ফিলিস্তিন ইস্যুর সমর্থক ও ইসরায়েলের কঠোর সমালোচক। গাজা যুদ্ধ শুরুর পর দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে।
গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা বন্ধে এরদোয়ান আরব–ইসলামিক ফ্রন্ট গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। লেবাননে ইসরায়েলি আগ্রাসনের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন।
অন্যদিকে নেতানিয়াহু বছরের পর বছর ধরে এরদোয়ানকে কটাক্ষ করে চলেছেন। তিনি এরদোয়ানকে ভাঁড় ও স্বৈরশাসক বলেছেন, যাঁর জেলখানা সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বন্দীতে ভরে গেছে। কুর্দি জনগণের বিরুদ্ধে এরদোয়ান একটা গণহত্যা সংঘটিত করছেন, এমন অভিযোগও তিনি করেছেন।
তুরস্ক ও ইসরায়েল—দুই পক্ষের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক কূটনৈতিক চেষ্টা চালাচ্ছে যাতে এইচটিএস সিরিয়াকে ঠিক পথে রাখতে পারে। আসাদ–পরবর্তী সিরিয়া যেন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ দেখে, সেটা চায় ওয়াশিংটন।
এই স্বার্থের মধ্যে রয়েছে, সিরিয়ার উত্তর–পূর্বাঞ্চলের কুর্দি জোটকে সমর্থন এবং দেশটিতে এক হাজার মার্কিন সেনার উপস্থিতি অব্যাহত রাখা। যুক্তরাষ্ট্র চায় ইসলামিক স্টেট যাতে কোনোভাবে মাথাচাড়া দিতে না পারে, এইচটিএস সেই উদ্যোগ যেন নেয়।
তুরস্ক ও ইসরায়েলের মধ্যে উত্থিত ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে যুক্তরাষ্ট্রের মানিয়ে চলতে হবে।
ইসরায়েল যদি সিরিয়া অংশের গোলান মালভূমিকে সেই দেশটির সঙ্গে স্থায়ীভাবে যুক্ত করে নিতে চায়, তাহলে সিরিয়ায় ইসরায়েল ও তুরস্কের সামরিক উত্তেজনা তৈরি হতে পারে।
এর অর্থ এই নয় যে তুরস্ক ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ আসন্ন। কিন্তু দুই পক্ষের সংঘাতময় স্বার্থ এবং পারস্পরিক শত্রুতা নতুন স্তরে পৌঁছাবে।
ইরানের জন্য, আসাদের পতনের অর্থ হচ্ছে, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শিয়া ‘প্রতিরোধের অক্ষের’ গুরুত্বপূর্ণ এক মিত্র হারানো।
৪৫ বছর ধরে ইরান তার জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার একেবারে গোড়ার অংশ হিসেবে এই নেটওয়ার্কটি তৈরিতে কঠোর পরিশ্রম করেছে। ২০১১ সালে অভ্যুত্থানের পর থেকে আসাদ সরকারকে রক্ষার জন্য ইরান সিরিয়ায় ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে।
আসাদের পতন হওয়ায় ইরান লেবাননে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিজবুল্লাহর সঙ্গে স্থল ও আকাশপথে যোগাযোগের সেতুবন্ধটি হারাচ্ছে।
সবকিছু কীভাবে ঘটবে, সেটা সময়ই বলে দেবে। এই পর্যায়ে সিরিয়া ও অঞ্চলটির ভারসাম্য ঝুলে রয়েছে। চরমভাবে বিভক্ত সিরিয়ায় এইচটিএস কীভাবে একটি অন্তর্ভুক্তমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু করতে পারবে, তার ওপর অনেকখানি নির্ভর করবে।
আমিন সাইকাল, অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়া স্টাডিজের ইমেরিটাস অধ্যাপক।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত