ফুলবাড়ী কয়লা খনির বিরুদ্ধে আন্দোলন। ফুলবাড়ী, দিনাজপুর; আগস্ট, ২০০৬
ফুলবাড়ী কয়লা খনির বিরুদ্ধে আন্দোলন। ফুলবাড়ী, দিনাজপুর; আগস্ট, ২০০৬

বিশ্লেষণ

২০০৬ সালে ফুলবাড়ীতে কী ঘটেছিল, কেন ঘটেছিল

১৯ বছরেরও বেশি সময় আগে ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে বিদেশি কোম্পানি এশিয়া এনার্জির বিরুদ্ধে এক গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল।

তৎকালীন এশিয়া এনার্জি কোম্পানির (বর্তমানে যা জিসিএম পিএলসি নামে পরিচিত) পরিকল্পনা ছিল ফুলবাড়ী উপজেলার চারটি থানার প্রায় ৬৭ বর্গকিলোমিটার জমি অধিগ্রহণ করে গভীর গর্ত করে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা এবং উত্তোলিত কয়লা বিদেশে রপ্তানি করা, বিনিময়ে বাংলাদেশকে মাত্র ৬ শতাংশ রয়্যালটি প্রদান করা।

প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ ও দেশের স্বার্থবিরোধী এই প্রকল্পকে সেসময় উন্নয়ন প্রকল্প বলে উল্লেখ করে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়েছিল। কিন্তু ফুলবাড়ীর জনগণ এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।

ফুলবাড়ীতে এই কয়লাখনি আবিষ্কার করেছিল বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কয়লা উত্তোলনকারী কোম্পানি অস্ট্রেলিয়ার বিএইচপি। কিন্তু ভূতাত্ত্বিক জটিলতা, কৃষিজমি ও বন্যাপ্রবণ এলাকা, নদী-খালবেষ্টিত ভূপ্রকৃতি এবং ঘনবসতির কারণে এখানে উন্মুক্ত কয়লাখনি করতে গেলে পরিবেশগত ও সামাজিক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে—এ রকম অনুধাবন থেকে বিএইচপি নিজে এখানে কয়লা খননের চেষ্টা করেনি। বরং ১৯৯৮ সালে নবগঠিত এশিয়া এনার্জির কাছে লাইসেন্স হস্তান্তর করে বাংলাদেশ ত্যাগ করে, যে কোম্পানির কয়লাখনি করার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই।

এশিয়া এনার্জি ফুলবাড়ীতে তৎপরতা শুরু করে ২০০৪ সালে, যা ২০০৫ সালে ব্যাপক আকার ধারণ করে। কোম্পানিটি এ সময় ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে ফুলবাড়ী, বিরামপুর, পার্বতীপুর ও নবাবগঞ্জ অঞ্চলে উন্মুক্ত কয়লাখনির পক্ষে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালায়।

কিন্তু কৃষিজমি ও বসতভিটা ধ্বংস করে কয়লা উত্তোলনের ব্যাপারটি স্থানীয় জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তা ছাড়া উত্তোলিত কয়লা বিদেশে রপ্তানি করা ও বাংলাদেশের জন্য মাত্র ৬ শতাংশ রয়্যালটির বিষয়টিও ছিল আপত্তিকর। ফলে বসতি, খাদ্যনিরাপত্তা, জ্বালানিনিরাপত্তা, পরিবেশগত ভারসাম্য—সব দিক থেকেই প্রকল্পটি স্থানীয় জনগণের কাছে ভয়ংকর ক্ষতিকর একটি প্রকল্প হিসেবে প্রতীয়মান হয়।

ফুলবাড়ী কয়লা খনির বিরুদ্ধে আন্দোলন। ফুলবাড়ী, দিনাজপুর ২৬ আগস্ট, ২০০৬

ফুলবাড়ীতে কয়লখনির বিরুদ্ধে আন্দোলন

স্থানীয় জনগণ কয়লাখনি প্রকল্পের বিরোধিতা করে ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথমে ‘ফুলবাড়ী শহর রক্ষা কমিটি’, পরে গ্রামাঞ্চলগুলোকে যুক্ত করে আরও বৃহত্তর রূপে ‘ফুলবাড়ী রক্ষা কমিটি’ গঠন করেন এবং স্মারকলিপি, মিছিল, অনশন, হরতালসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করেন।

একপর্যায়ে স্থানীয় জনগণের আগ্রহে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয় তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি, গঠিত হয় জাতীয় কমিটির ফুলবাড়ী শাখা। এর ফলে ফুলবাড়ী উন্মুক্ত কয়লাখনি–বিরোধী আন্দোলন জাতীয় মাত্রা পায়।

উল্লেখ্য জাতীয় কমিটি এ সময় ফুলবাড়ী ছাড়াও বড়পুকুরিয়া অঞ্চলে ভারতীয় টাটা কোম্পানির উন্মুক্ত কয়লাখনিসহ স্টিল মিল ও সার কারখানা নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিল। ভারতীয় টাটা একদিকে এশিয়া এনার্জির মতো ফুলবাড়ীর পাশের অঞ্চল বড়পুকুরিয়াতে উন্মুক্ত কয়লাখনি করতে চেয়েছিল, অন্যদিকে স্টিল মিল ও সার কারখানার জন্য ভর্তুকি মূল্যে ২০ বছরের জন্য গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা চেয়েছিল, যা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশি দামে এলএনজি আমদানি করে কম দামে টাটাকে গ্যাস দিতে হতো। জাতীয় কমিটিসহ দেশের সচেতন মানুষদের বিরোধিতার কারণে ভারতীয় টাটার এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়নি।

জাতীয় কমিটির উদ্যোগে ২০০৬ সালের মার্চে ঢাকা থেকে ফুলবাড়ী পর্যন্ত রোডমার্চ অনুষ্ঠিত হয়। একই সময় এশিয়া এনার্জির পক্ষ থেকে চালানো হয় ব্যাপক প্রচারণা ও লবিং তৎপরতা, সেই সঙ্গে চেষ্টা চলে স্থানীয়দের প্রলুব্ধ করার নানা তৎপরতা।

দেশি–বিদেশি অনেক বিশেষজ্ঞ ও সংবাদমাধ্যম এশিয়া এনার্জির অর্থের কাছে বিক্রি হয়ে গেলেও নিজেদের ভিটেমাটি ও কৃষিজমি রক্ষায় ফুলবাড়ীর জনগণ ছিলেন অটল। এ সময় স্থানীয় জনগণের দিক থেকে এশিয়া এনার্জির অফিস ঘেরাওয়ের দাবি ওঠে এবং ২৬ আগস্ট ২০০৬ সেই কর্মসূচির দিন চূড়ান্ত করা হয়।

‘উন্মুক্ত না, রপ্তানি না, বিদেশি না’—এই স্লোগান নিয়ে সেদিন জাতীয় কমিটির নেতৃত্বে এশিয়া এনার্জির অফিস ঘেরাও কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিলেন প্রায় এক লাখ মানুষ। সমাবেশ থেকে এশিয়া এনার্জিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে এক দিনের মধ্যে ফুলবাড়ী ত্যাগের আলটিমেটাম দেওয়া হয়। সমাবেশ যখন শেষের দিকে, তখন হঠাৎ গুলি চালায় তৎকালীন বিডিআর বাহিনী। এতে নিহত হন আমিন, তরিকুল ও সালেকিন, যাঁরা সবাই ছিলেন কিশোর ও তরুণ।

এর প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন ফুলবাড়ী, দিনাজপুরসহ সারা দেশের জনগণ। ফুলবাড়ীতে অনির্দিষ্টকালের জন্য হরতাল ডাকা হয়, সারা দেশে জোরদার হয় প্রতিবাদ ও সংহতি আন্দোলন। ফুলবাড়ীসহ আশপাশের এলাকা জনগণের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এ পর্যায়ে এসে ফুলবাড়ীর জনগণের বক্তব্য গণমাধ্যমের গুরুত্ব ও মনোযোগ পায়। তার আগপর্যন্ত উন্মুক্ত কয়লাখনির পক্ষে বিদেশি কোম্পানির বয়ানই বিশেষজ্ঞ মতামত হিসেবে একচেটিয়াভাবে প্রচারিত হচ্ছিল।

