বিশেষ সাক্ষাৎকার: মজিবুর রহমান

বাণিজ্যিক ট্রানজিটে কোনো পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না

>
মজিবুর রহমান
মজিবুর রহমান
বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মজিবুর রহমান ট্রানজিট বিষয়ে ২০১১ সালে সরকার গঠিত কোর কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কমিটি থেকে একটি সমন্বিত ট্রানজিটের জন্য মাশুল আরোপের কাঠামোসহ প্রস্তাবিত মাশুল ও ট্রানজিটকে কার্যকর করার বিভিন্ন দিক সুপারিশ করা হয়েছিল। প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি ট্রানজিটের আনুষ্ঠানিক সূচনা ও এর নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন।

প্রথম আলো : ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রানজিট-সুবিধা পেল। বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ও নির্ধারিত ট্রানজিট শুল্ক দিয়ে একটি চালান ভারতের এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে গেল। ট্রানজিটের এই আনুষ্ঠানিক যাত্রাকে কীভাবে দেখছেন?
মজিবুর রহমান : ট্রানজিটের আনুষ্ঠানিক শুরুর বিষয়টি একটি শুভ সংবাদ। এই সূচনাকে আমি স্বাগত জানাই। বিষয়টি বাস্তবে
রূপ নেওয়ায় দুই দেশের সরকারকে অভিনন্দন জানাই। বাণিজ্যিক ট্রানজিট এমন একটি বিষয়, যাতে কোনো পক্ষেরই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। নৌ-ট্রানজিটের বিষয়টি আগে থেকেই ছিল। এবার একটি যথাযথ বাণিজ্যিক ট্রানজিটের সূচনা ঘটল। তবে ট্রানজিটকে
নৌ, রেল বা রোড—এভাবে আলাদা আলাদা করে না দেখে সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে। আমি মনে করি একটি কমপ্রিহেনসিভ ট্রানজিট চুক্তি করা জরুরি।
প্রথম আলো : ট্রানজিটের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কৌতূহলের বিষয় ছিল ট্রানজিট মাশুল। টনপ্রতি ১৯২ টাকা মাশুল নির্ধারণ নিয়ে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। আপনি ট্রানজিট নিয়ে একসময় সরকারের গঠিত কোর কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দেখা গেল আপনারা তখন যে ট্রানজিট মাশুল প্রস্তাব করেছিলেন, বর্তমান নির্ধারিত মাশুল এর পাঁচ ভাগের এক ভাগের মতো। এত কম মাশুল নির্ধারণের যুক্তি কী?
মজিবুর রহমান : ট্রানজিট-বিষয়ক কোর কমিটির পক্ষ থেকে আমরা যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম সে তুলনায় এই ট্রানজিট মাশুল অনেক কম। আবার ট্রানজিট মাশুল ১৯২ টাকা যাঁরা বলছেন, সেটাও আসলে ভুল। এর সঙ্গে আরও কিছু মাশুল রয়েছে, যা হিসাবে ধরা হয়নি। বর্তমানে যে মাশুল ধরা হয়েছে তা সব মিলিয়ে ৪০০ টাকার কাছাকাছি হবে। সমস্যা হচ্ছে, ট্রানজিট দেওয়ার জন্য আমরা এখনো বিনিয়োগ করিনি। ফলে শুল্ক বা মাশুল নির্ধারণের ক্ষেত্রে তা বিবেচনায় নেওয়ার সুযোগ নেই। আশুগঞ্জ বন্দরের কথা যদি ধরি, পন্টুন সেই পুরোনো অবস্থায় রয়ে গেছে। পর্যাপ্ত লোকবলসহ বন্দর-সুবিধা বলতে যা বোঝায় তার কিছুই সেখানে নেই। আমরা নদী ড্রেজিং করিনি। আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া পর্যন্ত রাস্তার অবস্থাও খুব খারাপ। ফলে ট্রানজিটের খরচ বিবেচনায় নিয়ে শুল্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে দেখা যাবে যে সামগ্রিকভাবে বর্তমানে ট্রানজিটের খরচ বা কস্ট খুবই কম।
প্রথম আলো : এই যে মাশুল নির্ধারিত হয়েছে, সেখানে ট্রানজিটের খরচ বা কস্ট বিবেচনায় নেওয়া ও ট্রানজিট মাশুল নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে?
মজিবুর রহমান : বর্তমান ট্রানজিট মাশুল কীভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে তা পরিষ্কার নয়। আমরা আমাদের প্রতিবেদনে ট্রানজিট মাশুল নির্ধারণের বিস্তারিত ও সুনির্দিষ্ট ফর্মুলা দিয়েছি। কোন খাতে আমাদের কী খরচ বা ট্রানজিটের জন্য আমাদের কী মূল্য দিতে হবে তা বিবেচনায় নিয়ে ‘কস্ট অব ট্রানজিট’ নির্ধারণ এবং সে অনুযায়ী কোন ক্ষেত্রে কত শুল্ক বা মাশুল ধরা হবে এবং কীভাবে তা ক্যালকুলেট করতে হবে—সবই সেখানে রয়েছে। আমরা ম্যাথমেটিক্যালি ব্যাপারটা দেখিয়েছি। এই পদ্ধতি মেনে শুল্ক নির্ধারণ করা হলে সেটা হবে ন্যায্য ও স্বচ্ছ। শুল্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ ধরনের পদ্ধতি মেনে চলার বিষয়টি খুবই জরুরি।
প্রথম আলো : বর্তমানে যে শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে তাতে কি এ ধরনের কোনো পদ্ধতি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি?
