একজন নাগরিক যে মত ও পথের হোক না কেন, তাঁর জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব সরকার ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর। এই দায় ভুলে গেলে তার ফলাফল যে কতটা মারাত্মক ও ভয়াবহ হতে পারে, রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের হিংসাত্মক ঘটনা তার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত। শরিয়ত পরিপন্থীভাবে দাফনের অভিযোগ তুলে দরবার শরিফে হামলা ও কবর থেকে মৃতদেহ তুলে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা শুধু গুরুতর ফৌজদারি অপরাধই নয়, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ পরিপন্থীও।
আমরা মনে করি, গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর মব সহিংসতা থেকে ভিন্নমতের নাগরিকদের সুরক্ষায় সরকার যে ধারাবাহিক ব্যর্থতা ও দুর্বলতার পরিচয় দিয়ে এসেছে, তারই বিষফল এটি। এ ধরনের সহিংসতা ও অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটির ব্যানারে আয়োজিত সমাবেশ থেকে একদল লোক নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলার দরবার শরিফে হামলা চালায়। এ সময় তারা পুলিশ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। হামলা ও সংঘর্ষে মাজারের একজন খাদেম নিহত হন, আহত হন পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ৫০ জন। উন্মত্ত জনতা এক পর্যায়ে কবর থেকে কয়েক দিন আগে মারা যাওয়া নুরাল পাগলার মরদেহ তুলে পুড়িয়ে দেয়।
এই মব সহিংসতার ছবি, ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নাগরিকদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনার জন্ম হয়। এনসিপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল বিবৃতি জানিয়ে নিন্দা জানায়। অন্তর্বর্তী সরকার এক বিবৃতিতে তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলে, ‘এই বর্বরতা কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না।’
বিবৃতির ভাষা যা-ই হোক না কেন, বাস্তবে তার প্রতিফলন কতটা ঘটছে, সেটাই সবচেয়ে বড় কথা। কেননা, এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাজার, সুফি সমাধি ও দরগাহে ধারাবাহিকভাবে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটলেও সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে নাগরিকের জীবন, সম্পদ ও কিছু ক্ষেত্রে ধর্ম পালনের স্বাধীনতা রক্ষায় জোরালো কোনো অবস্থান দেখা যায়নি।
ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের বিবৃতি শেষ পর্যন্ত মব সহিংসতা থামাতে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের তথ্যই বলছে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫-এর জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ৪০টি মাজার, সুফি সমাধি ও দরগাহে হামলা হলেও গ্রেপ্তার হয় মাত্র ২৩ জন। সহিংসতার বিপরীতে পদক্ষেপের এই চিত্র যারপরনাই হতাশাজনক।
গোয়ালন্দে মব সহিংসতা ও মরদেহে অগ্নিসংযোগের ঘটনার তিন দিন পেরিয়ে গেলেও ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ দায়ের করা হয়নি। পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুর ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে তিন হাজার জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করে মামলা করেছে। গ্রেপ্তার হয়েছে সাতজন। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি, এ ধরনের গয়রহ মামলা শেষ পর্যন্ত ন্যায়বিচারের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। আমরা মনে করি, গোয়ালন্দের মব সহিংসতার ঘটনাটি সুষ্ঠু তদন্ত করে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে দায়ী ব্যক্তিদের প্রত্যেককে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বহীনতাও এখানে সুস্পষ্ট। নুরাল পাগলার কবর নিয়ে গোয়ালন্দে কয়েক দিন ধরে উত্তেজনা চললেও সহিংসতা ঠেকাতে কার্যকর ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। তাঁদেরও জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন।
ভিন্নমতাবলম্বী বলে নাগরিকের প্রতি ঘৃণা ও সহিংসতা কোনো সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্রে গ্রহণযোগ্য নয়। যে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী এই ধরনের সহিংসতায় জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সমাজে কেউই জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নয়।