মতামত

বিএনপি যখন সবচেয়ে বেশি অপতথ্যের শিকার

দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি অপপ্রচার ও কুৎসার শিকার হয়েছে বিএনপি। এমন কোনো অপপ্রচার নেই, যা বিএনপিকে নিয়ে করা হয়নি। এখনো বিএনপি প্রতিনিয়ত অপপ্রচার ও অপতথ্যের শিকার হচ্ছে।

প্রতিষ্ঠার পরপরই প্রতিপক্ষের বিষাক্ত সমালোচনা ধেয়ে আসতে শুরু করে। শুরুর দিকে বলা হতো বিএনপি সামরিক ছাউনিতে তৈরি হওয়া একটি দল। গণতান্ত্রিক নয়।

এখন বলা হচ্ছে বিএনপি চাঁদাবাজদের দল। অথচ দেশের সবচেয়ে বেশি গণতান্ত্রিক দল বিএনপি। তিনবার দেশ শাসনের সময় কমবেশি গণতান্ত্রিক আচরণ করেছে। কখনোই স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদের হাত মেলায়নি। গণবান্ধব, গণমুখী কর্মসূচি সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বিএনপির কার্যক্রমেই।

সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নয়নের ভিত গড়ে দেওয়া, শিল্প ও কৃষির উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, শিল্পসংস্কৃতির উন্নয়ন, ক্রীড়াক্ষেত্রে অবদান—কোথায় নেই বিএনপির পরিকল্পনা ও কর্মসূচির ছোঁয়া?

তাই ষড়যন্ত্র, মিথ্যা অপপ্রচার, দমন, নিপীড়নের মধ্যেও নিজ অবস্থানে স্বমহিমায় অটল ছিল বিএনপি। আজ বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে রাজনীতির ময়দানে প্রতিষ্ঠা লাভ করে বিএনপি। ক্রমেই তিনি দলটিকে গণমানুষের দলে পরিণত করেন। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিরও সীমাবদ্ধতা আছে।

নানা বিষয়েই সমালোচনা করা যায়। ভুলভ্রান্তির জন্য অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে বিএনপিকে। কিন্তু অকৃতকর্মের জন্য সবচেয়ে বেশি আক্রমণের শিকার হয়েছে বিএনপি।

প্রতিষ্ঠার ৪৭ বছরে দলটি তিন দফায় ক্ষমতায় ছিল। কখনোই এই দলের দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতি প্রমাণ করা যায়নি। আর সব সময়ই গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান ছিল দলটির। নানা ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচারের মুখেই বিএনপিকে রাজনীতি করতে হয়েছে।

বিএনপিকে নিয়ে গল্পকাহিনি প্রচার করেও জনবিচ্ছিন্ন করা যায়নি। বরং শক্ত জনসমর্থনের কারণেই দলটি কঠোর দমন–পীড়নের মুখেও হারিয়ে যায়নি। বিপর্যয়ের মুখে পড়েও বারবার বিএনপি প্রবল শক্তি নিয়ে ফিরে এসেছে। বারবারই প্রমাণিত হয়েছে বিএনপি জনসাধারণের দল।

একসময় বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেতৃত্ব দিত আওয়ামী লীগ। তাদের পক্ষ থেকে বলা হতো, বিএনপি পাকিস্তানপন্থী দল। ইসলামপন্থী দল। ডানপন্থী দল। এখন বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেতৃত্বে আছে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি। তারা বলছে, বিএনপি ভারতপন্থী দল। হাট, মাঠ, ঘাট—সব দখলে নিচ্ছে বিএনপি।

বিএনপি কোনো জনবিচ্ছিন্ন দল নয়। এই দেশেরই রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। দল হিসেবে বিএনপি পাকিস্তান ও ভারত—উভয় দেশের সঙ্গেই দেশের স্বার্থে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেছে। তাই নিজেদের সুবিধামতো বিএনপিকে পাকিস্তানপন্থী বা ভারতপন্থী বলে অপপ্রচার করা হয় রাজনৈতিক শঠতার জায়গা থেকে। আওয়ামী লীগ ভারতপন্থী দল হিসেবে প্রমাণিত।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ তাঁদের সব নেতা–কর্মী পালিয়ে ভারতে অবস্থান নিয়েছেন। আর জামায়াতে ইসলামী তো ঘোষণা দিয়েই ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। দখলের যে রাজনীতি তা শুধু বিএনপিই করে না; সব দল মিলেই করে।
৫ আগস্টের আগে ও পরে চিত্র একই। বিএনপি যেমন এসবের দায় এড়াতে পারবে না। তেমনি অন্যরাও বিএনপির কাঁধে দোষ চাপিয়ে পার পাবে না। যেমন আওয়ামী লীগ পারেনি।