মজিবুর রহমান : এটা কীভাবে করা হয়েছে তা জানি না। তবে এখন যেহেতু এই খাতে কোনো বিনিয়োগ নেই ফলে শুল্ক কম হতেই পারে। আমার বক্তব্য হচ্ছে শুল্ক নির্ধারণের বিষয়টি যেন অস্থায়ী ভিত্তিতে বা থোক হিসেবে নির্ধারিত না হয়। এ ক্ষেত্রে যেহেতু একটি ফর্মুলা তৈরি আছে, সেটা বিবেচনায় নিয়ে এবং কাঠামো মেনেই শুল্ক নির্ধারণ করা উচিত। তাতে অনেক বিতর্ক কমে যাবে।
প্রথম আলো : সাধারণ মানুষ মনে করছে এই শুল্ক খুবই কম। ট্রানজিটে ভারতের অনেক সাশ্রয় হচ্ছে কিন্তু সে তুলনায় বাংলাদেশ যা পাচ্ছে তা খুবই কম।
মজিবুর রহমান : আসলে ট্রানজিট শুল্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিষয়টিকে এভাবে দেখার তেমন সুযোগ নেই। সাধারণের মধ্যে যে ধারণার কথা আপনি বললেন, ওরা অনেক লাভ করছে কিন্তু আমরা তেমন কিছু পাচ্ছি না, ব্যাপারটি এভাবে দেখা যাবে না। কস্ট অব ট্রানজিটের কথা আগেই বলেছি। আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী ট্রানজিটের শুল্ক নির্ধারণ করা হয় ‘কস্ট অব ট্রানজিট’ বিবেচনায় নিয়ে। এর ওপর সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ বাড়তি নেওয়া যেতে পারে। তবে এই বাড়তি অর্থ অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। ট্রানজিটের কারণে ভারত নিশ্চয়ই স্বল্প খরচে ও স্বল্প সময়ে তার পণ্য পরিবহন করতে পারবে। এতে ভারতের লাভ যত গুণই হোক না কেন তা ঠিক ভাগাভাগি করার সুযোগ নেই।
প্রথম আলো : ‘কস্ট অব ট্রানজিট’ নির্ধারণের ক্ষেত্রে সব দিক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে কি?
মজিবুর রহমান : ট্রানজিটের মূল্য বা কস্ট বিবেচনার বিষয়টি অনেক ব্যাপক। সাধারণভাবে এর তিনটি দিক রয়েছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশের দিক। অর্থনৈতিক কস্টের হিসাব করা সহজ। কিন্তু সোশ্যাল বা সামাজিক ও পরিবেশের কস্টের হিসাব করা খুবই কঠিন। এ ক্ষেত্রে কোয়ালিটিকে কোয়ান্টিটিতে রূপান্তর করতে হয়। ট্রানজিটের কারণে কার্বন নিঃসরণ বাড়বে, শব্দদূষণ হবে, পানিদূষণ হবে, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি আছে। আমাদের প্রতিবেদনে এসব পরিমাপের পদ্ধতি বলা আছে, যাতে ট্রানজিট শুল্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি বিবেচনায় নেওয়া যায়। আমি আবারও বলি, সরকার ট্রানজিট শুল্ক কমবেশি যা-ই নির্ধারণ করুক না কেন, একটি কাঠামো ও পদ্ধতি মেনে চলা উচিত। তা করা গেলে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যাবে। শুল্ক নির্ধারণ নিয়ে যেকোনো বিতর্ক ও সমালোচনার জবাব দেওয়া যাবে।
প্রথম আলো : আনুষ্ঠানিক ট্রানজিট শুরু হলো, কিন্তু এ জন্য যে অবকাঠামো গড়ে ওঠার কথা, তা তো হয়নি। আশুগঞ্জ রুটে ট্রানজিটের কথা অনেক দিন থেকেই হচ্ছিল। এর আগেও এই পথে একটি শুভেচ্ছা চালান গেছে। মাঝে দীর্ঘ সময় পাওয়া গেল, এত দিনেও ৫১ কিলোমিটার রাস্তা ঠিকঠাক করা হলো না কেন?
