
অন্তর্বর্তী সরকার একটা ‘স্বাধীন আওয়ামী গোপালগঞ্জ’ মেনে নিয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে বারবারই করেছি। শেখ হাসিনার পতন এবং পলায়নের পর থেকে গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনীর ওপর হামলা, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় নেতাকে হত্যা, থানা এবং পুলিশের ওপর হামলার ইতিহাস আছে।
যৌক্তিক কারণেই এই ধারণা জনগণের মধ্যে আছে, আওয়ামী লীগের যেসব নেতা-কর্মী ও সন্ত্রাসীরা নিদেনপক্ষে ভারতে পালিয়ে যেতে পারেননি তাঁরা গোপালগঞ্জে আশ্রয় নিয়েছেন। প্রত্যাশা ছিল, মানবাধিকার নিশ্চিত রেখেই অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার জন্য সরকার খুবই কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।
কিন্তু সরকারের দিক থেকে তেমন কোনো কিছু দেখা যায়নি। যেহেতু গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি উন্নয়নে যথেষ্ট কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, তাই সরকারের জানা উচিত ছিল ওই জেলায় এনসিপির কর্মসূচিতে কী ধরনের পরিস্থিতি হতে পারে।
এনসিপির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গোপালগঞ্জে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হলো। এমন পরিস্থিতি যে হতে পারে, সেটার খবর কি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সরকার আগে জানতে পারেনি? যদি সেটা না পেরে থাকে তাহলে এটা তো এক অকল্পনীয় ব্যর্থতা, যা আমাদের রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে। আর যদি এটা জানার পরও এনসিপিকে আপাতত এই জেলা সফর থেকে নিবৃত্ত না করা হয়ে থাকে, তাহলে প্রশ্ন আসবেই জেনেশুনে এই পরিস্থিতি সরকার কেন হতে দিল? প্রশ্ন এসেছে, দেশব্যাপী ‘পদযাত্রা’ করতে চাওয়া এনসিপি গোপালগঞ্জে কেন ‘মার্চ’ করতে গেল?
এই কলামের মূল ইস্যু, গোপালগঞ্জের ঘটনার রাজনৈতিক তাৎপর্য, আলোচনার আগে কয়েকটি কথা বলে রাখা জরুরি। এই ঘটনায় চারজন মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। অন্তত একজন আহত মানুষের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের অমানবিক আচরণের প্রমাণ আছে। সরকারের উচিত হবে এই ঘটনা সামাল দিতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রয়োজনের অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেছে কি না, সেটা আন্তরিকভাবে তদন্ত করা। বিশেষ করে মৃত্যুগুলো অনিবার্য ছিল কি না, এটা একটা সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বের করা জরুরি।
শেখ হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে আমরা মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ গড়তে চাই, যেখানে এমনকি সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসীটিও ন্যায়বিচার পাবে। ১৫ বছরের বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোটি পুরোটা ভেঙে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছেন শেখ হাসিনা, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সময় যে অকল্পনীয় বর্বরতা দেখিয়েছেন তিনি এবং তাঁর দল, এরপরও তাঁদের সমর্থনে মানুষকে তাঁদের পক্ষে মাঠে নামতে দেখা মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা বটেই। কিন্তু দিনের শেষে এই মানুষদেরও আর সব বাংলাদেশি নাগরিকের মতো সব অধিকার প্রাপ্য।
গোপালগঞ্জের ঘটনার মধ্যেই এনসিপির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা এই প্রশ্ন তুলেছেন, একটা জেলায় রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ সরকার কীভাবে নির্বাচন করবে। অর্থাৎ দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতি নির্বাচন করার উপযোগী নয়। কথাটাকে খুব বিচ্ছিন্ন মন্তব্য হিসেবে দেখা যায় না, কারণ একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে দীর্ঘদিন থেকে।
ফিরে আসা যাক আমাদের মূল প্রসঙ্গে। রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাবে দেখা যায়, গোপালগঞ্জের ঘটনা এনসিপিকে প্রাথমিকভাবে কিছু সুবিধা দিয়েছে তো বটেই। দলটি এই ঘটনার মাধ্যমে বেশ আলোচনায় এল। এর বাইরেও তারা এই বলে বয়ান তৈরি করতে চাইছে, গোপালগঞ্জে কোনো রাজনৈতিক দল যেতে পারবে না, এই মিথ তারা ভেঙে দিয়েছেন। এই তথ্য অবশ্য ঠিক না, কারণ অনেক দিন থেকেই গোপালগঞ্জে বিএনপির সাংগঠনিক কাজ চলছে।
তা ছাড়া আওয়ামী লীগ দ্বারা আক্রান্ত হওয়া এনসিপির প্রতি অনেকটা সহানুভূতিও সম্ভবত তৈরি করছে। আবার অন্যদিকে গোপালগঞ্জ থেকে যেভাবে সামরিক বাহিনীর এপিসিতে চড়ে তাঁদের চলে আসতে হয়েছে, সেটাকেও রাজনীতির মাঠে তাঁদের পরাজয় হিসেবে দেখতে চাইছেন কেউ কেউ। এই আলোচনার মধ্যেই গোপালগঞ্জের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরেকটা বিষয় মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
