১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পাহাড়ি–বাঙালিসহ সব মানুষের সর্বাত্মক জনযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের এই ছবিটি রাজশাহী অঞ্চলের।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পাহাড়ি–বাঙালিসহ সব মানুষের সর্বাত্মক জনযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের এই ছবিটি রাজশাহী অঞ্চলের।

মতামত

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের কথা

‘একাত্তরের বীরযোদ্ধাদের অবিস্মরণীয় জীবনগাথা, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা স্মারকগ্রন্থ’ (জনতা ব্যাংক লিমিটেড, ২০১২) বইয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউ কে চিংয়ের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে। বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত ইউ কে চিংয়ের মতো আরও অনেক পাহাড়ি মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন।  

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বিত তালিকা অনুসারে তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের একটা তালিকা পাওয়া যায়। সেই তালিকা অনুসারে বান্দরবান পার্বত্য জেলা থেকে ৮ জন, খাগড়াছড়ি জেলা থেকে ৯২ জন এবং রাঙামাটি জেলা থেকে ২৭ জন বিভিন্ন  জাতিগোষ্ঠীর পাহাড়ি মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। পাহাড়ি মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের বাঙালি সহযোদ্ধাদের পাশাপাশি সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হয়েছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে। তবে এমন অনেক পাহাড়ি মুক্তিযোদ্ধাও আছেন, যাঁরা মুক্তিযোদ্ধার সনদ পাননি বা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেননি।  

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বিত তালিকা অনুযায়ী, তিন পার্বত্য জেলার অধিকাংশ উপজেলা থেকেই পাহাড়ি মুক্তিযোদ্ধারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বান্দরবান জেলার সাতটি উপজেলা থেকে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন, তাঁরা হলেন মং শৈ হ্লা চৌধুরী, সুবেদার মেজর মং সিং নূ, সানু অং, ইউ কে চিং (বীর বিক্রম) (ইপিআর), লাল পুম বম, শাকিয়াং অং, ধুংচাই মারমা, মং শৈ ই প্রু মারমা প্রমুখ।  

খাগড়াছড়ি জেলা থেকে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন, তাঁরা হলেন প্রিয়জ্যোতি রোয়াজা, রবিরশ্মি চাকমা, রুই প্রু মারমা, কংজরী মগ, রণবিক্রম ত্রিপুরা, উক্যজেন মারমা, মং মং মারমা, ম্রাসাথোয়াই মারমা, সাথোয়াই মারমা, ফিলিপ বিজয় ত্রিপুরা, মংসাথোয়াই মগ, মংশো য়ে অং মারমা, নীলোৎপল ত্রিপুরা, কং চাই মারমা, থোয়াই অং মগ, মং মং চিং মগ, আথুই অং মগ, নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, থোয়াই অং রী মারমা, আদুং মগ, ধর্মচরণ চাকমা, নারাসু মারমা, চৌহ্লা প্রু চৌধুরী, সুবিলাস চাকমা, মং থা মারমা, মং লা প্রু মারমা, সুই মং মারমা, কং গ্য দেওয়ান, মণীন্দ্র কিশোর ত্রিপুরা, বিন্দু কুমার ত্রিপুরা, বোধন কুমার কারবারি, মং সুই সা মারমা, মং সা লা মারমা, অর্চন ত্রিপুরা, শৈ চান্দ্রা মারমা, ভূপেন ত্রিপুরা, সাথোয়াই প্রু মগ, হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা, লোকনাথ ত্রিপুরা, পূর্ণ কুমার ত্রিপুরা, জয় কুমার ত্রিপুরা, সুরেশ ত্রিপুরা, রূপেন্দ্র ত্রিপুরা, হরেন্দ্র কুমার ত্রিপুরা, চেং ঞ রী মারমা, সাথোয়াই প্রু মগ, অং কি উ মগ, হৃদয় কুমার ত্রিপুরা, কালাচান দেব বর্মণ ত্রিপুরা, মং আফ্রু শী  মগ, ভাগ্যধন ত্রিপুরা, রণজিৎ দেব বর্মণ, নীলমোহন ত্রিপুরা, লালমোহন ত্রিপুরা, বেণু রায় ত্রিপুরা, এম এন অং মং, ভুবনমোহন ত্রিপুরা, কর্ণমোহন ত্রিপুরা, রি প্রু মগ, ভূপেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, অন্ন কুমার ত্রিপুরা, মোহন ত্রিপুরা, সুবোধ বিকাশ ত্রিপুরা, পূর্ণমোহন ত্রিপুরা, যতীন্দ্র ত্রিপুরা, কর্ণমোহন ত্রিপুরা, কংক্য মগ, উ থাই মগ, প থোয়াই মারমা, নাইগ্য মারমা, মং মেট মারমা, মং জ চাই মারমা, মং রুই বাই মারমা, চাই লা প্রু মারমা, লাব্রে মারমা, ধুম প রী মগ, গগন চন্দ্র ত্রিপুরা, মং সা থোয়াই চৌধুরী, নির্পদ ত্রিপুরা, রামেচ মারমা, মং মারমা, মংপাই মগ, মং হ্লা প্রু মগ, কংজ অং মগ, কংজ সাই মারমা, মংহলা প্রু মারমা, দো অং গ্য মারমা, অংসাথায়াই মারমা, সুই হ্লা প্রু মগ, কাহরি মগ, ম্রা সাথায়াই মগ, মংহলা প্রু চৌধুরী প্রমুখ।

