পেনসিলভানিয়ায় নির্বাচনী জনসভায় গুলি ট্রাম্পের কানে আঘাত করে বেরিয়ে যায়
পেনসিলভানিয়ায় নির্বাচনী জনসভায় গুলি ট্রাম্পের কানে আঘাত করে বেরিয়ে যায়

মতামত

একটি গুলি আমেরিকাকে কি বদলে দিতে পারবে

১৯৮১ সালের ৩০ মার্চ। আমি আমার থেরাপিস্টের অফিসে বসে আছি। একটু বাদেই আমার শরীরে থেরাপি দেওয়া হবে। আচমকা আমার নিরাপত্তায় নিয়োজিত সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টদের একজন হুড়মুড় করে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন।

প্রথমে আমি খুবই রেগে গেলাম। আমি ভাবলাম, ‘লোকটা আর সময় পেল না! আমার থেরাপি সেশনে ফট করে ঢুকে পড়ল?’ কিন্তু পরক্ষণেই দেখলাম, ঘরে ঢুকে পড়া অফিসারটির মুখটা কেমন ফ্যাকাশে। তিনি বললেন, ‘প্যাটি, একটা শুটিং (গুলিবর্ষণ) হয়েছে।’

দিনটি ছিল আমার জীবনের দীর্ঘতম দিনগুলোর একটি। আমার বাবা (প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান) বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন, তা আমি জানতে পারছিলাম না। পরে আমি শুনেছিলাম, যে চিকিৎসকেরা আমার অচেতন বাবার বুকে বুলেটের টুকরো খুঁজছিলেন, আমার মতো তাঁরাও প্রথমে বুঝতে পারছিলেন না, তিনি বেঁচে আছেন কিনা।

আমার বাবা গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর যে আমেরিকা দল মতের ঊর্ধ্বে উঠে আমার পরিবারকে প্রবল স্নেহের চাদরে ঢেকে দিয়েছিল, আমি সেই আমেরিকার জন্য দীর্ঘদিন ধরে প্রতীক্ষা করে আছি। আমি প্রার্থনা করি যেন সর্বশেষ এই ঘটনায় আমরা আবার নিজেদের মধ্যে সেই আমেরিকাকে খুঁজে পেতে পারি।

একটি আর্মি পরিবহন বিমান বাবাকে নিয়ে দীর্ঘ ফ্লাইট শেষে ভোর হওয়ার ঘণ্টা কয়েক আগে ওয়াশিংটন ডিসিতে পৌঁছাল। আমার মা আমার বাবার একটি জামা তাঁর মুখের ওপর চেপে ধরে বাবার শরীরের ঘ্রাণ নিশ্বাসের সঙ্গে টেনে নিতে নিতে হাসপাতালে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।

বাবাকে যখন হাসপাতালের বিছানায় আনা হলো তখন তাঁর চেহারা ছিল ফ্যাকাশে। তাঁর চোখ খোলা ছিল। কিন্তু মনে হচ্ছিল তাঁর সেই চোখের দৃষ্টি ছিল বহু দূরে।

পরের দিনগুলোতে গোটা দেশ যেন হতবাক অবস্থায় ঝিম মেরে ছিল। লোকেরা তখন আমার কাছে মৃদুভাবে আসছিল। তাঁরা সবাই কেমন যেন মমতা ঝরা কণ্ঠে আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন। অন্তত কিছু সময়ের জন্য রাজনীতি যেন একেবারে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছিল।

পেনসিলভানিয়ায় যে মুহূর্তে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমাবেশে গুলি চালানো হয়, সে মুহুর্তে ট্রাম্পের পরিবারের সদস্যরা কে কোথায় ছিলেন, তা আমার জানা নেই। তবে এই খবর শোনার পর তাঁরা কী প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছে, সেটি আমি অন্তত খুব ভালো করে বুঝতে পারছি।

একজন প্রেসিডেন্ট বা প্রেসিডেন্ট প্রার্থী, তাঁর পরামর্শকেরা, নিরাপত্তাকর্মীরাসহ তাঁর চারপাশের লোকজন সবাই রক্তমাংসের মানুষ। তাঁরা আমাদের বাকিদের মতোই মানুষ। এবং এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে তাঁদের জীবনের সবকিছু ওলট পালট হয়ে যেতে পারে। সবকিছু লন্ড ভণ্ড করে দেওয়ার জন্য একটি মাত্র বুলেটই যথেষ্ট।

১৯৮১ সালের তুলনায় আমেরিকা এখন অনেক বেশি ক্ষুব্ধ এবং অনেক বেশি হিংস্র। আমি জানি না এই ঘটনাটি সেই সহিংসতা ও ক্ষোভকে কিছুটা কমিয়ে আনবে কিনা। আমি জানি না ট্রাম্প পরিবারেরও আমার মতো একই অভিজ্ঞতা হবে কি না। অর্থাৎ কিছু সময়ের জন্য হলেও রাজনীতিকে একপাশে রেখে সব শ্রেণির মানুষ মানবিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে ট্রাম্প পরিবারের পাশে দাঁড়াবে কিনা।

আমিও এটিও জানি না এই অভিজ্ঞতা ট্রাম্পকে বদলে দেবে কিনা; যদি দেয়, সেটি কীভাবে দেবে তাও আমি জানি না।

আমার বাবা বিশ্বাস করতেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে শীতল যুদ্ধের অবসান ঘটানোর এবং পারমাণবিক অস্ত্রের বিষয়ে একধরনের চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করার জন্য ঈশ্বর তাঁকে সে যাত্রায় বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন।

আমার বাবা এবং সে সময়কার সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ যা অর্জন করেছিলেন তা যদি অর্জিত না হতো তাহলে হয়তো তাঁকে গুলি করা হতো না।

এই ধরনের ঘটনাকে একজন মানুষ হিসাবে আপনার নাজুক দিকের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার স্মারক বলা যেতে পারে। হয়তো এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আপনাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, সময় অতি মূল্যবান এবং সময়ের এই উপহারটির সবচেয়ে অর্থপূর্ণ ব্যবহার আপনার জন্য অপরিহার্য।

তবে এই ধরনের ঘটনাকে কোন ব্যক্তি কীভাবে উপলব্ধিতে এনে ব্যাখ্যা করবে তা অনুমান করা অসম্ভব।

প্রিয়জনের গুলিবিদ্ধ হওয়ার মতো ঘটনা আপনাকে বদলে দেবে, সেই প্রিয়জন বিখ্যাত হোক বা না হোক। এই ধরনের ঘটনা আপনাকে প্রথম একটি ভয়ানক ও বিশৃঙ্খল মুহূর্তের মুখে ফেলে দেয় এবং এটি আপনাকে পরবর্তী দিন, মাস ও বছরগুলোতে নতুন নতুন উপলব্ধির মধ্য দিয়ে যেতে সহায়তা করে।

শনিবারের ঘটনাটি আমাদের দেশকেও বদলে দিতে সহায়তা করতে পারে। রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে মানুষ হিসেবে আমাদের কীভাবে একত্রিত হতে হবে তা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। সেই মানুষ মানে ক্রোধে ছটফট করা এবং অস্ত্রের ঝনঝনানি করা মানুষ নয়; যাঁরা বন্দুক দিয়ে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে, সেই ধরনের মানুষ নয়।

আমার বাবা গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর যে আমেরিকা দল মতের ঊর্ধ্বে উঠে আমার পরিবারকে প্রবল স্নেহের চাদরে ঢেকে দিয়েছিল, আমি সেই আমেরিকার জন্য দীর্ঘদিন ধরে প্রতীক্ষা করে আছি। আমি প্রার্থনা করি যেন সর্বশেষ এই ঘটনায় আমরা আবার নিজেদের মধ্যে সেই আমেরিকাকে খুঁজে পেতে পারি।

নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • প্যাটি ডেভিস মার্কিন অভিনেত্রী ও লেখক। তিনি প্রয়াত মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান ও অভিনেত্রী ন্যান্সি রিগ্যানের কন্যা।