
ড. সেলিম রায়হান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট নিয়ে প্রত্যাশা ও সীমাবদ্ধতার নানা দিক, অর্থনীতিতে সরকারের সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনোজ দে
গণ-অভ্যুত্থানের পর এক নতুন বাস্তবতায় ১০ মাসের মাথায় অন্তর্বর্তী সরকার তাদের বাজেট পেশ করতে যাচ্ছে। বাজেট প্রস্তাবের রূপরেখা সংবাদমাধ্যমে এসেছে। কেমন হতে যাচ্ছে এই বাজেট?
সেলিম রায়হান: চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর এটা প্রথম বাজেট। স্বাভাবিকভাবেই এই বাজেট ঘিরে প্রত্যাশাটা অনেক বেশি। আমার কাছে মনে হয়, বর্তমান অর্থবছরে যে বাজেটটা চলছে, তার বড় ধরনের পুনর্মূল্যায়ন করা দরকার ছিল। কেননা, এই বাজেটের যে কাঠামো, সেটা নিয়ে অনেক দিন ধরে আমরা সমালোচনা করে আসছি। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি যে সেই বাজেট–কাঠামোর সে রকম কোনো পুনর্মূল্যায়ন হয়নি। কিন্তু সেই সুযোগটা অন্তর্বর্তী সরকারের ছিল। গত বছরের আগস্টে সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে বাজেট–কাঠামোর একটা পুনর্মূল্যায়ন করতে পারত। বাজেট–কাঠামোর কোথায় কোথায় পরিবর্তন করা যায়, তারা সেটা বের করতে পারত।
কেননা, নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে যে ঘোষণা আমরা শুনছি, সেটা যদি বাস্তবে হয়, তাহলে খুব সম্ভবত অন্তর্বর্তী সরকারের এটাই একমাত্র বাজেট। সে ক্ষেত্রে সরকারের সামনে একটা সুযোগ ছিল উদাহরণ সৃষ্টি করার। দলীয় সরকারগুলো যে বাজেট দেয়, তার বাইরে বেরিয়ে একটা জনমুখী, একটা বৈষম্যবিরোধী, উন্নয়নমুখী বাজেট কেমন হতে পারে, সেই উদাহরণ তারা তৈরি করে দিতে পারত।
সরকারের কাছে বাজেট নিয়ে এটা আমাদের প্রত্যাশা থাকলেও বাস্তবতাটা ভিন্ন। অন্তর্বর্তী সরকার আগের সরকারের বা বিদ্যমান যে বাজেট–কাঠামো, সেই পথেই হাঁটছে। বাজেটে খুব বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা দেখছি না। কাঠামোর কিছু কিছু জায়গায় হয়তো পরিবর্তন হবে অথবা বরাদ্দের ক্ষেত্রে কিছু কিছু পরিবর্তন হবে। কিন্তু মূল জায়গায় আমরা কোনো পরিবর্তন দেখছি না। বরং উদ্বেগের কিছু কিছু জায়গা আছে। প্রশ্ন উঠছে, সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে এবারের বাজেটে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কি না। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত যেটা জানা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে এসব খাতে খুব পরিবর্তন হচ্ছে না।
পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার এসে যদি দেখত এ রকম একটা অরাজনৈতিক সরকার ভিন্ন ধরনের বাজেট দিয়েছে, তাহলে কিন্তু সেই সরকারের ওপর নতুন ধারা সৃষ্টি করার একটা বড় চাপ থাকত। আমি এখানে একটা প্রশ্ন রাখতে চাই, বাজেটের ক্ষেত্রে উদাহরণ তৈরি করার সুযোগটা অন্তর্বর্তী সরকার হারাল কি না।
সংবাদমাধ্যমের খবরে এসেছে যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংস্কারের যেসব সুপারিশ এসেছে, তার খুব প্রতিফলন থাকছে না এই বাজেটে। কেন?
