কমালা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্প
কমালা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্প

মতামত

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আগেই শুরু হয়ে গেছে, কমলা-ট্রাম্প কেউই সেটা দেখছেন না

১৯৪০ সালের অক্টোবর মাসে আমেরিকানরা যখন তাদের প্রেসিডেন্ট মনোনীত করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, সে সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। সে সময় জার্মান সেনারা প্যারিস দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র তখনো জড়ায়নি। সেই অশুভ মুহূর্তে আমেরিকানরা অবশ্য যোগ্য ব্যক্তিকেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।

ডেমোক্র্যাটদের প্রার্থী ছিলেন দুইবারের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট। আগ্রাসী জাতিগুলোর উদ্দেশে ১৯৩৭ সালে রুজভেল্ট তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করেছিলেন। বলা চলে, একটা বিচ্ছিন্ন জাতিকে বৈশ্বিক সংঘাতে যুক্ত হতে তিনি বড় একটা ধাক্কা দিয়েছিলেন।
অন্যদিকে রিপাবলিক প্রার্থী উইনডেল উইলকি ছিলেন ব্যবসায়ী। রাজনীতিতে তিনি ছিলেন একেবারে নবাগত।

আমরা যদি পেছনের দিকে ফিরে তাকাই, তাহলে এটা স্পষ্ট যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান, জার্মানি ও ইতালি—সম্মিলিত অক্ষশক্তি একের পর এক যেসব সংকটের জন্ম দিয়েছিল, তার শুরুটা হয়েছিল ১৯৩১ সালে জাপানের মাঞ্চুরিয়া দখলের মধ্য দিয়ে।

উত্তর প্রজন্ম এখন এই উপসংহারে পৌঁছাতে পারে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে রাশিয়া আগ্রাসন শুরুর দিন থেকে নয়, বরং ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের মধ্য দিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রে নতুন যে প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব শুরু করবেন, তাঁকে নিশ্চিত করেই বর্তমান সময়ের অক্ষশক্তি—চীন, রাশিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়াকে মোকাবিলা করতে হবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র অংশগ্রহণের শুরুটা ছিল আক্রমণাত্মক। উত্তর আটলান্টিকের জাহাজ চলাচলের পথে (ব্রিটেন যার ওপর নির্ভরশীল ছিল) নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ টহলের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল।

আর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ শুরু হয়েছে গত সপ্তাহে ইসরায়েলকে অগ্রসর প্রযুক্তির মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দেওয়ার ও সেটা পরিচালনার জন্য ১০০ সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে।

১ অক্টোবর ইরান প্রতিশোধমূলক হামলার অংশ হিসেবে ইসরায়েলে ২০০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলকে রক্ষা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র তাদের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধব্যবস্থাটি দিচ্ছে।

ইসরায়েল ও ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্র গোয়েন্দা তথ্য ও অস্ত্র সরবরাহ করছে। তার কারণ হলো, ১৯৪০ সালের ব্রিটেনের মতো এসব দেশ তাদের অস্তিত্ব ও আমাদের সভ্যতা রক্ষার জন্য লড়ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় এ বিষয়কে বেপরোয়াভাবে উপেক্ষা করা হচ্ছে। বিশ্বের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ নিয়ে কোনো প্রার্থীর মধ্যে গভীর চিন্তা তো দূরে থাক, ন্যূনতম সচেতনতারও কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

গত সোমবার দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমস–এর প্রতিবেদনে জানিয়েছে, জার্মানির অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জানিয়েছেন, এ বছর লাইপজিগের একটি মালবাহী গুদাম থেকে বিমানে মালামাল নেওয়ার সময় একটি পার্সেল বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ধরে যায়। ওই কর্মকর্তা বলেন, পার্সেলটি বিমানে ওঠানোর পর যদি আগুন ধরে যেত, তাহলে বিমানটি বিধ্বস্ত হতে পারত।

রাশিয়ান এজেন্টদের আগ্রাসী কর্মকাণ্ড নাটকীয়ভাবে বেড়েছে, সেই বর্ণনা দিতে গিয়ে ওই কর্মকর্তা এ বিষয়ের উত্থাপন করেন।

দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল–এর এক খবর জানিয়েছে, ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা এমআই-৫ এর প্রধান বলেছেন, ইউরোপে রাশিয়ার সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা জিআরইউ পরিচালিত হামলা ‘বিস্ময়করভাবে বেড়েছে’। অস্ত্র উৎপাদন ব্যাহত করা, রাজনীতিবিদদের ভয় দেখানো ও রাস্তায় আতঙ্ক তৈরির মতো কর্মকাণ্ডে তারা জড়িত।
এমআই-৫ এর প্রধান আরও বলেন, লক্ষ্যবস্তু বানানো দেশগুলোয় রাশিয়া ও ইরান অগ্নি–হামলা, অন্তর্ঘাত ও ভিন্নমতাবলম্বীদের আক্রমণের কাজে ভাড়াটে অপরাধীদের ব্যবহার করা হচ্ছে। ইরানের বিরোধী দলকে সমর্থন করেন স্পেনের এমন এক রাজনীতিবিদকে গত বছর প্রকাশ্যে গুলি করা হয়।

উত্তর কোরিয়ার সামরিক প্রকৌশলীরা ইউক্রেনের লক্ষ্যবস্তুতে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কাজে রাশিয়ানদের সাহায্য করছেন। এ মাসে রাশিয়ার ভেতর ইউক্রেনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় উত্তর কোরিয়ার এক নাগরিক নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। রাশিয়াকে ক্ষেপণাস্ত্র ও দূর পাল্লার অস্ত্রের গোলাবারুদ দিয়ে সাহায্য করছে উত্তর কোরিয়া।

রাশিয়ার পশ্চিম সীমান্তের দেশ চীন খুব আগ্রাসীভাবে সমুদ্রসীমায় ফিলিপাইনের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে চলছে। বর্তমানে বিশ্বের ২৪টি সময়-অঞ্চলের মধ্যে ৬টিতে যুদ্ধ চলছে অথবা যুদ্ধ বেধে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। একটা বিশ্বযুদ্ধের ‘পুঞ্জীভূত ঝড়’ (উইনস্টন চার্চিলের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে লেখা ছয় খণ্ডের প্রথম খণ্ডের শিরোনাম) দেখতে এমনই হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় এ বিষয়কে বেপরোয়াভাবে উপেক্ষা করা হচ্ছে। বিশ্বের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ নিয়ে কোনো প্রার্থীর মধ্যে গভীর চিন্তা তো দূরে থাক, ন্যূনতম সচেতনতারও কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

  • জর্জ এফ উইল আমেরিকান লেখক ও বিশ্লেষক, ১৯৭৭ সালে পুলিৎজার পুরস্কার পান
    দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত