হরতালের দিন কাজে যাওয়ার পথে বিশ্বজিৎ নামের এক তরুণ পেশাজীবীকে প্রকাশ্যে হত্যা করল হরতাল প্রতিহতকারী ছাত্রলীগের কিছু তরুণ। তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, গরিব মানুষের করের টাকায় লেখাপড়া করে। সেই বয়সে বিশ্বজিতেরও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জীবিকার দায় তাকে ঠেলে দিয়েছিল দরজিগিরির জীবনে। এই ধারার সমাজবাস্তবতার সঙ্গে আমরা বহু প্রজন্ম ধরে পরিচিত। বহু অসচ্ছল পরিবারেরই গল্প এটি: হাঁপিয়ে ওঠা বাবার রোজগারের ঘানি ঘাড়ে নিতে গিয়ে এক ভাইয়ের তারুণ্যের অভিলাষ শেষ হয়, পরিণামে অন্যান্য ভাই বা বোনের তারুণ্য ধনধান্য-শিক্ষায়-পুষ্পে ভরে ওঠে। মুশকিল হলো, এই গল্পটিকে আমরা কেবল পরিবারের গণ্ডিতেই ভেবে এসেছি। কিন্তু এটা তো অসচ্ছল একটি জাতিরও গল্প। বিশ্বজিৎরা সেই অসমর্থ জাতির কলুর বলদই তো হতে গিয়েছিল, যাদের তারুণ্যের মূল্যে আমাদের দুর্বৃত্ত রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরেই তৈরি করছে বিশ্বজিতের খুনিদের। এই খুনের উপত্যকায় তবু জিডিপি বাড়ে। পোশাক কারখানায় আগুনে পুড়ে শত শত তরুণ-তরুণী নিমেষে কয়লা হয়ে যায়, তবু জিডিপি বাড়ে! এই নগদ লাভের অরণ্যে ‘সামান্য’ কয়েকটি মরদেহ নিয়ে উচ্চবাচ্য করাও ‘নাশকতা’! গলাকাটা ভিসায় বিদেশে আমাদের দুর্মর ভাইবোনেরা ক্রীতদাসের জীবন কাটাতে যায়, তারা তাদের জীবন নিংড়ে রেমিট্যান্স পাঠায়। ফাঁকে ফাঁকে কফিনে তাদের মরদেহ আসে। কিন্তু রেমিট্যান্সের রেকর্ড ভাঙা পরিসংখ্যানে সেসব মরদেহ ‘স্ট্যান্ডার্ড এরর’ মাত্র! আমরা ভেবেও দেখি না, এই মৃত্যুর উপত্যকায় জিডিপি এত অপ্রতিরোধ্য কেন, কেনই বা রেমিট্যান্সের এত রেকর্ড ভাঙা পরিসংখ্যান?জবাব কিন্তু একটাই: তারুণ্য। যে জাতির অর্ধেক জনগোষ্ঠীর বয়স ২৫ পেরোয়নি, যার ৯০ শতাংশ মানুষের বয়স ৬০-এর নিচে, সেই জাতির গল্প এটি। এই তারুণ্যকে আমরা পুষ্টি দিতে পারিনি, প্রশিক্ষিত করতে পারিনি, এমনকি কর্মসংস্থানেরও কোনো সোজাসাপ্টা পথ তার সামনে মেলে ধরতে পারিনি। তার শৈশবের স্বপ্নগুলো ফিকে হয়ে গেছে গরিবির নির্মম আগ্রাসনে, অথচ সেই তারুণ্য কোনো প্রতিশোধের সংকল্প নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েনি অসমর্থ রাষ্ট্রের ঘাড়ে। বেকার ভাতা চায়নি, ব্যাংক লুট করেনি; বরং তার শ্রমের মূল্যে সেই অসামর্থ্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শামিল হয়েছে। এই অপ্রস্তুত, আগুনে-হরতালে আর দাসের জীবনে নিঃশেষ হতে থাকা সংকল্পবদ্ধ তরুণ শ্রমশক্তিই আমাদের জিডিপি ও রেমিট্যান্স। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনা আর বেপরোয়া মুনাফা লোভের জাঁতাকলে রুগ্ণ হতে থাকা এই তারুণ্যই আমাদের আশার ও মর্যাদার জায়গা।অথচ তার কী নিদারুণ অপচয়! যাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা নির্বিঘ্ন করার জন্য বিশ্বজিতের মতো তরুণদের দরজির কল ঘোরানো শুরু করতে হয়েছে, সেই সুবিধাভোগী তারুণ্য তার চাপাতিবিদ্যা দেখানোর জন্য বেছে নিয়েছে বিশ্বজিতেরই বুক। এই পাশবিকতার শিক্ষা তারা নিয়েছে পচে যাওয়া রাজনীতি থেকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসর তাদের অভয়ারণ্য। তারা এই কল্পনাময় জীবনে কৃমিদের সর্দার হওয়ার খোয়াব দেখে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকে বটে, কিন্তু বইপুস্তকের জীবন তাদের নয়। চাপাতিবিদ্যা আর খুনই তাদের উচ্চ নম্বরের সিঁড়ি!সতর্ক ছিল গণমাধ্যম, তাই খুনিদের শনাক্ত করা গেছে। আশা করা যায়, তাদের সবাইকেই আইনের আওতায় আনা হবে। বিশ্বজিতের খুন আমাদের মর্মে লেগেছে, তার ভাই কিংবা বাবা-মায়ের দুঃখও আমাদের সমব্যথী করেছে, সন্দেহ নেই। এই ধরা পড়তে থাকা খুনিদের ব্যাপারে আমাদের হূদয়ে কোনো করুণার উদ্রেক হবে না। হওয়ার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু ভেবে দেখুন, এই খুনিগুলো সেই সুবিধাভোগী তারুণ্যের অংশ, যাদের পশ্চাৎপটে সেই অসচ্ছলতা আর ত্যাগের গল্পই রয়েছে। তাদের জন্যই তারুণ্যের রঙিন স্বপ্নগুলো খোয়াতে হয়েছে তাদের পরিবারের অন্য তরুণদের, বিশ্বজিৎ তো তাদেরই একজন।ফলে, পারিবারিক পরিপ্রেক্ষিতে এই গল্পের চেহারা ভিন্ন রকম। কার পরিবার বেশি হতভাগ্য, বিশ্বজিতের, না তার খুনিদের? যে পরিবারগুলো তৈরি হয়েছে নৈতিক অনুশাসনে, বেড়ে উঠেছে সামাজিক চোখরাঙানির মধ্যে, এমন একটি অপরাধের ভার সে কেমন করে বইবে? এসব দুর্বিপাক সামাল দেওয়ার মতো পোক্ত নিরাপত্তাবেষ্টনী সেসব পরিবারে নেই। ফলে তাদের যা কিছু দুঃখ, যা কিছু অহম, সব নিয়ে তারা নিরাভরণ হয়ে পড়েছে জনমানুষের সম্মিলিত ঘৃণার সামনে। যার ফলে খুনিদের একজনের বাবাকে মরে যেতে হলো, যাকে আমরা আত্মাহুতিই বলতে পারি প্রকারান্তরে। অন্যরা সন্তানদের বিপক্ষে দাঁড়িয়েই খুনের বিচার চাইলেন। এভাবে তাঁরা তাঁদের ওপর ঝুলতে থাকা সামাজিক ও আইনি ভ্রুকুটিকে মোকাবিলা করতে চাইলেন ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নৈতিকতার জায়গায় দাঁড়িয়ে, যদিও এই সংগ্রামে তাঁদের কোনো সমব্যথী নেই, সহযোদ্ধা নেই। বিশ্বজিতের এই নৃশংস খুন আমাদের পরাজিত করেছে। খুনিরা যদি আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়, আমরা আবারও পরাজিত হব। তাদের প্রাপ্য শাস্তি নিশ্চিত হলে ন্যায়বিচার হবে, স্বস্তি আসবে জনমনে, কিন্তু বিজয় হবে না কারও। এ এমন এক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা, যার সঙ্গে জড়িত সব পক্ষই পরাজিত। যে খুন হলো, যারা খুন করল, নিহত ব্যক্তির পরিবার, খুনিদের পরিবার, এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দর্শক, সবাই এই পরাজয়ের অংশীদার।শুধু জিতল হিংসা আর হানাহানির রাজনীতি। তারুণ্যের রক্ত ছাড়া আর কিছুই এই ড্রাগনের মুখে রোচে না। রাষ্ট্র যেখানে তার সিংহভাগ নাগরিকের জন্য গরিবি ছাড়া কিছুই বরাদ্দ করে না, সেই গরিবি হটানোর জন্য ব্যক্তি পর্যায়ে, পারিবারিক পর্যায়ে আমাদের যে দীর্ঘ দীর্ণ লড়াই, তার সামান্য ফসলটুকুকেও এভাবে কেটে নিয়ে যায় বর্গী রাজনীতি। শেষমেশ খুন আর খুনির গল্প নয় এটা, নয় নিছক অপরাধ ও শাস্তি প্রদানের কাহিনি, এটা আমাদের অসচ্ছল আর দুঃখী পরিবারগুলোর মর্মান্তিকভাবে পরাজিত হওয়ার গল্পও। তাদের নীরব ত্যাগ আর দুর্মর সংগ্রামের মুখে থুতু ছিটানোর গল্পও।এভাবেই হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও আর দমন-পীড়নের রাজনীতি আমাদের দুর্মর তারুণ্য আর তার অসচ্ছল পরিবারগুলোর জন্য বুনে রেখেছে অন্তহীন অপচয় আর নিরবচ্ছিন্ন পরাজয়ের গল্প। রাজা যায়, রাজা আসে, কিন্তু এই অবধারিত পাপচক্কর থেকে মুক্তি মেলে না অসহায় মানুষের।সুমন রহমান: কথাসাহিত্যিক।sumanৎahman@hotmail.com