ইরানের মিসাইল হামলায় ধ্বংস হওয়া ইসরায়েলের স্থাপনা
ইরানের মিসাইল হামলায় ধ্বংস হওয়া ইসরায়েলের স্থাপনা

মতামত

আধুনিক যুদ্ধের জন্য বাংলাদেশ কতটুকু প্রস্তুত?

যুদ্ধের ইতিহাসে দেখা যায়, কিছু বিশেষ অস্ত্রের আবির্ভাব যুদ্ধ পরিচালনার পদ্ধতি পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে। আবার কখনো কখনো কোনো বিশেষ অস্ত্র ব্যবহারের পরিবর্তে কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেই যুদ্ধের রূপ বদলে গেছে। তবে আজ আমরা শুধু মারণাস্ত্রের বিবর্তন নিয়েই কথা বলব।

ইতিহাসের শুরু থেকেই অস্ত্রকে দুইভাবে ভাগ করা যায়—ডাইরেক্ট (প্রত্যক্ষ) ও ইনডাইরেক্ট (পরোক্ষ)। যেসব অস্ত্র কাছ থেকে শত্রুকে হত্যা করতে ব্যবহৃত হয় সেগুলো ডাইরেক্ট, যেমন তলোয়ার, বর্শা, হালকা তির-ধনুক। আর যেসব অস্ত্র দূর থেকে আক্রমণ চালাতে সক্ষম, যেমন ক্যাটাপুল্ট, তা ইনডাইরেক্ট অস্ত্র। এসব অস্ত্রের উন্নতি ঘটেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে।

প্রাচীনকালে ঢাল-তলোয়ারই ছিল প্রধান অস্ত্র। ছোটবেলায় ইতিহাস বইয়ে আমরা ঈশা খাঁ ও মানসিংহের মল্লযুদ্ধের ছবি দেখতাম। ঈশা খাঁর তলোয়ার ছিল সোজা, আর মানসিংহের তলোয়ার ছিল বাঁকা।

আমরা বলতাম, ওটা বাঁকা ছিল তাই বুঝি ভেঙে গেছে! আসলে না। ঘোড়সওয়ার যোদ্ধাদের ব্যবহারের জন্য বাঁকা তলোয়ারই বেশি কার্যকর, যা কাটিং বা স্লাইসিংয়ের জন্য উপযোগী। আর পদাতিক সৈন্যরা ব্যবহার করতেন সোজা তলোয়ার, যেটা স্ট্যাবিংয়ের জন্য আদর্শ।

বারুদের আবিষ্কারের পর সেই ঢাল-তলোয়ারের জায়গা দখল করে নেয় পিস্তল, রাইফেল, সাবমেশিন গান। তবে তলোয়ারের ব্যবহার পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়নি; বরং বেয়নেট হিসেবে এখনো আধুনিক অ্যাসল্ট রাইফেলের মাথায় স্থান পায়।

ব্যক্তিগত সুরক্ষায় ব্যবহৃত হতো ঢাল, যার বিবর্তিত রূপ আমরা দেখি ইউরোপীয় নাইটদের বর্মে। তাঁরা আপাদমস্তক ধাতব বর্মে আবৃত থাকতেন, এমনকি ঘোড়ার দেহেও থাকত বর্ম। মধ্যযুগে এ ধরনের নাইটরাই রাজাদের প্রধান বাহিনী ছিলেন। আজও ইংল্যান্ডে সম্মানজনক ‘নাইট’ উপাধি প্রদান করা হয়, যার ফলে ওই ব্যক্তি ‘স্যার’ উপাধি লাভ করেন।

ইতিহাসে ‘ইংলিশ লং বো’ অন্যতম বিখ্যাত অস্ত্র। ১৩৪৬ সালে ইংরেজরা এই শক্তিশালী ধনুক ব্যবহার করে সংখ্যায় বেশি ফরাসি নাইট বাহিনীকে পরাজিত করে। এই ধনুক থেকে ছোড়া তির ৩০০ থেকে ৪০০ মিটার দূরত্ব থেকেও নাইটদের বর্ম ভেদ করতে সক্ষম ছিল।

আমরা একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হই সব সময়। প্রশ্নটি হলো, ভারত আক্রমণ করলে তোমরা কয় দিন টিকবে? তাদের আমি বলতে চাই, মাইক টাইসনের সঙ্গে বক্সিং খেলতে গেলে আপনার আমার কী হবে? তাই বলে আমি কি একটিও ঘুষি মারব না, পালিয়ে যাব?