একপর্যায়ে ২০০৬ সালের ৩০ আগস্ট সরকার বাধ্য হয় আন্দোলনকারীদের সাত দফা দাবি মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করতে। সরকারের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের চুক্তিতে বলা হয়, ফুলবাড়ীসহ বাংলাদেশের কোনো জায়গায় উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লাখনি করা হবে না, এশিয়া এনার্জির সঙ্গে সব চুক্তি বাতিল করা হবে এবং কোম্পানিকে এলাকা ত্যাগ করতে হবে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে হতাহত ফুলবাড়ীর আন্দোলনকারীরা। ফুলবাড়ী, দিনাজপুর; ২৬ আগস্ট, ২০০৬

বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা

ফুলবাড়ী গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণ শুধু ফুলবাড়ীকেই নয়, গোটা উত্তরবঙ্গকেই ভয়াবহ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন।

প্রথমত, ফুলবাড়ী-বড়পুকুরিয়া অঞ্চলের কয়লা স্তরের ওপরে রয়েছে ৮০ থেকে ১২০ মিটার পুরু ডুপিটিলা পানির স্তর। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করতে হলে কয়লার ওপরের স্তরকে পানিশূন্য করতে হতো। এ জন্য পাম্পের মাধ্যমে মাটির নিচ থেকে বিপুল পরিমাণ পানি উত্তোলন করে সরিয়ে ফেলতে হতো।

এভাবে ডুপিটিলা স্তরকে পানিশূন্য করা হলে খনি এলাকা ছাড়াও চারপাশের একটা বিশাল এলাকাজুড়ে কৃষিকাজ, খাওয়ার পানি ও গৃহস্থালির কাজে ব্যবহারের পানি পাওয়া যেত না।

এ বিষয়ে প্রথিতযশা জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নূরুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে—ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে খনির কেন্দ্র থেকে এলাকার চারদিকে ৩১৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত বিভিন্ন গভীরতায় পানির স্তর নিচে নেমে যাবে। (ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্ট অ্যান্ড স্কিম অব ডেভেলপমেন্ট এর মূল্যায়নের জন্য গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদন, ২০ সেপ্টেম্বর ২০০৬, পৃষ্ঠা ১২২)

২০১২ সালে গঠিত মোশাররফ কমিটির রিপোর্টে মাটির নিচ থেকে পানি তুলে ফেলার বিপদ সম্পর্কে বলা হয়েছে—‘কয়লাখনির কেন্দ্র থেকে ২৭ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ পর্যন্ত এলাকায় টিউবওয়েল, শ্যালো মেশিন ও ডিপ টিউবওয়েলে কৃষিকাজ ও গৃহস্থালির কাজে ব্যবহারের জন্য পানি পাওয়া যাবে না।’ (মোশাররফ কমিটির রিপোর্ট, পৃষ্ঠা ৫১)

পৃথিবীর অন্য অনেক জায়গার কয়লার স্তরের সঙ্গে বাংলাদেশের কয়লা স্তরের পার্থক্য হচ্ছে, অন্যান্য জায়গায় সাধারণত পানির স্তর থাকে কয়লা স্তরের নিচে, বাংলাদেশের মতো কয়লা স্তরের ওপরে নয়। ফলে ওইসব দেশে কয়লা তুলতে গিয়ে গোটা এলাকা মরুকরণের কোনো প্রয়োজন পড়ে না।

মোশাররফ কমিটির রিপোর্টে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে: ‘এটা সত্যি যে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে উন্মুক্ত খনন করতে গিয়ে পানি ব্যবস্থাপনা করতে হয়। কিন্তু এসব জায়গার ভূপ্রাকৃতিক অবস্থা বাংলাদেশের তুলনায় ভিন্ন রকম। এর সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত হলো ভারতের নেইভ্যালি লিগনাইট মাইন, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। কিন্তু সেখানে পানির স্তর কয়লা স্তরের নিচে, কয়লা স্তরের ওপরে নয়, যা বাংলাদেশের পরিস্থিতি থেকে একেবারেই ভিন্ন।’ (মোশাররফ কমিটির রিপোর্ট, পৃষ্ঠা ৪০)

নিহতদের গায়েবানা জানাজায় ফুলবাড়ীর সর্বস্তরের জনতা হাত তুলে শপথ নেয় কয়লা খনি হতে দেওয়া যাবে না। আগস্ট, ২০০৬

দ্বিতীয়ত, এশিয়া এনার্জির দেওয়া তথ্য অনুসারে, ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত কয়লাখনি করতে হলে অন্তত ৬,৬৮৮ হেক্টর বা ৬৬ দশমিক ৮৮ বর্গকিলোমিটার (১০০ হেক্টর সমান ১ বর্গকিলোমিটার) জমি অধিগ্রহণ করতে হতো, যার মধ্যে ৫৪ দশমিক ২৮ বর্গকিলোমিটার জমিতে কয়লাখনি করা হতো। (এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্পের পরিবেশ সমীক্ষা, অধ্যায় ৭, ভলিউম ১, পৃষ্ঠা ৪৯) এর ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষকে উচ্ছেদ করে পুনর্বাসন করতে হতো।

এশিয়া এনার্জি ২০০৫ সালে দাবি করেছিল যে এ জন্য ১২,৩১২টি পরিবারের ৫৪,০৭৪ জনকে উচ্ছেদ ও পুনর্বাসন করতে হবে। (এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্পের পরিবেশ সমীক্ষা, অধ্যায় ৭, ভলিউম ১, পৃষ্ঠা ৫৭)

বাস্তবে এই সংখ্যাটি আরও অনেক বেশি হতো। ২০১২ সালের মোশাররফ কমিটির রিপোর্টে ১০ লাখ মানুষকে পুনর্বাসনের কথা বলা হয়েছিল। (মোশাররফ কমিটির রিপোর্ট ২০১২, পৃষ্ঠা ৩০) ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে এই বিপুল পরিমাণ উচ্ছেদকৃত মানুষকে যথাযথ পুনর্বাসন করা প্রায় অসম্ভব একটি কাজ।

তৃতীয়ত, ফুলবাড়ী প্রকল্পের পরিবেশ সমীক্ষা অনুসারে, উন্মুক্ত খননের জন্য যে জমি অধিগ্রহণ করা হতো তার মধ্যে ৪২ দশমিক ৩৪ বর্গকিলোমিটার কৃষিজমি। (এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্পের পরিবেশ সমীক্ষা, অধ্যায় ৭, ভলিউম ১, পৃষ্ঠা ৫১)

কয়লা উত্তোলনের জন্য এই বিপুল পরিমাণ তিন ফসলি জমির ওপরের স্তরের মাটি একবার সরানো হলে, হাজার বছর ধরে তৈরি উর্বরতা আর সহজে ফিরিয়ে আনা যেতে না। এর মধ্যে কয়লার ওপরের স্তর থেকে উত্তোলন করা মাটি বা ওভার বার্ডেন রাখার জন্য ১৯ দশমিক ৪৬ বর্গকিলোমিটার এবং জলাধারের জন্য ৬ দশমিক ৯৬ বর্গকিলোমিটার, অর্থাৎ মোট ২৬ দশমিক ৪ বর্গকিলোমিটার কৃষিজমিতে ফসল উৎপাদন চিরতরে বন্ধ হয়ে যেতে।

এ বিষয়টি উল্লেখ করে নূরুল ইসলাম কমিটির রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়েছিলে—‘ক্ষতিগ্রস্ত ২৬ দশমিক ৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা দিনাজপুর শহরের আয়তনের সমান। বাংলাদেশের ন্যায় ঘনবসতিপূর্ণ দেশে ভূমির এ ধরনের অব্যবহার কাম্য নয়।’ (নূরুল ইসলাম কমিটির রিপোর্ট, সেপ্টেম্বর ২০০৬, পৃষ্ঠা ১২৭-১২৮)

