প্রতিক্রিয়া

বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীর পানিতে ডুবে মৃত্যু ও কিছু প্রশ্ন

তাসপিয়া জাহান ও মোবাশ্বেরা তানজুম
তাসপিয়া জাহান ও মোবাশ্বেরা তানজুম

মধ্য শ্রাবণের আকাশ অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঢালছে। কাঠফাটা দাবদাহের পর এক রাশ স্বস্তি। গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের তাসপিয়া জাহান ও মোবাশ্বেরা তানজুম আর দশজনের মতোই মেতেছিলেন বৃষ্টি বিলাসে। কে জানত, এটাই তাদের শেষ শ্রাবণ মেঘের দিন! দৃষ্টিনন্দন লেকের পানিতে ডুবেই মৃত্যু হলো অজস্র রঙিন স্বপ্ন মাখা দুটি তাজা প্রাণের। প্রিয় সহপাঠীদ্বয়কে হারিয়ে শোকে বিহ্বল সতীর্থরা।

বিয়োগান্ত এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কাঠগড়ায় তুলছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে। সতীর্থদের আবেগমাখা ক্ষোভের যথার্থতা আছে। লেক নির্মাণের নকশায় উঠানামার ঘাট থাকলেও তা নির্মিত হয়নি। ফলে, ঝুঁকি নিয়ে এত দিন ঢালু পাড় বেয়ে উঠানামা করেছেন শিক্ষার্থীরা। লেক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আছে বলে দায়সারা যে বক্তব্য প্রশাসন প্রচার করছে তা রীতিমতো প্রহসনের মতো শোনাচ্ছে। অরক্ষিত এ লেকে অতীতে প্রাণহানি না ঘটলেও ছোট বড় অনেক দুর্ঘটনার নজির আছে। তাসপিয়া-মোবাশ্বেরার মৃত্যু সেখানে বরং নির্মম সংযোজন।

‘লেক থেকে পঞ্চাশ মিটার দূরত্বে চিকিৎসা কেন্দ্র থাকলেও সময়মতো মেলেনি প্রাথমিক চিকিৎসা। নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম। সংকটাপন্ন অবস্থায় মেলেনি অক্সিজেন। ব্যবহার যোগ্য একমাত্র অ্যাম্বুলেন্সেও ছিল না অক্সিজেনের মজুত’—সতীর্থদের এমন দাবির সত্যতা মিলেছে। চিকিৎসাকেন্দ্রে প্রায় সময় চিকিৎসকেরা অনুপস্থিত থাকেন। নার্সরা দিচ্ছেন প্যারাসিটামল ও এন্টাসিডনির্ভর চিকিৎসাসেবা। সম্প্রতি চিকিৎসকের অনুপস্থিতিতে ফার্মাসি বিভাগের এক শিক্ষকের জখমে নিজ হাতে ব্যান্ডেজ করার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। নিকট অতীতে কর্মচারীদের ওষুধ পাচারের ঘটনাও ঘটেছে। এত কিছুর পরেও নির্বিকার প্রশাসন সেমিস্টার প্রতি দুই শ টাকা চিকিৎসা ফি নিতে মোটেও কার্পণ্য করেনি।

সীমাহীন সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রতি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যে আয়োজন চলছে, তাতে শিক্ষার গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ, অনুকূল পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধার পর্যাপ্ততা নিশ্চিতে রাষ্ট্রের কার্যত কোনো কার্যকরী ভূমিকা কি আছে? শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষককক্ষ, ল্যাবরেটরি, আবাসন, চিকিৎসা, নিরাপত্তাসহ অত্যাবশ্যকীয় প্রায় সব অনুষঙ্গের নিদারুণ অপর্যাপ্ততায় খুঁড়িয়ে চলছে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বাজেট বরাদ্দে অসম দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রাপ্ত অপ্রতুল বাজেট বাস্তবায়নে অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ ও দুর্নীতির বাম্পার ফলনে আরও সংকট তৈরি হচ্ছে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।

নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় না বানিয়ে বিদ্যমান বিদ্যাপীঠগুলোর গুণগত মানোন্নয়নের জোর দেওয়ার যে তাগিদ শিক্ষাবিদগণ দিচ্ছেন, তার প্রতি কর্ণপাতই করছেন না সংশ্লিষ্টরা। বিপরীতে দলীয় আদর্শে অনুগামীদের চাকরিস্থল ও নেতা-কর্মীদের টেন্ডার বাণিজ্যের অভয়ারণ্যে পরিণত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। আর তাই প্রতি বছর অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো খোঁজার অভিযানে নামতে হয়। বিকারগ্রস্ত ছাত্ররাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের রাজনীতিপ্রীতি, অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সিন্ডিকেটের রমরমা প্রসারে অবনমিত হচ্ছে শিক্ষাঙ্গনের প্রত্যাশিত পরিবেশ। মৌলিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। তাসপিয়া-মোবাশ্বেরার মৃত্যুকে তাই অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।

মশিউর রহমান কিংবা রাইসুলের মৃত্যুতে নিরাপদ সড়ক, ধর্ষণের প্রতিবাদে নিরাপদ গোপালগঞ্জ কিংবা তাসপিয়া-মোবাশ্বেরার মৃত্যুতে নিরাপদ ক্যাম্পাস চাইতে হবে কেন? নাগরিকের যে মৌলিক অধিকারগুলো রাষ্ট্র স্বপ্রণোদিতভাবে নিশ্চিত করার কথা তা কেন প্রাণের বিনিময়ে চাইতে হবে?

মাহমুদুল হাছান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।
mahmudbsmrstuir@gmail.com