রাঙামাটি জেলা থেকে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন, তাঁরা হলেন করুণামোহন চাকমা, অশোক মিত্র কারবারি, মণীন্দ্র চাকমা, জাপান কুমার চাকমা, কিনা পুতি তঞ্চঙ্গ্যা, চিখন চোখ তঞ্চঙ্গ্যা, দিলীপ মগ, অনীল চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, চিংসা মগ, চিং হ্লা মং চৌধুরী মারী, প্রভোধন চৌধুরী, সঞ্চিত চাকমা, গুণসেন চাকমা, গণমালা তঞ্চঙ্গ্যা, প্রীতিকান্তি ত্রিপুরা, বাবুল মগ, অরুণ মারমা, বসন্ত কুমার ত্রিপুরা, সুবেদার সাইপ্রু মগ, আন্নি মং, কালু বাহাদুর, মং লা প্রু মগ, মনীষ দেওয়ান, চিত্ত রঞ্জন চাকমা, লাল বাহাদুর চৈত্রী, রমণী রঞ্জন চাকমা, খগেন্দ্র লাল চাকমা প্রমুখ।

বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত ইউ কে চিং মারমা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সফল অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এর মধ্যে একটি ছিল কাউওয়াহাগাহাট অপারেশন। অভিযানটি ইউ কে চিংয়ের একক নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের সদস্য হিসেবে বীর বিক্রম ইউ কে চিং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ৬ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছিলেন। ইউ কে চিং ১৯৫২ সালে ১৯ বছর বয়সে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসে যোগদান করেন এবং ঢাকার পিলখানায় সামরিক প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তিনি রংপুর জেলার হাতীবান্ধা সীমান্ত ফাঁড়িতে (বিওপি) একজন নায়েক (করপোরাল) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ওই পোস্টে তিনি একজন বিহারি কর্মকর্তা ও দুজন পাঞ্জাবি সেনাকে হত্যা করেন। তারপর সেখানে অবস্থানরত বাকি নয়জন বাঙালি ইপিআর সদস্যের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দেন। তিনি ক্যাপ্টেন নওয়াজেস উদ্দিনের নেতৃত্বে বিভিন্ন প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পরে তিনি ৬ নম্বর সেক্টরের সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরে যুদ্ধ করেন।

১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার সীমান্তবর্তী চৌধুরীহাটে অবস্থান নেন এবং এক রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ করেন। সারা রাত যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনীর দিক থেকে গোলাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। রায়গঞ্জ ফেরার পথ দুধকুমার নদে সেতুর নিচে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি এলএমজি পজিশন থেকে তাঁদের ওপর প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়। ইউ কে চিং তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করেন এবং শত্রু বাহিনীকে হটিয়ে দেন। চৌধুরীহাট ছাড়াও তিনি হাতীবান্ধা, পাখিউড়া, ভূরুঙ্গামারী, রৌমারীসহ বিভিন্ন স্থানে অসাধারণ বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত হন।  

অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের মং রাজা মং প্রু সাইন শরণার্থীদের মানবিক সেবা এবং মুক্তিবাহিনীকে সক্রিয় সমর্থন দেওয়ার মাধ্যমে এক ব্যতিক্রমী অবদান রেখেছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংস দমন-পীড়নের পর বাস্তুচ্যুত হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ পার্বত্য অঞ্চলে পালিয়ে যান। রাজা মং প্রু সাইন শরণার্থীদের জন্য তাঁর প্রাসাদ খুলে দেন, তাঁর শস্যভান্ডার শরণার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং আহত মানুষের জন্য চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এ ক্ষেত্রে রানি এবং পাহাড়ি জনগোষ্ঠীরও ছিল জোরালো সমর্থন ও সহযোগিতা। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ৩৩টি রাইফেল, যানবাহন এবং লজিস্টিক সহায়তা করে সরাসরি সামরিক সহায়তা প্রদান করেন এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অনেক যুবককে যুদ্ধে যোগদানের জন্য অনুপ্রাণিত করেন।

পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বড় আক্রমণের পর তিনি নির্বাসনে যেতে বাধ্য হলেও তিনি মুক্তিযোদ্ধা গেরিলাদের প্রশিক্ষণ, সহায়তা প্রদান, সমন্বয়সাধন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন অব্যাহত রাখেন। তিনি পরে চূড়ান্তভাবে সশস্ত্র যুদ্ধে যোগ দেন এবং বিজয়ের পর মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ঢাকায় প্রবেশ করেন। তিনি কর্নেল পদমর্যাদায় ভূষিত হয়ে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন অনুপ্রেরণাদায়ক ব্যক্তিত্ব হলেও যথার্থ স্বীকৃতিবঞ্চিত একজন নায়ক হিসেবেই রয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর মতো অনেক নাম না–জানা পাহাড়ি মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে অবদান রেখেছিলেন, যেখানে স্বাধীনতার পর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধায় দেশ ছেয়ে গিয়েছিল, সেখানে অনেক পাহাড়ি মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে অংশ নেওয়ার পরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি নেওয়ার কোনো  প্রয়োজনীয়তাও উপলব্ধি করেননি।  

  • মিলিন্দ মারমা: আদিবাসী লেখক ও অধিকারকর্মী

    ই-মেইল: milinda.marma@gmail.com

    মতামত লেখকের নিজস্ব