সেলিম রায়হান: অর্থনৈতিক সংস্কারে দুটি বড় কমিটির প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আছে। সেই দুটি কমিটি হলো শ্বেতপত্র কমিটি ও টাস্কফোর্স কমিটি। দুটি কমিটিতেই সদস্য হিসেবে আমি যুক্ত ছিলাম। গত বছরের ১ ডিসেম্বর আমরা শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনটা দিয়েছি। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনটা এ বছরের জানুয়ারির শেষে দিয়েছি।
আমার বলতে দ্বিধা নেই যে এই দুটি প্রতিবেদন নিয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো, বিশেষ করে অর্থ, বাণিজ্য ও পরিকল্পনার মতো যে মন্ত্রণালয়গুলো এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক, তাদের মধ্যে এই প্রতিবেদনগুলো নিয়ে তেমন বড় কোনো আলোচনা দেখিনি। প্রতিবেদন দুটির সুপারিশের ভিত্তিতে কীভাবে একটা কর্মপরিকল্পনা করা যায়, সেই উদ্যোগ আমরা দেখিনি। শ্বেতপত্রের প্রতিবেদনে আমরা সুনির্দিষ্টভাবে বাজেট নিয়ে কিছু কথা বলেছি।
১৮ জানুয়ারি আমরা শ্বেতপত্র কমিটির পক্ষ থেকে চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে বাজেটকে টার্গেট করে কী কী সুপারিশ যেতে পারে, সেগুলো আমরা বলেছি। কিন্তু আমার মূল্যায়ন হচ্ছে, বাজেটে এই সুপারিশগুলোর প্রতিফলন খুব একটা হচ্ছে না। সেটা হলে বাজেট–কাঠামোতে আমরা একটা পরিবর্তন দেখতে পেতাম। অন্তর্বর্তী সরকার যদি এই অজুহাত দেয় যে তারা সময় পায়নি, সেটা বাস্তবসম্মত নয়। যে জন–আকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্র করে গণ–অভ্যুত্থানটা হয়েছিল, সেখানে কিন্তু অর্থনীতির ক্ষেত্রে সরকার ও সরকারের বাইরে খুব গুরুত্বপূর্ণ ও দক্ষ লোক যাঁরা আছেন, তাঁদের একসঙ্গে করে ভিন্ন ধরনের বাজেট দেওয়ার সুযোগ ছিল।
কেন এমনটা হলো, তার পেছনে কয়েকটা কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, সরকারে যাঁরা আছেন, তাঁরা এই সংস্কার প্রতিবেদনগুলোকে কতটা ওউন করেন, সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কেউ কেউ হয়তো অবশ্যই সেটা ওউন করেন। পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের তত্ত্বাবধানেই কিন্তু টাস্কফোর্সটা গঠিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, সংস্কার বাস্তবায়নে আমলাদের কাছ থেকে মন্ত্রণালয়গুলো কতটুকু সহযোগিতা পাচ্ছে, সেটাও একটা প্রশ্নের জায়গা। সংস্কারের জন্য সহায়ক শক্তিগুলো এবং রাজনৈতিক দলগুলোও কতটা শক্ত বক্তব্য তুলে ধরছে, কতটা আগ্রহী হচ্ছে, সেটাও একটা বড় ব্যাপার।
শ্বেতপত্র কমিটি ও টাস্কফোর্সের সুপারিশগুলো বাজেটে প্রতিফলিত হবে, কতটা দ্রুততার সঙ্গে সরকার সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেবে, তার জন্য সরকারের ওপর তেমন চাপ নেই। সেই চাপটা আসতে পারত সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে। আমরা সিভিল সোসাইটি থিঙ্কট্যাংক থেকে বলে যাচ্ছি, দুই কমিটির সদস্যরা বলে যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের কথায় সরকার তেমন চাপ বোধ করছে না।
বলা হয় বাজেট কেবল আয়-ব্যয়ের হিসাব নয়; সরকারের অর্থনৈতিক দর্শনও। এবারের বাজেটে অর্থনৈতিক দর্শনটা কী? কী হওয়া উচিত ছিল বলে আপনি মনে করেন?
সেলিম রায়হান: এবারের বাজেটের মূল অর্থনৈতিক দর্শনের জায়গাটা হতে পারত কীভাবে বৈষম্যটা নিরসন করা যায়। বৈষম্যের মূল ভিত্তিগুলো, যেমন আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বৈষম্য, প্রবৃদ্ধির সুফল পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য কমিয়ে আনার উদ্যোগ দরকার। দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে আমরা উল্টো চিত্রটা দেখছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দারিদ্র্য বাড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সাময়িক সাফল্য থাকলেও তার ওপর ভরসা করার সুযোগ নেই।
ব্যক্তি খাত বলি, বিদেশি বিনিয়োগ বলি, সামগ্রিকভাবে বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো নয়। সবকিছু মিলিয়ে এবারের বাজেটে একটা জনমুখী, বৈষম্যহীন, প্রগতিশীল অর্থনৈতিক দর্শন থাকা দরকার ছিল। আমরা হয়তো বাজেটের মুখবন্ধে এ রকম অনেক কথাবার্তা শুনব। কিন্তু বাস্তবে বাজেটের কাঠামোতে যদি পরিবর্তন না হয়, তাহলে সেই ভালো কথাগুলো কাউকেই আশ্বস্ত করতে পারবে না।
আমাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান খাত কৃষি, এবারের বাজেটে কৃষির ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়ার কোনো লক্ষণ কি দেখছেন? গত ১০ মাসে সরকার কৃষির ওপর কতটা নজর দিয়েছে বলে মনে করেন?