সবকিছু বিবেচনা করলে দেখা যাবে, বিএনপি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি জনবান্ধব দল। ১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশালের পতনের পর বিএনপির হাত ধরে দেশ একটি শক্ত অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে যায়। স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ হিসেবে বিএনপি দাঁড় করিয়েছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে।

বিএনপির হাত ধরেই বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে ধীরে ধীরে শিল্পের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। গত সত্তর বা আশির দশকে রাজনীতি ও অর্থনীতিতে একধরনের অস্থিরতা ছিল। একদিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের অবস্থান।

অপর দিকে সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে ওয়ারশ জোট। মার্কিন ও সোভিয়েত স্নায়ুযুদ্ধের ওই সময় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা অনেকটাই তাদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হতো। হয় বিশ্বব্যাংক আইএমএফের নীতি মেনে চরম পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া; না হয় সোভিয়েত বা পূর্ব ইউরোপের আদলে কেন্দ্রীভূত অর্থনীতির কাঠামো মেনে চলা। সঙ্গে একদলীয় কঠোর শাসন।

সদ্য উপনিবেশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়া অনেক দেশই জাতীয়তাবাদী ধারণা থেকে ওই সময় সোভিয়েতঘেঁষা কেন্দ্রীভূত অর্থনৈতিক কাঠামো ও রাজনৈতিক পদ্ধতির দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। বিশেষ করে আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকান স্বাধীন দেশগুলো প্রবলভাবে এ নীতি ধারণ করেছে। কিন্তু এই নীতি সদ্য স্বাধীন দেশগুলোতে স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বপ্ন সফল করতে পারেনি। বাকশাল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

বিপরীতে সবকিছু উদার করে দিয়ে চরম পুঁজিবাদী কাঠামোও অনুসরণ করা সহজ ছিল না। জনসংখ্যার আকার, শিক্ষার হার, অর্থনৈতিক কাঠামো, জনশক্তির দক্ষতা বিদেশি ঋণ, বিদেশি বিনিয়োগ ও খোলামেলা অর্থনীতির জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল না ওই দেশগুলো।

এ অবস্থায় মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে বিএনপি অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটি মিশ্র নীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে উদার বহুদলীয় রাজনীতির প্রবর্তন করে। বিএনপির মূল লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্র পরিচালনায় জনসাধারণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা।

সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকলেও জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ছিল বিএনপির প্রথম দিকের কর্মসূচি। গ্রাম সরকার, খাল খনন, কৃষিকাজে সেচ, তরুণদের নিয়ে হাটবাজার ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করে স্থানীয় পর্যায়ে সাধারণ মানুষকে বিএনপি রাষ্ট্রের কাজে সম্পৃক্ত করেছিল।

বিএনপির রাজনৈতিক দর্শন ছিল গণমানুষের দলে পরিণত হওয়া। এ ক্ষেত্রে বিএনপি পুরোপুরি সফল হয়েছে। এর মূল কারণ, বিএনপির গণমুখী রাজনীতি। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় থেকে শুরু করে খালেদা জিয়ার শাসনামলে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও দলীয় কর্মসূচি বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে।

জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা দিয়ে বিএনপি পথচলা শুরু করে বিএনপি। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে ৩১ দফা ঘোষণা করেছে।

বিএনপির সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে নিজেকে সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া এবং একই সঙ্গে সময়োপযোগী কৌশল নির্ধারণ করা। ১৯ দফা ছিল আত্মনির্ভরশীল একটি জাতি গঠনের সনদ।

এই কর্মসূচির মাধ্যমে জিয়াউর রহমান সাধারণ মানুষকে উন্নয়নের মূলধারায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা, গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা, কৃষি ও শিল্পের উন্নয়ন করা, নারীর ক্ষমতায়ন, সমাজে ন্যায্যতা অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, যুব সমাজের উন্নয়ন করা। ১৯ দফা কেবল একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিই ছিল না।

বরং জাতি গঠনের এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাও ছিল। এই ১৯ দফার ওপর ভর করেই স্বাধীনতা–উত্তরকালে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিক উন্নয়নের ভিত তৈরি হয়েছে।