তারও অনেক আগে মোঙ্গল ঘোড়সওয়াররা চলন্ত ঘোড়া থেকে তির ছুড়ে অসাধারণ দক্ষতায় শত্রুকে ঘায়েল করতেন। এই শক্তির ওপর নির্ভর করে তাঁরা অল্প সময়ে বিশাল এক সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন।

তৎকালীন রাজারা গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত এলাকায় বিশাল দুর্গ নির্মাণ করতেন। ২০-৩০ ফুট উঁচু পাথরের প্রাচীরঘেরা এসব দুর্গে বসবাস করতেন সাধারণ মানুষ ও সৈন্যরা এবং মজুত থাকত প্রচুর খাদ্যসামগ্রী ও অন্যান্য সরবরাহ। দুর্গের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অনেক অনেক সুদৃঢ়, তিরন্দাজরা আড়াল থেকে তির ছুড়তেন, দেয়াল টপকাতে গেলে ওপর থেকে তরল দাহ্য পদার্থে আগুন দিয়ে ঢেলে দিতেন। প্রায় সব দুর্গই গভীর পরিখা দিয়ে ঘেরা থাকত এবং পরিখা গভীর জলে পূর্ণ থাকত।

এসব দুর্গ ভাঙা অত্যন্ত কঠিন কাজ। প্রায়ই অবরোধকারীরা হাল ছেড়ে দিয়ে চলে যেত। আবার অনেকে হাল ছেড়ে না দিয়ে লেগে থাকত। দুর্গ ভাঙার জন্য কাঠের তৈরি ক্যাটাপুল্ট ব্যবহার করা হতো, যা দিয়ে ছোড়া হতো বড় পাথর ও আগুনের গোলা। এমনকি মোঙ্গলরা একবার প্লেগে মারা যাওয়া দেহ ছুড়ে দিয়েছিল ক্রিমিয়ার কাফফা দুর্গে, যাতে ভেতরে মহামারি ছড়িয়ে পড়ে।

এর মধ্যেই আবিষ্কৃত হয় বারুদ-গানপাউডার। এর ফলে কামান দিয়ে দুর্গ গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে। বাবর সেই কামান দিয়েই ইব্রাহিম লোদির বিশাল সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন। তুর্কিরা বাইজাইন্টাইনদের কাছ থেকে বর্তমানে ইস্তাম্বুল দুর্গ দখল করে নেয়।

এরপর গাদা বন্দুক, রাইফেল এবং পরে মেশিনগান আবিষ্কারের মাধ্যমে মধ্যযুগীয় যুদ্ধের ধারা থেকে একেবারে বদলে যায়। দক্ষিণ আফ্রিকার ১৯০২ সালের বোয়ার যুদ্ধ এবং ১৯০৪ সালের পোর্ট আর্থার যুদ্ধে মেশিনগানের বিধ্বংসী প্রভাব লক্ষ করা যায়।

আর্টিলারিরও ব্যাপক উন্নতি ঘটে। কামানের গোলা ছোড়ার দূরত্ব ও ধ্বংসক্ষমতা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এ কারণে যুদ্ধের ধরন পাল্টে গিয়ে আসে লিবিয়ার ডিফেন্স বা লাইন প্রতিরক্ষা কৌশল। ১৯১৪-১৮ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মাত্র কয়েক শ গজ জমির জন্য লাখ লাখ সৈন্য প্রাণ হারান। মেশিনগান, কাঁটাতার এবং পরিখাব্যবস্থায় পদাতিক সৈন্যরা প্রায় সময়ে আটকে যেতেন এবং দলে দলে মারা যেতেন, অগ্রসর হতে পারতেন না।

এই পরিস্থিতিতে প্রয়োজন দেখা দেয় একটি নতুন অস্ত্রের। হয় ট্যাংকের জন্ম। ১৯১৬ সালে সোমের যুদ্ধে প্রথমবার ট্যাংকের ব্যবহার করা হয়। এর থেকেই জন্ম নেয় ম্যানুভার ও ব্লিটজক্রিগ বা বিদ্যুৎগতির যুদ্ধকৌশল। জার্মানির সেনারা এই কৌশল প্রয়োগ করে দ্রুত দখল করে নেন পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, ফ্রান্সসহ পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ অঞ্চল।

একই সঙ্গে যুদ্ধবিমানেরও দ্রুত উন্নয়ন ঘটে। আবিষ্কৃত হয় রাডার এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে জার্মানরা তৈরি করে ভি-২ মিসাইল ও জেট যুদ্ধবিমান, যার কিছু বাস্তব ব্যবহারও ঘটে। যদিও জার্মানির শেষ রক্ষা হয়নি, তবু এসব প্রযুক্তি ভবিষ্যতের যুদ্ধের রূপ নির্ধারণ করে দেয়।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র আবিষ্কার করে পারমাণবিক বোমা, যা প্রয়োগ করে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে। এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধের ইতিহাসে শুরু হয় এক ভয়ংকর নতুন অধ্যায়—নিউক্লিয়ার যুগ।

বর্তমান যুগে যুদ্ধাস্ত্রে ছোঁয়া লেগেছে আধুনিক উচ্চ প্রযুক্তির।

বর্তমান যুগে যুদ্ধাস্ত্রে ছোঁয়া লেগেছে আধুনিক উচ্চ প্রযুক্তির। রাডার ফাঁকি দেওয়া যুদ্ধবিমান। শব্দের গতির চেয়ে ১০–১২ গুণ গতির হাইপারসনিক মিসাইল। স্যাটেলাইট প্রযুক্তির নেভিগেশন নিখুঁতভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে ক্ষেপণাস্ত্র, বোমা। এসেছে ড্রোন প্রযুক্তি। আগে যা খেলনা হিসেবে পরিগণিত হতো, তাই হয়ে উঠেছে ভয়ংকর মারণাস্ত্র। বিশ্বের সেরা ট্যাংক আব্রাম, লেপার্ড ট্যাংকও ধ্বংস করে দিচ্ছে এই ড্রোন।