সেলিম রায়হান: গত ৯ মাসের উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে বিবিএস অন্তর্বর্তীকালীন জিডিপির যে অঙ্কটা দিয়েছে, সেখানে কিন্তু সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে গত অর্থবছরের তুলনায় এ অর্থবছরে কৃষি প্রবৃদ্ধি অনেকটা কমে গেছে। এটা কিন্তু খুব আশঙ্কাজনক। কৃষিতে প্রবৃদ্ধি কমার মানে হচ্ছে, আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার ওপর একটা ঝুঁকি তৈরি হওয়া। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে আমরা যদি অভ্যন্তরীণভাবে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়াতে না পারি, তাহলে কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমে আসার সম্ভাবনা থাকবে না।
শুধু আমদানি করে আমরা মূল্যস্ফীতি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারব না। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর কৃষি খাত তো একধরনের অবহেলার শিকার হয়েছেই। তা না হলে কৃষিতে প্রবৃদ্ধি এতটা কমে যাবে কেন। আমরা কিন্তু করোনা মহামারির সময়ে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি এ রকম কম দেখিনি। সেই দুঃসময়ে কৃষি আমাদের বড় ধরনের সাপোর্ট দিয়ে গিয়েছিল।
এটা আশঙ্কা করার মতো ব্যাপার যে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি দুইয়ের নিচে নেমে এসেছে। কৃষি খাতের পাশে দাঁড়ানোর একটা বড় সুযোগ ছিল সরকারের সামনে। শুধু ভর্তুকি দেওয়া নয়, কৃষি খাত আধুনিকায়নের জন্য কী কী প্রকল্প আছে, সেগুলোকে কীভাবে আরও জোরদার করা যায়, সে বিষয়ে বাজেটে অবশ্যই উদ্যোগ থাকা দরকার।
বাজেট প্রস্তাবের আগে এনবিআর ভাগ করা হয়েছে এবং এ নিয়ে আন্দোলন হয়েছে? সেই পরিবর্তন ও আন্দোলনকে কীভাবে দেখেন? সামনে রাজস্ব আদায়ে এর কী প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করেন?
সেলিম রায়হান: এনবিআর ভাগ করার প্রসঙ্গটি যখন এল, আমরা সেটিকে স্বাগত জানিয়েছিলাম। শ্বেতপত্র কমিটির দিক থেকেও সুপারিশ ছিল এনবিআরের ভূমিকাকে ভাগ করার। এনবিআরকে ভাগ করার সরকারের উদ্দেশ্য খুবই ভালো; কিন্তু ডিজাইনটা সঠিক হয়নি। এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এত গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করার জন্য আমলাতন্ত্রের মধ্যে ও বাইরে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন, তাঁদের সঙ্গে নিয়ে সংস্কারের চেষ্টা করা দরকার ছিল। সেটি না হওয়ায় আমরা দেখলাম, সরকারের সিদ্ধান্তে বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি হলো।
এটা অস্বীকার করা যাবে না যে আমলাতন্ত্রের ভেতরে সংস্কারবিরোধী মনোভাব আছে; কিন্তু আমলাতন্ত্রকে আস্থায় না নিয়ে সরকার কিন্তু বড় ধরনের সংস্কার করতে পারবে না। এখানে খোলাখুলি আলোচনা হওয়া দরকার ছিল। এনবিআরের লোকজন যেসব উদ্বেগ তুলে ধরেছেন, সেগুলো কীভাবে নিরসন করা যায়, সেই চেষ্টা থাকা দরকার ছিল। এনবিআর ভাগ করার সিদ্ধান্ত ঘিরে যে ধর্মঘট ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখতে পাচ্ছি, তাতে অবশ্যই রাজস্ব আদায়ে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এটাকে যদি সঠিকভাবে সমাধান না করা যায়, সেখানেও রাজস্ব আদায়ে প্রভাব পড়বে। আবার সরকার যদি সংস্কার থেকে পিছিয়ে যায়, সেটিও কিন্তু ইতিবাচক হবে না। আমি মনে করি, এখনো সময় আছে, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে একটি খোলামোলা আলোচনা করে এনবিআর সংস্কারের পথে এগোনো।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গত ১০ মাসে সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতাকে কীভাবে চিহ্নিত করবেন?
সেলিম রায়হান: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন, যে কারণে ব্যাংকিং খাতে যে রক্তপাতটা হচ্ছিল, সেটি কিছুটা হলেও থামানো গেছে। কিছু কিছু উদ্যোগের কারণে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্রটা আমরা জানতে পারছি; কিন্তু এরপরও আমরা জানি যে ব্যাংকিং খাতের দশা খুবই নাজুক। ব্যাংক খাত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে আরও অনেক দিন সময় লাগবে। সে জন্য সংস্কার কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যেতে হবে। আমি একটি অভিযোগ করব, ব্যাংক খাতে যে সংস্কার হচ্ছে, তা খুব একটা স্বচ্ছতার ভিত্তিতে হচ্ছে না। গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের কাছে খুব একটা পরিষ্কার নয় যে ব্যাংক খাতে সংস্কারগুলো কীভাবে হচ্ছে। আমি মনে করি, এখানে আরও স্বচ্ছতা দরকার।
রপ্তানি খাত ও রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে যে প্রবৃদ্ধি দেখছি, সেটি অবশ্যই ইতিবাচক। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যে বড় ধরনের পতন হচ্ছিল, সেটিকে কিছুটা হলেও ঠেকানো গেছে। এটা অবশ্যই সফলতা; কিন্তু সফলতা—এই মুহূর্তে আমাদের অর্থনীতির যে সংকট, সেটি কাটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। আমাদের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে অনিশ্চয়তা। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা, নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তা আছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা আছে, রাজনৈতিক সংঘাতের আশঙ্কা আছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোটেও ভালো নয়। এ রকম পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে খুব দ্বিধাবোধ করেন। স্বভাবতই বিনিয়োগে আমরা তার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি।
বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বরাবরই উপেক্ষিত। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। কেন এমনটি হলো?
সেলিম রায়হান: শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর উদাহরণ সৃষ্টি করার সুযোগ অন্তর্বর্তী সরকারের সামনেই ছিল। শুধু বরাদ্দ বাড়ানো নয়, বরাদ্দটা ঠিকভাবে ব্যবহার করতে যাতে পারে, সে জন্য এই দুটি খাতে বড় ধরনের সংস্কার তারা করতে পারত। আপাতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হলেও জনস্বার্থের বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ নয়, এমন প্রকল্প স্থগিত রেখে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো যেত। সেটি হয়নি; তার কারণ হলো আমলাতন্ত্রের মধ্যে একটি গতানুগতিক মনোভাব কাজ করেছে। সরকারের মধ্যে যাঁরা আছেন, তাঁরাও সাহসী ভূমিকা নিতে পারেননি। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে যে অচলায়তন তৈরি হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার সেটিকে ভেঙে দিতে পারত।
প্রস্তাবিত বাজেটে দারিদ্র্যমুক্তি ও বেকারদের কর্মসংস্থানের কোনো দিকনির্দেশনা কি থাকছে বলে মনে করেন?
সেলিম রায়হান: সাম্প্রতিক তথ্যগুলোও বলছে, দারিদ্রে৵র হার বেড়ে যাচ্ছে। ব্যক্তি খাতে কর্মসংস্থান একেবারেই সৃষ্টি হচ্ছে না। কারণ, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ পরিস্থিতি খুবই খারাপ। বিনিয়োগের যে তথ্য-উপাত্ত আমরা দেখছি, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন আছে। এ ব্যাপারে আসল চিত্রটা না জানলেও কর্মসংস্থানের প্রকৃত চিত্রটাও আমরা পাব না।
বাজেটে কোন জায়গাটিতে সরকারের নজর দেওয়ার ছিল; কিন্তু সরকার সেটি দেয়নি বলে মনে করেন?
সেলিম রায়হান: যে তথ্য–উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে এবারের বাজেটটা করা হচ্ছে, সেটি নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন আছে। আগের সরকারের আমলে প্রবৃদ্ধির হার, জাতীয় গড় আয়, জিডিপির আকার—এসব ক্ষেত্রে তথ্য-কারসাজি হতে দেখেছি। একটি স্বাধীন উপাত্ত কমিশন করার দাবি ছিল আমাদের, যাতে এসব তথ্য-উপাত্ত রিভিউ করা যায়। মোটামুটি সঠিক একটা তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে বাজেট প্রণয়ন করা দরকার। কিন্তু আমরা বিবিএস সংস্কারে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখতে পাইনি। ফলে বাজেটে যেসব তথ্য-উপাত্ত আসছে, সেগুলো আগের সরকারের আমলের সেই বিকৃত তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করেই তৈরি করা। সে কারণেই আমরা দেখছি প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে; কিন্তু বিনিয়োগ-জিডিপি রেশিও সেই ৩১ শতাংশের মতো রাখা হচ্ছে। এগুলো তো একটি অসংগতি। আমি মনে করি, সরকারের সময় ছিল, সুযোগও ছিল একটি স্বচ্ছ মেথডোলজি ব্যবহার করে, দক্ষ লোকদের সম্পৃক্ত করে তথ্য-উপাত্তগুলো সঠিক জায়গায় নিয়ে আসা; কিন্তু সেটি হয়নি।
আপনাকে ধন্যবাদ।
সেলিম রায়হান: আপনাকেও ধন্যবাদ।