১৯ দফা কৃষি ও শিল্পনির্ভর অর্থনীতির পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিল। ৩১ দফা প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। মূলত চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য দেশকে যুক্ত করার নানা পরিকল্পনা রয়েছে ৩১ দফায়। এর পাশাপাশি শাসনকাঠামোয় বেশ কিছু পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে ৩১ দফায়। বিএনপি এটাকে মনে করে রাষ্ট্র মেরামতে আগামী দিনের রূপরেখা।

১৯ দফা তৎকালীন সময়ের চাহিদাকে মাথায় রেখেই প্রণয়ন করা হয়েছিল অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ধারণা থেকে। দেশকে একটি পর্যায়ে নিয়ে গেছে ১৯ দফা। এবার দেশকে আরও এগিয়ে নিতে জনসাধারণের সামনে নতুন নতুন ধারণাসংবলিত ৩১ দফা নিয়ে হাজির হয়েছে বিএনপি।

১৯ দফা কৃষি ও শিল্পনির্ভর অর্থনীতির পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিল। ৩১ দফা প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। মূলত চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য দেশকে যুক্ত করার নানা পরিকল্পনা রয়েছে ৩১ দফায়।

এর পাশাপাশি শাসনকাঠামোয় বেশ কিছু পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে ৩১ দফায়। বিএনপি এটাকে মনে করে রাষ্ট্র মেরামতে আগামী দিনের রূপরেখা।

৩১ দফায় আমরা এক উদার রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন দেখতে পাই। যেখানে সব পক্ষ, মত ও পথের দল এবং জাতি নিয়ে রাষ্ট্র গঠনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

বিভাজনের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে বৈষম্যহীন অহিংস রাজনীতির কথা বলা আছে এতে। এর প্রথম দফাতেই পরিষ্কার করে বলা হয়েছে, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতিকে পরিহার করে সব মত এবং পথের সমন্বয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন সম্প্রীতির রাষ্ট্র গঠন করা হবে।

রাষ্ট্রকে নিরাপদ রাখতে সব পক্ষের সঙ্গে আলাপ–আলোচনার ভিত্তিতে একটি সামাজিক চুক্তি সৃষ্টির করা কথা এতে বলা হয়েছে।

একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনের জন্য এখানে সম অধিকার ও সবার অংশগ্রহণের কথাই বলা হয়েছে। এতে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে, সব পক্ষে আলোচনার ভিত্তিতে সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছানো হবে, যেখানে সবার অংশগ্রহণ থাকবে। মানে রাষ্ট্রের মালিকানা জনসাধারণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া।

চূড়ান্ত বিচারে রাষ্ট্র সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা জনসাধারণের হাতেই থাকবে। রাজনৈতিক দলগুলো সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে কেবল।

বিএনপির ৩১ দফায় বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে রাষ্ট্র কোনো নিরঙ্কুশ শাসক তৈরি করবে না। এমন এক শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হবে, যেখানে সমাজেব সব পক্ষভুক্ত ব্যক্তির সম্পদ ও মেধার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামো নির্মাণ করা হবে। যেমন এখানে বলা হয়েছে, দুবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকতে পারবে না।

মানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী পদে আজীবন ক্ষমতায় থাকার পথ রহিত হবে। এতে নতুন নেতৃত্বের বিকাশ ঘটবে।

বিএনপির গঠনতন্ত্র বা ১৯ দফাতেও একটি বৈষম্যহীন উদার গণতান্ত্রিক অবস্থার কথাই বলা আছে। ৪৭ বছরের দীর্ঘ রাজনৈতিক পরিভ্রমণে বিএনপি একটি উদার রাজনৈতিক দর্শনের ধারা অনুসরণ করেছে। বিএনপি বরাবরই গণতান্ত্রিক উদার রাজনৈতিক পরিবেশের পক্ষে থেকেছে।

এরশাদবিরোধী আন্দোলন থেকে চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান—বিএনপিকে কখনোই গণতন্ত্রের বিপক্ষে নিয়ে যাওয়া যায়নি। ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জামায়াতে ইসলামী এরশাদের অধীনে নির্বাচনে গেছে।

বিএনপিকে টলানো যায়নি। গণতন্ত্রের পক্ষে অটল ছিল বিএনপি। সম্ভবত নিজেদের অতীত ইতিহাস, গণহত্যায় সম্পৃক্ততা, স্বাধীনতার বিরোধিতার কারণেই আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশপন্থী দল বিএনপির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অপতথ্যের প্রচার করে থাকে।

  • ড. মারুফ মল্লিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক