প্রতিক্রিয়া

দাবি–আন্দোলন: ৫ আগস্টের আগে তাঁরা কোথায় ছিলেন

এখন সত্যিই অবাক লাগে, যখন শুনি সরকারি চাকরিজীবীদের অধিকাংশই, যাঁরা কিনা জুলাই অভ্যুত্থানের সময় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁরা ৫ আগস্টের পরে মাঠে নেমেছেন বেতন বৃদ্ধি, গ্রেড উন্নীত, মাইলেজ ভাতাসহ নানা দাবিতে।

দুই বছর আগে বা‌ড়িতে থাকার সময় পাশের প্রাইমারি স্কুলের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতাম। তাদের ম‌ধ্যে পঞ্চম, চতুর্থ ‌ও তৃতীয় ‌শ্রেণির শিক্ষার্থীও ছিল। প্রাইভেট পড়াতে গিয়ে বেশ‌ কিছু নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হ‌তে হয়েছিল আমাকে। আমি অবাক হয়েছিলাম, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ‌‌শিক্ষার্থীরাও ঠিকঠাক বাংলা উচ্চারণ করতে ও রিডিং পড়তে পারছে না। তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বাংলা অক্ষরই চিনতে পারছে না। প্রথমে ভেবেছিলাম এই সমস্যা হয়তো আমি যাদের পড়াই, তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

পরে খোঁজ নিয়ে দেখলাম, এই সমস্যা ওই প্রাইমারি স্কুলের বে‌‌শির ভাগ শিক্ষার্থীর মধ্যেই রয়েছে এবং আশপাশের স্কুলগুলোর ব্যাপারে খবর নিয়েও একই সমস্যার কথা জানতে পারলাম। গত বছরের শুরুতে বিবিসি বাংলার একটি খবরে বলা হয়, প্রাইমারি স্কুলের ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থীই সঠিকভাবে বাংলা উচ্চারণ করতে বা রিডিং পড়তে পারে না।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই সমস্যা? ‌কেন প্রাইমারি স্কুলের চতুর্থ কিংবা পঞ্চম শ্রেণির বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বাংলা উচ্চারণ কিংবা রিডিং পড়তে পারে না? প্রাইমারি স্কুলের ‌শিক্ষক‌দের থেকে বলা হয়, ট্রে‌নিংং‌য়ের ঘাটতি থাকার কারণে তাঁরা মানসম্মত ‌শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়। তাঁদের কথা মেনে নিলাম। তবে ওই সব শিক্ষার্থী, যারা চতুর্থ, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার পরেও বাংলা রিডিং পড়তে পারে না, তাদের মা-বাবার পক্ষ থেকে আমি যদি প্রাইমারি ‌শিক্ষক‌দের কাছে প্রশ্ন রাখছি, প্রাইমারির শিক্ষার্থীদের বাংলা রিডিং শেখানোর জন্যও কি তাঁদের ট্রেনিং ‌নি‌তে হবে?

দু-‌তিন দিন আগে খবরে দেখলাম প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকেরা দশম গ্রেডের দাবি তুলে আন্দোলন শুরু করেছেন। সেখানে তাঁরা বলছেন, একটি জাতির ফাউন্ডেশন গড়বার কারিগর তাঁরা। আর একটি জাতির ফাউন্ডেশন গড়বার কারিগরেরা কেন তৃতীয় শ্রেণির পদমর্যাদার চাকরি করবেন? আমিও তাঁদের সঙ্গে একমত, কেন জাতির ফাউন্ডেশন গড়বার কারিগর তৃতীয় শ্রেণির চাকরি করবেন?

তবে এখানে তাঁদের কাছে প্রশ্ন হচ্ছে, প্রাইমারি স্কুলের বে‌শির ভা‌গই ‌শিক্ষার্থী সঠিকভাবে বাংলা রিডিং পড়তে পারে না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা বা এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কখনো কি আপনারা খুঁজে বের করেছেন? শিক্ষার্থীদের মা–বাবার মনে একমাত্র এই ধারণাই জন্মেছে যে তাঁদের ছেলেমেয়েকে প্রাইভেট না পড়াইলে সে পড়ালেখা শিখতে পারবে না। আর বাস্ত‌বেও কিন্তু তাই ঘট‌ছে। প্রাইভেট না পড়‌লে পড়া‌‌শোনা শেখা অসম্ভব, বাস্ত‌বেও যে‌হেতু তাই–ই ঘট‌ছে তাহ‌লে ‌‌শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকে কী ‌‌শিখ‌‌ছে?

তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম এমনকি মাধ্যমিকের ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির অনেক শিক্ষার্থী বাংলা রিডিং পড়তে পারে না কেন? প্রাইমারিতে তাদের কী শেখানো হয়?

আমি রাজবাড়ীতে থাকি। আরামদায়ক ভ্রমণ সুবিধার জন্য বাড়িতে আসার সময় এবং ঢাকায় আসার সময় বাসের পরিবর্তে ট্রেনেই বেশি যাতায়াত করি। একদিন রাজবাড়ী থেকে ট্রেনে করে বাড়িতে আসছিলাম, একটু পরে টিটিই টিকিট চেক করতে এলেন, আগেই আমি টিকিট বের করে হাতে ধরে রেখেছি। আমার পাশের সিটের যাত্রীর মধ্যে দুজন টিকিট কাটেনি। টিটিই তাদের কাছ থেকে ভাড়া নিল আর আমিসহ যারা টিকিট বের করলাম, তাদের টিকিট চেক না করে চলে যেতে লাগল। তখন আমি বললাম, টিকিট চেক করলেন না? টিটিই তখন ফিরে এসে সাইন করে দিয়ে গেল। দেখলাম, একেকটা টিকিটে একেক ধরনের সাইন। কোনোটির সঙ্গে কোনোটির মিল নেই। টিটিই কিন্তু একজনই।

এরপর অন্য আরেক দিনের ঘটনা; সেদিনও আমি বাড়িতেই আসছিলাম। টিটিই বিনা টিকিটে ভ্রমণ করা এক যাত্রীর কাছে জানতে চাইল কোথায় যাবেন? যাত্রী বলল, সাতৈর। টিটিই বলল, ৩০ টাকা দেন। তখন যাত্রী বলল, ২০ টাকা দিই। টিটিই বলল, না না, ২০ টাকা তো ভাড়া না, ৩০ টাকা দেন। তর্কাতর্কির একপর্যায়ে যাত্রী যখন ৩০ টাকা দিতে গেল, এমন সময় টিটিই বলল, আচ্ছা ২০ টাকাই দেন। তখন যাত্রী ২০ টাকা দিল। চলে যাওয়ার সময় আমি টিটিইর কাছে জানতে চাইলাম ভাড়া কত টাকা? টিটিই বলল, ৩০ টাকা। আমি বললাম, ২০ রাখলেন কেন? টিটিই বলল, সমস্যা নেই। আমি বললাম, ভাড়া ৩০ টাকা, আপনি নিলেন ২০ টাকা, তাহলে বাকি ১০ টাকার কী হবে? হিসাব মেলাবেন কীভাবে? টিটিই যথার্থ উত্তর দিতে পারল না। সরকারি ট্রেনগুলোতে এ রকম হিসাব না মেলানোর ঘটনাগুলো সম্পর্কে আমরা মাঝেমধ্যেই অবগত হই, যেহেতু ট্রেনে প্রতিনিয়ত ভ্রমণ করা হয়।

খবরে দেখলাম রেলওয়ে কর্মচারীরা কর্মবিরতি দিছে মাইলেজ ভাতাসহ অন্যান্য দাবির জন্য। ফলে ট্রেনের যাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছে।

রেল বাংলাদেশের সবচেয়ে সহজলভ্য এবং আরামদায়ক মাধ্যম হিসেবে অনেক পরিচিত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শিডিউল বিপর্যয়ের পরেও মানুষ ট্রেনের ওপর নির্ভর করে একটু আরামদায়ক যাতায়াত করার জন্য। রেলপথও ইতিমধ্যে দেশের প্রতিটি জেলায় বর্ধিত করা হয়েছে। যার মাধ্যমে রেল সেক্টর বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান যাতায়াতব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। সেই সেক্টরের কার্যক্রম যদি হঠাৎ করে বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে যাত্রীরা কতটা ভোগান্তিতে পড়তে পারে, একটু ভেবেছেন?