গোপালগঞ্জের ঘটনার মধ্যেই এনসিপির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা এই প্রশ্ন তুলেছেন, একটা জেলায় রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ সরকার কীভাবে নির্বাচন করবে। অর্থাৎ দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতি নির্বাচন করার উপযোগী নয়। কথাটাকে খুব বিচ্ছিন্ন মন্তব্য হিসেবে দেখা যায় না, কারণ একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে দীর্ঘদিন থেকে।
সরকার থেকে পদত্যাগ করে এনসিপির দায়িত্ব দেওয়ার পর জনাব নাহিদ ইসলাম দুটি বিদেশি সংবাদ সংস্থার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতি এই বছরের মধ্যে নির্বাচন করার উপযোগী নয় (তখন ডিসেম্বরে নির্বাচনের আলাপ হচ্ছিল)।
কিছুদিন আগে পাটগ্রাম থানায় বিএনপি কর্মীদের হামলা এবং আসামি মুক্ত করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে নির্দেশ করে (যদিও তিনি পটিয়া থানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হামলার কথা উল্লেখ করেননি) জামায়াত আমির বলেছিলেন, ‘এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন কিসের, কী নির্বাচন হবে।’
লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা এবং জনাব তারেক রহমানের বৈঠকের পর ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে একধরনের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে জনগণের মধ্যে। কিন্তু নানা কারণে দেশের নির্বাচন হওয়ার পরিস্থিতি নেই—এমন একটা আলাপও মাঠে পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ না, সংস্কার-বিচার যথেষ্ট হচ্ছে না, এমন নানা ইস্যু সামনে এনে নির্বাচন বিলম্বিত করার আলাপ করা হচ্ছে। এর সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অনুপযোগিতার কথা।
এখন এই প্রশ্ন কেউ তুলতেই পারেন যে গোপালগঞ্জে এমন একটি পরিস্থিতি কি জেনে বুঝেই তৈরি করা হলো, যা নির্বাচনকে পিছিয়ে দেওয়ার যৌক্তিকতাকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে? ফেব্রুয়ারি যদি নির্বাচনের জন্য আইনশৃঙ্খলার দিক থেকে যথেষ্ট উপযোগী না হয়ে থাকে, তাহলে প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া সর্বোচ্চ সীমা ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির গ্যারান্টি কী? যে সরকার দেড় বছরের মধ্যে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নির্বাচনের উপযোগী করে তুলতে পারে না, সেই সরকার ঠিক কোন জাদুতে পরবর্তী চার মাসের মধ্যে সেটা পারবে? আর এই সময়ের মধ্যে যে আরও অনেক ঘটনা ঘটবে না বা বা ‘ঘটানো’ হবে না তারই বা নিশ্চয়তা কী!
নির্বাচন ফেব্রুয়ারি থেকে সরিয়ে এপ্রিলে নিয়ে যাওয়া গেলে যদি কোনো রাজনৈতিক দলের অনেকটা সুবিধা হয়, সেই চেষ্টা তারা করতে পারেন। কিংবা নির্বাচনের আলাপ তুলে বিএনপির কাছ থেকে আসন ভাগাভাগি বা অন্য কোনো রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করা যায়, সেটাও চলতে পারে।
এসব বিষয়কে আমরা গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চৌহদ্দির মধ্যে আছে বলেই গ্রহণ করব। কিন্তু নির্বাচন পেছানোর আলাপ দীর্ঘ সময়ের জন্য দেশকে নির্বাচনহীন রাখার কৌশল হিসেবে যদি ব্যবহৃত হয়, সেটা আমাদের রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের জন্য খারাপ পরিণতি ডেকে আনবে।
এই সরকার সংস্কারের মতো অত্যন্ত বড় এজেন্ডার কথা সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে বলছে দীর্ঘদিন থেকে। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে মানবিক করিডর দেওয়া কিংবা চট্টগ্রাম বন্দরকে বিদেশি কোম্পানির পরিচালনায় ছাড়ার মতো অত গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছে। কিন্তু এই সরকারটি দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো নিতান্ত রুটিন কাজ করার ক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
গোপালগঞ্জের ঘটনা দেশের ভবিষ্যৎ এবং প্রধান উপদেষ্টার জন্য একটি জেগে ওঠার ডাক। দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ঘাটতির কারণে যদি নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয় তাহলে তার দায়ভার একমাত্র সরকারের। সরকার তার অদক্ষতার কারণে এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে এই আলোচনার চেয়ে সরকার নির্বাচন পেছানোর এই পরিকল্পনার সক্রিয় অংশ—এই আলোচনা বরং অনেক বেশি ভিত্তি পাবে।
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো নির্বাচন করতে চাওয়া প্রধান উপদেষ্টা এখন এই পরীক্ষার মুখোমুখি। পরে তীব্র প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়ে আরেকবার পদত্যাগের ইচ্ছা পোষণ করার চেয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রধান কর্তব্য হবে তাঁর পরিষদকে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানোর মাধ্যমে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করে নির্বাচনের অত্যাবশ্যকীয় শর্ত পূরণ করা।
জাহেদ উর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
(মতামত লেখকের নিজস্ব)