যশোর থেকে ঝিনাইদহের দূরত্ব মাত্র ৪৬ কিলোমিটার। কিন্তু যোগাযোগের ক্ষেত্রে যশোর অনেক এগিয়ে। আপনি চাইলে বিমান, বাস ও ট্রেন—যেকোনো একটি বেছে নিতে পারেন; কিন্তু ঢাকা থেকে ঝিনাইদহে যেতে বাসই একমাত্র গণপরিবহন।
ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়েতে যেতে লাগে এক ঘণ্টা। বিশ্বমানের সড়ক। কিন্তু ভাঙ্গা থেকে ফরিদপুর বা ঝিনাইদহ সড়ককে মনে হবে প্রদীপের নিচে অন্ধকার। বাসে যাওয়া মানে ‘দুর্গমগিরি’ পার হওয়া। একজন সহযাত্রী আক্ষেপ করে বললেন, ‘এই সড়ক দিয়া কখনো গুরুতর রোগী নিয়ে হাসপাতালে যাইবেন না। গেলে গন্তব্যে পৌঁছার আগেই তিনি মারা যেতে পারেন।’
১৬ আগস্ট ঢাকার গুলিস্তান থেকে বিকেল সাড়ে চারটার বাস ছেড়ে ঝিনাইদহে পৌঁছাল রাত ১০টায়। নির্ধারিত সময় ছিল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। ফেরার পথে সাড়ে ছয়টায় রওনা দিয়ে রাত একটা। পরিবহন কর্তৃপক্ষের সাফ কথা, ঢাকা থেকে গাড়ি না এলে তাদের কিছু করার নেই।
তারপরও বলব, পথের ক্লান্তিটুকু বাদ দিলে ১৭ আগস্ট ঝিনাইদহ ও ৮ আগস্ট যশোর সফর ছিল আনন্দময় ও অভিজ্ঞতাঋদ্ধ। যশোরে প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা ছিল সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় মিলনায়তনে। সেখানে যোগ দিয়েছিলেন সংস্কৃতিসেবী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও।
শিক্ষার্থীদের পেশাগত নির্দেশিকা, আত্মবিশ্বাস ও শৃঙ্খলা গঠন, মূল্যবোধের চর্চা, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে যথাক্রমে ‘তুমিই পারবে’, ‘আচরণেই আত্মপরিচয়’ও ‘তোমার পাশে সব সময়’ শিরোনামে বিশ্ববিদ্যালয়টি যেসব কর্মসূচি নিয়েছে, তা–ও ব্যতিক্রমী বলে মনে হয়
ঢাকার বাইরে বাংলাদেশে যেখানেই যাবেন, শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ। ঢাকার মতো যানজটে আটকে থাকা নেই। যেদিন এই কলাম লিখছি, সেদিনও সায়েন্সল্যাবে দুই কলেজের শিক্ষার্থীরা মারামারিতে লিপ্ত ছিলেন। প্রায়ই সেখানে শক্তির মহড়া হয়।
যশোর ও ঝিনাইদহে যঁাদের সঙ্গেই আলাপ হয়েছে, তাঁরা রাজনীতি নিয়ে খুব আগ্রহ দেখাননি। তঁারা জীবনজীবিকা ও নিরাপত্তা নিয়ে বেশি চিন্তিত। এমনকি আগামী নির্বাচন নিয়েও তাঁদের মধ্যে কোনো উচ্ছ্বাস আছে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগের বড় নেতারা আগেই পালিয়েছেন। ছোট নেতারা স্থানীয় বিএনপি বা অন্য দলকে ম্যানেজ করে চলছেন।
সাবেক এমপি আনোয়ারুল আজিম হত্যা মামলার কথা জানতে চাইলে একজন বলেন, গত বছরের ৫ আগস্টের পর কোনো অগ্রগতি নেই। যেসব সম্পদ তিনি বেনামে করেছিলেন, সেগুলো দখল হয়ে গেছে। বাকিটা তাঁর পরিবারের তত্ত্বাবধানে আছে।
যশোর থেকে দুজন শিক্ষক আগেই দেশের সেরা শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ নিয়ে যশোরবাসীর আলাদা গর্ব আছে। কিন্তু এই গর্বের সঙ্গে বেদনাও কম নয়। শিক্ষকেরা খেদের সঙ্গে জানালেন, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক মাত্র ১২ হাজার টাকা বেতন পান, বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা যথাক্রমে ১ হাজার ও ৫৫০ টাকা। এই অর্থ দিয়ে কারও পক্ষেই সংসার চালানো সম্ভব নয়। জাতির কারিগর হিসেবে আমরা যাঁদের নিয়ে গর্ব করি, তাঁদের প্রতি এই অসম্মান কেন?