নিহতদের স্মরণে স্মৃতিশোধ। ফুলবাড়ী, দিনাজপুর

এ বিষয়ে মোশাররফ কমিটির রিপোর্টে বলা হয়, ‘ফুলবাড়ী উন্মুক্ত খনন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে কম করে হলেও ৩ হাজার হেক্টর তিন ফসলি জমি, আবাসন, মাছ, সবজি, ফল, গাছপালা ধ্বংসের ফলে আগামী ৫০ বছরে বাংলাদেশের অন্তত ২৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হবে।’ (মোশাররফ কমিটির রিপোর্ট ২০১২, পৃষ্ঠা ৫০)

চতুর্থত, প্রায় ৬৭ বর্গকিলোমিটার জমি অধিগ্রহণ করে বিপুলসংখ্যক মানুষের আবাসন, কৃষিকাজ ও ব্যবসা ধ্বংসের বিনিময়ে ফুলবাড়ী কয়লাখনি তৈরির সময় ২১০০ এবং দীর্ঘ মেয়াদে মাত্র ১২০০ লোকের কর্মসংস্থান হতো। (এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্পের পরিবেশ সমীক্ষা, অধ্যায় ৯, ভলিউম ১, পৃষ্ঠা ৬) কয়লাখনির কাজে বিশেষ কারিগরি দক্ষতার প্রয়োজন হওয়ায়, এর মধ্যে প্রকল্পের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কর্মসংস্থান হতো খুবই সামান্য।

পঞ্চমত, প্রস্তাবিত খনি এলাকায় মাটির নিচে সালফারের পরিমাণ ২ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশ এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ হওয়ায় উত্তোলিত মাটিতে থাকা সালফার যৌগ বাতাস ও পানির সঙ্গে বিক্রিয়া করে অ্যাসিড তৈরি হতো, যাকে অ্যাসিড মাইন ড্রেনেজ বলা হয়। (ফুলবাড়ী কোল: আ পারলাস প্রজেক্ট, নস্ট্রমো রিসার্চ, নভেম্বর ২০০৮) এই অ্যাসিডমিশ্রিত পানিতে তামা, সিসা, পারদ ইত্যাদি বিষাক্ত ভারী ধাতু মিশে গোটা এলাকার মাটির নিচের ও মাটির ওপরের পানি দূষিত করে ফেলত।

এ বিষয়ে নূরুল ইসলাম কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় উন্নত দেশে ফেডারেল এবং স্টেট পর্যায়ে এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি এবং তাদের কঠোর আইন ও তদারকির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ওপেনকাট মাইনিং এর ফলে সৃষ্ট অ্যাসিড মাইন ড্রেনেজ ম্যাটেরিয়াল ও অন্যান্য পরিবেশগত সমস্যা রোধ করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেটের হাজার হাজার মাইল নদী পথ অ্যাসিড মাইন ড্রেনেজের কারণে দূষিত হয়েছে।’ (নূরুল ইসলাম কমিটির রিপোর্ট, সেপ্টেম্বর ২০০৬, পৃষ্ঠা ১২৩)

আমদানি–নির্ভরতা কমানোর ‘অজুহাত’

এ বিষয়ে সন্দেহ থাকার কোনো অবকাশ নেই যে কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানির জোগান দেওয়ার জন্য ফুলবাড়ী ও বড়পুকুরিয়া অঞ্চলে উন্মুক্ত কয়লাখনি করা হলে ভয়াবহ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটত। কিন্তু তারপরেও উদ্দেশ্যমূলকভাবে মাঝে মাঝেই ফুলবাড়ী উন্মুক্ত কয়লাখনির পক্ষে জনমত তৈরির চেষ্টা করা হয়। পার্থক্য হলো আগে এশিয়া এনার্জির পক্ষ থেকে কয়লা রপ্তানি করে কত আয় হবে তার লোভ দেখানো হতো, এখন যুক্তি দেওয়া হয় কয়লা আমদানি–নির্ভরতা কমানোর।

এখন কয়লা খননের যুক্তি হিসেবে আমদানি–নির্ভরতা কমানোর কথা বলা হলেও, কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তৈরি করার সময় কিন্তু বিদেশ থেকে কয়লা আমদানি করে সস্তায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলা হয়েছিল। স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ক্ষতি উপেক্ষা করে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক দেখিয়ে একের পর এক কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র করা হলেও দেখা যাচ্ছে কয়লা থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের খরচ অনেক বেশি পড়ছে।

