
গোপালগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে উলপুর ইউনিয়ন। গোপালগঞ্জ-মাদারীপুর সড়ক-সংলগ্ন উলপুর বাজারে এম মনসুর আলীর সার, কীটনাশক ও সিমেন্টের দোকান। একে তো রোজার মাস, তার ওপর কাঠফাটা রোদ। দুপুরে দোকানের গদিতে খালি গায়েই বসে ছিলেন মনসুর আলী। পরিচয় দিতেই গায়ে জামা আর মাথায় টুপি দিয়ে বললেন, ‘আমাদের কথা শুনে কী আর করবেন। আপনি সব লিখতেও পারবেন না, আমি সব বলতেও পারব না।’
‘তবু যতটুকু বলতে পারেন।’ আবেদন করা হলো। শুকনো হাসি দিয়ে তিনি বললেন, ‘শহরে আমার ইলেকট্রনিকস পণ্যের দোকান ছিল। দুবার আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। ইনস্যুরেন্স ছিল। ক্লেম করেছি। এক পয়সাও পাইনি। বলেছে দেওয়া যাবে না। বাড়িতে হামলা হয়েছে। টিকতে না পেরে শেষে গ্রামে এসে এই সারের দোকান দিয়েছি। এই যে আপনি এসেছেন। খবর চলে যাবে। কিছুক্ষণ পরই গোয়েন্দা পরিচয়ের লোকেরা এসে জানতে চাইবে, কে এসেছিল। কী বলেছি। সব সময় চোখে চোখে রাখে। এই হলো অবস্থা।’ একটানা কথাগুলো বলে একটু থামলেন। তিনি গোপালগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। ৭ জুন কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচিত নাম গোপালগঞ্জ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনারও জন্ম এই জেলায়। এ কারণে গোপালগঞ্জবাসীর মনে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে অন্য রকম ভাবাবেগ কাজ করে। এলাকার অধিকাংশ লোককে জিজ্ঞেস করলেই তাঁরা নির্দ্বিধায় বলে দেন, নির্বাচনের সময় তাঁরা প্রার্থী দেখেন না, দেখেন ব্যালটে ‘নৌকা’
আছে কি নেই। এই গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের ঘোরতর বিরোধী বিএনপির অবস্থান কেমন হবে, তা অনুমান করা সচেতন কারও পক্ষে কঠিন নয়। তবে প্রকৃত অবস্থাটা কেমন, তা জানার জন্য প্রথম আলোর তরফ থেকে আমরা কথা বলেছি বিএনপির সাবেক-বর্তমান ও প্রবীণ-নবীন নেতা-কর্মীদের সঙ্গে। তাঁদের মতে, গোপালগঞ্জে বিএনপির ইতিহাসে এখন সবচেয়ে দুঃসময়। নেতারা শহরে আসতে পারছেন না। কর্মীরা বিচ্ছিন্ন। কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম নেই। জাতীয় দিবস বা দলীয় দিবসও (যেমন জিয়াউর রহমানের মৃত্যু দিবস) তাঁরা পালন করতে পারছেন না।
বিএনপির জেলা সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মূলত ঢাকায় থাকেন। হঠাৎ এলেও শহরে আসেন না। সাধারণ সম্পাদকের মতো তিনিও গ্রামের বাড়ি হরিদাসপুর ইউনিয়নের আড়পাড়ায় ওঠেন। ফোনে কিছু নেতা-কর্মীকে সেখানে ডাকেন। প্রচার সম্পাদক শেখ বদরুল আলম এ তথ্য দিলেন।
সাধারণ সম্পাদক মনসুর আলী বললেন, এখানে দলীয় কর্মসূচি পালিত হচ্ছে না। ঘরোয়া কর্মসূচির জন্য পুলিশের অনুমতি নিতে হয়, পুলিশ দেয় না। দলের জেলা কার্যালয় বহু বছর ধরে খোলাই হয় না।
গোপালগঞ্জে সংসদীয় আসন তিনটি। গোপালগঞ্জ-১ (মুকসুদপুর) আসনের সাংসদ ফারুক খান, গোপালগঞ্জ-২ (সদর) আসনের সাংসদ শেখ ফজলুল করিম সেলিম এবং গোপালগঞ্জ-৩ (কোটালীপাড়া-টুঙ্গিপাড়া) আসনের সাংসদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই তিনটি আসনেই বিএনপির কোনো সুযোগ নেই। সদর থেকে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচিত হয়েছিলেন জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এফ ই শরফুজ্জামান। তিনিও বেশির ভাগ সময় ঢাকাতেই থাকেন। তাঁর বাবা মুসলিম লীগের বড় নেতা ফায়েকুজ্জামান ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য।
৭ জুন সকালে শরফুজ্জামানের বাড়িতে কথা হলো তাঁর সঙ্গে। জেলা কমিটির বর্তমান প্রচার সম্পাদক শেখ বদরুল আলম আমাদের সেখানে নিয়ে গেলেন। জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি আসাদুজ্জামান, ছাত্রদলের সভাপতি শেখ রিয়াজ উদ্দিন, সহসভাপতি শেখ শরিফুল আলমসহ আরও কয়েকজন ছিলেন সেখানে। শরফুজ্জামান বলছিলেন, ‘আমাদের এখন আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির মতো করে কাজ করতে হচ্ছে।’
শেখ বদরুল জানালেন, গোপালগঞ্জে বিএনপি বরাবরই দুর্বল দল, কিন্তু এখনকার মতো কখনো ছিল না। তাঁর মতে, ১৯৯১ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত গোপালগঞ্জে ছিল বিএনপির স্বর্ণযুগ। ওই সময় তাঁরা বঙ্গবন্ধু কলেজ ছাত্র সংসদে দুবার সহসভাপতি (ভিপি), কোটালীপাড়ায় শেখ লুৎফর রহমান কলেজে দুবার ভিপি পেয়েছেন। কাশিয়ানী, মুকসুদপুর ও গোপালগঞ্জ সদরের বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে জয় পেয়েছেন। সেই বিএনপি এখন রাস্তায় পরিচয় দিতে পারে না।
বিএনপির একটি অংশ মনে করে, শুধু প্রশাসন ও সরকারি দলের চাপের কারণেই বিএনপির আজকের এই করুণ পরিণতি নয়; নেতৃত্বের শূন্যতাও একটি বড় কারণ। কারণ, সাহসী তরুণেরা এখন নেতাদের ওপর আর ভরসা পান না। কর্মীরা জেলে গেলে বা হাসপাতালে গেলে অন্তত দেখতে যাবেন, তেমন নেতাও নেই।
উভয় পক্ষের কথাবার্তায় বোঝা যায়, এই বৈরী সময়েও দলের ভেতরে অন্তর্দ্বন্দ্বের একটি চোরা স্রোত বয়ে যাচ্ছে। তবে জেলা কমিটি নতুন করে গঠনের প্রক্রিয়া চলছে কেন্দ্রে। সেই প্রক্রিয়া সামনে রেখেই জেলায় বিএনপির থেমে যাওয়া চাকা একটু নড়তে শুরু করেছে।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন গোপালগঞ্জ সংবাদদাতা)