আলাপ হলো একজন ব্যতিক্রমী শিক্ষকের সঙ্গে। যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের সহকারী অধ্যাপক হামিদুল হক। তিনি শ্রেণিকক্ষে পাঠ দেওয়ার পাশাপাশি কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন আইডিয়া পিঠা পার্ক। এই বিকল্প কর্মসংস্থান প্রকল্প ৩০ হাজার সদস্য অনলাইনে পিঠা বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। পিঠা পার্কের সদস্যরা আয়ের ৩০ শতাংশ গরিবদের জন্য ব্যয় করেন। এই অর্থ দিয়ে প্রতি শুক্রবার শহরের গরিব মানুষদের এক বেলা পেট পুরে খাওয়ার ব্যবস্থা করেন তাঁরা। এ ছাড়া হামিদুল হক ইংরেজি শেখা প্রকল্পের পুরো আয়ই ব্যয় করেন গরিবদের জন্য। গত ডিসেম্বরে যশোর সফরকালে উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেনও আইডিয়া পিঠা পার্কের ভ্রাম্যমাণ দোকানে গিয়ে পিঠাপুলির স্বাদ নিয়েছিলেন।
১৭ আগস্ট ঝিনাইদহে কৃতী শিক্ষার্থী সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল একটি রিসোর্টে। ঝিনাইদহে যে এ রকম দৃষ্টিনন্দন পার্ক আছে, জানা ছিল না। জেলার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরা প্রথম আলো-শিখো আয়োজিত সংবর্ধনায় যোগ দেয়। তাদের উচ্ছ্বাস ছিল মনে রাখার মতো।
কৃতী শিক্ষার্থী সংবর্ধনায় প্রধান অতিথি ছিলেন ড. আবদুল মজিদ, ঝিনাইদহেরই সন্তান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের এই সাবেক অধ্যাপক বর্তমানে যশোর প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
তিনি এসএসসি পর্যায়ে ১২টি বিষয়ে পরীক্ষার প্রয়োজন নেই বলে মন্তব্য করেছেন। সত্যিই তো। যেখানে এ-লেভেল ও ও-লেভেলে ৬টি বিষয়ে পরীক্ষা হয়, সেখানে এসএসসিতে ১২টি বিষয়ে কেন পরীক্ষা দিতে হবে?
৩ আগস্ট প্রথম আলোয় এক কলামে সহকর্মী মুনির হাসান এসএসসি পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিলেন। যত বেশি বই ও পরীক্ষা, শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক চাপ ও অভিভাবকদের খরচ তত বেশি। ঘন ঘন পরীক্ষার কারণে কোচিং ব্যবসা রমরমা। স্বাধীনতার পর কুদরাত–এ–খুদা কমিশন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত একমুখী প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ করেছিল। ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতেও একই কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
আলাপ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবদুল মজিদ তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্মপরিকল্পনার কথাও জানালেন। তার মধ্যে আকর্ষণীয় হলো মাস্টার্স পর্যায়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে রিসার্চ ফেলোশিপ দেওয়া। প্রতি মাসে তাঁরা একটি অর্থ সহায়তা পাবেন। এ ছাড়া ইনোভেশন অ্যান্ড স্টার্টআপ সাপোর্ট সেল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা। বিশ্ববিদ্যালয় শুধু জ্ঞানচর্চার জায়গা নয়, জ্ঞান সৃষ্টিরও।
এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের পেশাগত নির্দেশিকা, আত্মবিশ্বাস ও শৃঙ্খলা গঠন, মূল্যবোধের চর্চা, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে যথাক্রমে ‘তুমিই পারবে’, ‘আচরণেই আত্মপরিচয়’ ও ‘তোমার পাশে সব সময়’ শিরোনামে বিশ্ববিদ্যালয়টি যেসব কর্মসূচি নিয়েছে, তা–ও ব্যতিক্রমী বলে মনে হয়।
‘তুমিই পারবে’ স্লোগানটি প্রথম আলোর বহুল আলোচিত স্লোগান ‘হারবে না বাংলাদেশ’–এর কথাই মনে করিয়ে দেয়। শিক্ষার স্বপ্নযাত্রা যেন থেমে না যায়।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com
মতামত লেখকের নিজস্ব