মজিবুর রহমান : এটা শুধু বাংলাদেশের দায়িত্ব নয়। যে দেশগুলো ট্রানজিট-সুবিধা ভোগ করবে, তাদেরও দায়িত্ব নিতে হয়। দ্বিপক্ষীয় হোক বা আঞ্চলিক ট্রানজিট হোক, অবকাঠামো গড়ে তোলার দায়টি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের। ট্রানজিট-সুবিধা দেওয়ার জন্য অবকাঠামো উন্নয়নের দায়িত্ব শুধু একা বাংলাদেশের নয়। বাংলাদেশ যেমন বিনিয়োগ করতে পারে, তেমনি সুবিধাভোগী দেশগুলোও পারে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকেও এ ব্যাপারে ঋণ বা সহায়তা নেওয়া যায়। নিরবচ্ছিন্ন ও গতিশীল ট্রানজিট নিশ্চিত করতে অবকাঠামো উন্নয়নের বিকল্প নেই।
প্রথম আলো : ভারত আমাদের ভূখণ্ডে ট্রানজিট নিচ্ছে। আমরাও তো ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানের মতো ভূমি পরিবেষ্টিত দেশে পণ্য পাঠানোর সুযোগ নিতে পারি। এ ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি নেই কেন?
মজিবুর রহমান : এ ক্ষেত্রে কার্যত কোনো সমস্যা নেই। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বা হাসিনা-মনমোহন সহযোগিতা সমঝোতার মধ্যেও বিষয়টি রয়েছে। ট্রানজিট বিষয়টিকে সাব রিিজওনাল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়। আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক শক্তিকে এ ব্যাপারে তৎপর হতে হবে। অব্যাহতভাবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ থাকতে হবে।
প্রথম আলো : ট্রানজিট সবে শুরু হলো। এটাকে কার্যকর করতে কী কী উদ্যোগ দরকার?
মজিবুর রহমান : ট্রানজিটের সঙ্গে অনেক মন্ত্রণালয়ের যুক্ততা রয়েছে। ফলে কোনো মন্ত্রণালয়ের পক্ষে এককভাবে বিষয়টির তদারকি ও নজরদারি সম্ভব নয়। এর খুঁটিনাটি অনেক দিক রয়েছে। ফলে ট্রানজিটের বিষয়টি দেখার জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো জরুরি। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে একটি ন্যাশনাল কাউন্সিল বা কমিটি ধরনের কিছু করতে হবে। এখানে বাণিজ্য, অর্থ, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, রেল, সড়ক ও নৌ—এমন সব মন্ত্রণালয়সহ এনবিআর ও ব্যবসায়ীদের সংগঠনের প্রতিনিধিদের যুক্ততা দরকার। এই যে আনুষ্ঠানিক ট্রানজিট শুরু হয়েছে এবং তাতে সামান্য কিছু পণ্য গেছে, এতেই দেখা গেছে বেশ সমস্যা ও সময়ক্ষেপণ হয়েছে। একটি জাহাজেই যদি এত সমস্যা হয়, তবে পরে যখন ১০টি জাহাজ আসবে তখন কী হবে? বিষয়টিকে ঝামেলাহীন ও নিরবচ্ছিন্ন করতে হলে অনেক বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে, অনেক বিধিবিধান তৈরি করতে হবে। ফলে একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গঠন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। দেশের মধ্যে এ ধরনের কাঠামো লাগবে এবং ট্রানজিটের আওতাভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের জন্য একটি কাঠামো লাগবে। ভবিষ্যতে একটি রিজওনাল ট্রানজিট কমিটি গঠনের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে।
প্রথম আলো : টনপ্রতি কমবেশি কিছু ট্রানজিট শুল্কের বাইরে ভারতকে দেওয়া এই ট্রানজিট-সুবিধার আর কী সুফল বাংলাদেশ পেতে পারে? বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর কী প্রভাব পড়তে পারে?
মজিবুর রহমান : এই যে ট্রানজিট শুরু হলো, এর তাৎক্ষণিক সুবিধা পাবে দেশের পরিবহন খাত। জাহাজে করে মাল আসছে, ট্রাকে করে পরিবহন হচ্ছে, মাল ওঠানো-নামানোর কাজে বাংলাদেশের শ্রমিকেরা কাজ করছেন। রেস্টুরেন্ট ও হোটেল-মোটেলের ব্যবসা বাড়বে। ফলে পরিবহন ও সেবা খাত প্রাথমিক সুফলটা ভোগ করতে শুরু করবে। ট্রানজিটের জন্য যে আর্থিক লেনদেন শুরু হবে তার ফল পাবে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ও বিমা খাত। আর ট্রানজিটকে যখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যাবে, তখন আমাদের সমুদ্রবন্দরগুলোর আয় বাড়বে। গভীর সমুদ্রবন্দর হলে এই সুযোগ আরও বাড়বে। সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্র করে বিনিয়োগ বাড়বে। বন্দরের কাছাকাছি জায়গায় বিভিন্ন শিল্পপণ্যের কারখানা গড়ে উঠবে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়তে থাকবে। ট্রানজিটের প্রয়োজনে দেশের রাস্তাঘাট ও যোগাযোগ অবকাঠামোতে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটবে। কর্মসংস্থান ও বিদেশি বিনিয়োগ মিলিয়ে দেশের অর্থনীতিতে এক বিরাট পরিবর্তনের সুযোগ ঘটাবে। আগেই বলেছি, বাণিজ্যিক ট্রানজিটে কোনো পক্ষের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সুযোগ নেই।
প্রথম আলো : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মজিবুর রহমান : আপনাকেও ধন্যবাদ।