আজকালের যুদ্ধবিমান নিজের দেশের সীমানা থেকেই শত্রুর বিমান ভূপাতিত করে দিতে পারে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া পাক-ভারত সংঘর্ষে তা–ই দেখা গেল। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩৭ ঘণ্টা, মিসৌরি থেকে উড়ে এসে বি-২ বোমারু বিমান বোমা ফেলে গেল ইরানে। সেই বিমান রাডারে দেখা যায় না। ইরানের মতো শক্তিশালী দেশ তেমন কিছুই করতে পারেনি, তবে তারা শত্রুর বিমান ঠেকাতে না পারলেও মিসাইলের আঘাতে জর্জরিত করেছে তেল আবিব, হাইফাসহ ইসরায়েলের বিভিন্ন সামরিক ও কৌশলগত লক্ষ্যবস্তু।

বিশ্ব অবাক হয়ে দেখেছে তাদের মিসাইল ও ড্রোনের কার্যকারিতা। তাদের ব্যালিস্টিক মিসাইল ও ড্রোন বিশ্বখ্যাত আয়রন ডোম, ডেভিড স্লিংকে পরাজিত করে আঘাত হেনেছে ইসরায়েলের প্রাণকেন্দ্রে। ইসরায়েল স্বীকার না করলেও ইরানের আঘাতে যে প্রভূত ক্ষতি হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। লক্ষাধিক ইসরায়েলি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন, তাঁদের ফিরিয়ে আনতে নেতানিয়াহু সরকার বিবিধ চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু যে বিশ্বাসে তাঁরা ইসরায়েলে বসতি স্থাপন করেছিলেন, সেই বিশ্বাস ভেঙে গেছে। ইসরায়েলের আয়রন ডোম, ডেভিড স্লিং যে তাঁদের সুরক্ষা দিতে অক্ষম, তা তাঁরা বুঝতে পেরেছেন। তাই অদূরভবিষ্যতে তাঁরা ফিরে আসবেন না, এ বিষয়ে নিশ্চিত বলা যায়।

তাই তাঁরা তড়িঘড়ি করে যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়েছে। এই যুদ্ধ থেকে আমাদের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো কী?

বিবর্তিত আধুনিক যুদ্ধের জন্য আমরা কতটুকু প্রস্তুত? আমাদের মতো গরিব দেশে আয়রন ডোম করার সামর্থ্য নেই বটে, কিন্তু তাই বলে আমরা কি শুয়ে–বসে থাকব? আমাদের বিশাল জনগণ আছে, তাদের কীভাবে কাজে লাগানো যায়। কয়েক দশক ধরে বিশ্ববাণিজ্য থেকে বয়কট করা ইরান যদি নিজের প্রচেষ্টায় ড্রোন ও মিসাইল শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে, আমরা কেন পারব না? সময় এসেছে আমাদের প্রতিরক্ষা নিয়ে বিশদ পরিকল্পনার।

যথাসময়ে ব্যবস্থা না নিলে আমরা দিন দিন পিছে পড়ে যাব, তখন আর কিছুই করার থাকবে না। আমাদের পার্শ্ববর্তী সুবিশাল দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাদের হারানো সম্ভব নয়। তবে আমাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা যদি শক্ত হয়, তবে শত্রু আমাদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে চাইবে না।

কারণ, আমাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তাদের এমন ক্ষতি করতে সক্ষম হবে যে তার মূল্য যুদ্ধের কারণের চেয়ে অনেক বেশি হবে। এটিকে বলা হয়, ‘ডেটেরেন্স’, যার বাংলা অর্থ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বা যুদ্ধে নিরুৎসাহিত করা। আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুতিকে অনেকে ভুল বুঝতে পারেন। একটা উদাহরণ আমি প্রায়ই ব্যবহার করি, যেমন জুডো, কারাতে বা কুংফুতে পারদর্শী হয় তাকে যে কেউ ঘাঁটাতে সাহস পাবে না। ব্যাপারটা ঠিক সেই রকম। কিন্তু কেউ যদি দুর্বল হয়, তাকে যে কেউ যেকোনো সময় চড়থাপ্পড় মেরে চলে যাবে।

আমরা একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হই সব সময়। প্রশ্নটি হলো, ভারত আক্রমণ করলে তোমরা কয় দিন টিকবে? তাদের আমি বলতে চাই, মাইক টাইসনের সঙ্গে বক্সিং খেলতে গেলে আপনার আমার কী হবে? তাই বলে আমি কি একটিও ঘুষি মারব না, পালিয়ে যাব?

বাংলাদেশের দরকার পরিকল্পিত প্রতিরক্ষার জন্য ন্যূনতম প্রস্তুতি, যাতে যেকোনো হানাদার দুবার চিন্তা করতে বাধ্য হয়।

তুষারকান্তি চাকমা অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা

(মতামত লেখকের নিজস্ব)