সর্বশেষ কোটা সংস্কারের আগপর্যন্ত রেলওয়ে সেক্টরে চাকরির ক্ষেত্রে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত কোটা অ্যাপ্লাই করা হয়েছে। প্রাইমারিতে ৮০ শতাংশ কোটা অ্যাপ্লাই করা হয়েছে। সাধারণ চাকরিপ্রার্থী, যাঁদের কোটা নেই, তাঁদের রেলওয়ে, প্রাইমারি কিংবা ১১ থেকে ২০তম গ্রেডের সরকারি চাকরিগুলো পাওয়া তখন প্রায় অসম্ভব ছিল।

আগে যখন এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজগুলোতে কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হতো, সেই সময়ের নিয়োগকৃত শিক্ষকেরাই বর্তমানে বেশি স্কুল-কলেজগুলোতে চাকরি করছেন। প্রাইমারিতে যেসব নিয়োগ হয়েছে, তার প্রতিটি নিয়োগেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে তার সঙ্গে আবার বাপ-মা কোটা তো ছিলই। রেলের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা ছিল।

চাকরির ক্ষেত্রে কোটা–বৈষম্যের জের ধরেই আগের স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়েছে। যেখানে শিক্ষার্থীরা বুলেটের সামনে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে সেই বৈষম্যের শিকড় উপড়ে ফেলেছেন। শিক্ষার্থীরা কি এখনো সেই বৈষম্যে থেকে মুক্তি পেয়েছে? কদিন আগেও খবরে শুনলাম মেডিকেল ভর্তি পরিক্ষায় কোটা অ্যাপ্লাই করা হয়েছে। শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ তাঁদের জীবন উৎসর্গ করে আগের সরকারের পতন করেছেন। এখন সত্যিই অবাক লাগে যখন শুনি সরকারি চাকরিজীবীদের অধিকাংশই সে সময় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। এখন তাঁরাই নানা দাবিদাওয়া নিয়ে সরব হয়েছেন এবং ঢাকায় এসে রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিচ্ছেন আন্দোলনের নামে।

৫ আগস্ট সরকারের পরিবর্তনের পর থেকে প্রতিদিনই ঢাকায় আন্দোলন সংঘটিত হতে দেখা যাচ্ছে। স্বাধীন দেশে যে কেউ যৌক্তিক আন্দোলন করতেই পারে। তবে এসব আন্দোলনে উত্থাপিত দাবির বেশির ভাগই অযৌক্তিক দাবি অর্থনীতির বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে, সেটা তাদের বোঝা উচিত। ৫ আগস্টের আগে স্বৈরাচারী সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের আমলে এভাবে তো তারা আন্দোলনে নামেননি। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, ছাত্রদের নেতৃত্বে এবং বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় যখন স্বৈরাচারী সরকারের পতন হলো, তখন এদের বেশির ভাগই চুপ থেকে স্বৈরাচার পতনের পরে সবাই তাদের সুযোগ–সুবিধার দাবি জানাতে মাঠে নেমেছে। তাদের কি আমরা স্বার্থান্বেষী মহল বলব?

দেশের বেকার সংখ্যা ২৬ লাখের ওপরে। যাঁরা চাকরি করতে ইচ্ছুক থাকা সত্ত্বেও চাকরি পাচ্ছেন না। দেশের অর্থনীতির অবস্থাও টালমাটাল। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে সেখানকার শ্রমিকেরা না খেয়ে দিনরাত পার করছেন। দেশের সাধারণ মানুষও অনেক কষ্টে আছে। আর আপনারা সরকারি চাকরি করছেন, বেতন পাচ্ছেন, যত বড় দুর্যোগই আসুক আপনাদের বেতন বন্ধ হবে না। তারপরও আপনারা ঝামেলা শুরু করছেন সুযোগ–সুবিধা বাড়ানোর জন্য? এবং জোরপূর্বক দাবি আদায়ের চেষ্টা করছেন? দেশের অন্য সাধারণ মানুষের কথা কি একবারও ভেবে এই আন্দোলনে নেমেছেন আপনারা?

দেশের সাধারণ মানুষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে রয়েছে এবং মানুষগুলো আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে একটু মুক্তির আশ্বাসে। বেকারদের বেকারত্ব থেকে মুক্তি দেন।

মেহেদী হাসান

চাকরিপ্রার্থী

কালুখালী, রাজবাড়ী