২০০৮ সালে ফুলবাড়ী দিবসে পুরোনো লুঙ্গি কেটে বানানো ব্যানার নিয়ে শিশু–কিশোরদের স্লোগান

অথচ দেশে যখন একের পর এক কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছিল, তখনই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল যে, শুরুতে বিদেশ থেকে কয়লা আমদানি করে সস্তায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের মুলা ঝোলানো হলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু হওয়ার পর বলা হবে—বিদেশ থেকে কয়লা আমদানি করতে অনেক ডলার প্রয়োজন, দেশের অর্থনীতির পক্ষে এর চাপ বহন করা সম্ভব হচ্ছে না, কাজেই পরিবেশের ক্ষতি করে হলেও এখন দেশের কয়লা উত্তোলন করতে হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে দেশের পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর কয়লাখনি প্রকল্পের পক্ষে জনমত তৈরির চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

দেশের জ্বালানিনিরাপত্তার কারণ দেখানো হলেও এই উদ্যোগের পেছনে যে দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানাধীন কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে, তা স্পষ্ট বোঝা যায় ফুলবাড়ী থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের মূল পরিকল্পনাকারী কোম্পানি জিসিএমের (সাবেক এশিয়া এনার্জি) একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি থেকে।

২০২৪ সালের ১১ মার্চ প্রকাশিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটিতে জিসিএম জানিয়েছিল, কোম্পানিটি বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে কয়লা উৎপাদনকারী এস এস পাওয়ারের ১৩২০ মেগাওয়াট বাঁশখালী কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানির ৩৫০ মেগাওয়াটের বরিশাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছ থেকে ফুলবাড়ীর কয়লা ক্রয়ের আগ্রহপত্র পেয়েছে।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, ফুলবাড়ী থেকে কয়লা কিনতে চাওয়া এ দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রেই চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়না লি. (‘পাওয়ার চায়না’)–এর অংশীদারত্ব রয়েছে (https://en.powerchina.cn/2023-04/20/c_828308.htm; https://en.powerchina.cn/2023-10/23/c_828605.htm) আর জিসিএম এই পাওয়ার চায়নার সঙ্গেই ফুলবাড়ী কয়লা উত্তোলনে ‘সহযোগিতা’ করবার জন্য ১ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।

জিসিএম পাওয়ার চায়না ছাড়াও সম্প্রতি ২৮ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে ফুলবাড়ী কয়লাখনি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সম্মতি অর্জনে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে ডিজিআই ইনফ্রাটেক প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি বাংলাদেশি-নিয়ন্ত্রিত কোম্পানির সঙ্গে পরামর্শক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ফলে মাঝে মাঝেই কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য ফুলবাড়ী উন্মুক্ত কয়লাখনি করার পক্ষে যে প্রচারণা চলে তার সঙ্গে এসব পরামর্শক ও লবিস্ট প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক থাকা অস্বাভাবিক নয়।

অথচ দেশে কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রের বিকল্প আগেও ছিল, এখনো আছে। বিদ্যমান কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এমনিতেই দেশের পরিবেশ ও অর্থনীতির ক্ষতি করছে। এখন আবার সেই বিদ্যুৎকেন্দ্রে সস্তায় কয়লা জোগানের নামে বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি, বসতবাড়ি ও পানিসম্পদ ধ্বংস করে অর্থাৎ দেশের পরিবেশ ও অর্থনীতির আরও বেশি ক্ষতি করে উন্মুক্ত কয়লা খনন কোনো টেকসই পরিকল্পনার দৃষ্টান্ত হতে পারে না।

বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত হলো স্থলভাগের ও সাগরের গ্যাস উত্তোলন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে জোর দেওয়া। এই বিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব না দিয়ে কয়লা আর এলএনজির পেছনে যত বেশি অর্থ ও সময় ব্যয় করা হবে বিপদ তত বাড়বে।

  • কল্লোল মোস্তফা টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক

*মতামত লেখকের নিজস্ব