দেশে একটি গোষ্ঠী ক্রমে নিজেদের জনগণের অভিভাবক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। যেভাবে তালেবান আফগানিস্তানে মানুষের জীবনধারা নির্ধারণ করে দেয়, ঠিক সেভাবেই তারা ঠিক করে দিতে চায় আমরা কম পড়ব, কম ভাবব, কোন সংস্কৃতি গ্রহণযোগ্য হবে। এই প্রবণতা শুধু উদ্বেগজনক নয়, এটি সরাসরি স্বাধীনতা ও বহুত্ববাদের বিরুদ্ধে।
প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার-এর ওপর সন্ত্রাসী হামলাকারীদের পরিচয় নতুন করে চেনার কিছু নেই। বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বিজয়ধ্বনি তুলে ধরাই যে গণমাধ্যমগুলোর প্রতি তাদের ক্ষোভের প্রধান কারণ, সেটিও স্পষ্ট। তাদের প্রশ্ন হলো, এত পত্রিকা থাকতে মানুষ কেন প্রথম আলো-ডেইলি স্টার পড়বে।
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুতে আয়োজিত এক সভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহসভাপতি ও শিবির নেতা মোস্তাকুর রহমান প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিবির নেতা বলেন, বাম, শাহবাগি, ছায়ানট ও উদীচীকে তছনছ করলেই বাংলাদেশের প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জিত হবে। তাঁরা আরও বলেন, রাজনৈতিক লড়াই করে প্রকৃত স্বাধীনতা সম্ভব নয়। এটাই তাঁদের রাজনীতির মূল যুক্তি। গণতন্ত্রে জয় সম্ভব নয় বলে তাঁরা মনে করেন। তাই প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করেই জয় ছিনিয়ে নিতে হবে।
এই হামলা হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়। ঘোষণা দিয়েই হামলাকারীরা এসেছে। এ সময় সাংবাদিকেরা সরকারের সর্বস্তরে যোগাযোগ করেছেন। ফলাফল শূন্য। সরকার থেকে কেউ এগিয়ে আসেনি। সাংবাদিক ও সম্পাদক নূরুল কবীর যখন সংবাদপত্র রক্ষায় ঘটনাস্থলে হাজির হন, তখন হামলাকারীরা তাঁকেও অপমান করেছে। কিন্তু দেশের সর্বস্তরের মানুষ তাঁর এই সাহসিকতাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, হামলার সময় সরকারের নীরবতা ছিল বিস্ময়কর। প্রশ্ন হলো, কেউ কি সত্যিই বিস্মিত। যে সরকার দীর্ঘদিন ধরে মব প্রশ্রয় দিয়ে বৈধতা দিয়েছে, সেই সরকারের লোকজনও সেদিন ভয়ে পলাতক ছিল। রোম যখন পুড়ছিল, তখন রোমের শাসক কী করছিলেন, এই প্রশ্ন ইতিহাসেও নতুন নয়।
যেকোনো দেশে নির্বাচনের দুই মাস আগে একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয়। আমাদের দেশে উল্টো বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। এই সুযোগে উগ্রবাদী শক্তি আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে ভুয়া অভিভাবকত্ব কায়েম করতে চাইছে। এই বাস্তবতায় নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠের নীরবতা ভাঙার সময় হয়তো খুব দূরে নয়।
অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাও হতাশাজনক। বিএনপি সবকিছুতেই নির্বাচন বানচালের আলামত খুঁজে পায়। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি যে এই হামলা তার চেয়েও ভয়াবহ। এটি ছিল আমাদের পরিচয় ও স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা। বিএনপির কোনো বড় নেতা সেদিন এগিয়ে আসেননি এই দুটি সংবাদপত্র রক্ষায়। সবাই বিবৃতি দিয়েছেন, এমনকি জামায়াতে ইসলামীও। কেউ কেউ পরদিন এসে ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছেন। আজও হামলাকারীদের কাউকে আইনের আওতায় আনা হয়নি।
যারা নিজেদের বিজয়ী মনে করছে, তারা একটি বিষয় ভুলে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ তাদের পেছন থেকে সরে গেছে। দেশের নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই উগ্রতাকে সমর্থন করে না। যারা নিজেদের জনগণের অভিভাবক ভাবছে, তারা যদি নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করে, দেখবে জনগণের সমর্থন আসলে কতটুকু। দেশের অধিকাংশ তরুণ এই উন্মাদ চক্র থেকে দূরে আছে। কেউ বিদেশে যেতে চায়, কেউ বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে চায়, কেউ উদ্যোক্তা হতে চায়। তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণ সমাজ। আর যে সংখ্যালঘু উগ্র অংশ নিজেদের অভিভাবকত্ব দাবি করছে, তারা বাস্তবে সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে না।
যাঁরা প্রথম আলো-ডেইলি স্টার পড়েন এবং যাঁরা তাঁদের সন্তানদের ছায়ানট, উদীচী বা সাংস্কৃতিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠান, তাঁরাই এ দেশের নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাঁরা বহুত্ববাদ, সংস্কৃতি ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। তাঁরা সাধারণত চুপচাপ নিজের কাজে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু তাঁদের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যাবে, তখন ভুয়া অভিভাবকেরা পালানোর পথ খুঁজে পাবে না।
আগে সরকার পরিবর্তনের পর দেশ অন্তত কিছুদিন শান্ত থাকত। এবার পরিবর্তনের পর অস্থিরতা আরও বেড়েছে। এ দেশে বহু আন্দোলনে ছাত্ররা নেতৃত্ব দিয়েছে, জয় এনে দিয়েছে এবং সেই জয় জনগণের হাতে তুলে দিয়ে আবার তারা পড়াশোনায় ফিরে গেছে। কিন্তু এবার যারা আন্দোলনের মাধ্যমে জয় দাবি করছে, তারা প্রতিনিয়ত সেই জয়ের নতুন নতুন সীমারেখা টানছে। গণতান্ত্রিক পথে প্রভাব বিস্তার সহজ নয় বুঝে তারা অরাজকতা ও হুংকারের রাজনীতি বেছে নিচ্ছে।
যেকোনো দেশে নির্বাচনের দুই মাস আগে একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয়। আমাদের দেশে উল্টো বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। এই সুযোগে উগ্রবাদী শক্তি আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে ভুয়া অভিভাবকত্ব কায়েম করতে চাইছে। এই বাস্তবতায় নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠের নীরবতা ভাঙার সময় হয়তো খুব দূরে নয়।
সালেহ উদ্দিন আহমদ, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
*মতামত লেখকের নিজস্ব