
মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ কেবল একটি সড়ক নয়—যেন একটি গোটা বাংলাদেশ। একটি কফিন ঘিরে দলমত–নির্বিশেষে দাঁড়িয়েছিল অগণিত মানুষ। জাতীয় পতাকায় মোড়ানো সেই কফিনে ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তাঁর জানাজা ঘিরে এ যেন জনতার মহাসমুদ্র।
স্বতঃস্ফূর্ত মানুষের ঢল মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, সংসদ ভবন এলাকা ছাড়িয়ে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে উপচে পড়ে। ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে মানুষ জানাজায় অংশ নেয়।
রাজনীতি–সচেতন ব্যক্তিরা বলছেন, এত বড় জানাজা, এত সম্মান, এত মানুষের আবেগতাড়িত উপস্থিতি বাংলাদেশ আগে কখনো দেখেনি। কোনো রাজনীতিকের অন্তিম বিদায়ের এমন দৃশ্য আর কখনো দেখা যায়নি।
পূর্বঘোষণা ছিল, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জানাজা বুধবার বেলা দুইটায় অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু দুপুর গড়ানোর আগেই মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। এ পরিস্থিতিতে গুলশান থেকে খালেদা জিয়ার কফিন মঞ্চে পৌঁছাতে অনেক সময় লাগে। আবার জানাজায় শরিক হতে সড়কগুলোতে মানুষের বিপুল উপস্থিতির কারণে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জানাজার মূল মঞ্চে পৌঁছাতে দেরি হয়। অবশেষে এক ঘণ্টা পর বেলা তিনটার পর জানাজা শুরু হয়, শেষ হয় তিনটা পাঁচ মিনিটে। জানাজা পড়ান জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল মালেক। জানাজা শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় খালেদা জিয়াকে শেরেবাংলা নগরে স্বামী সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সমাধির পাশে সমাহিত করা হয়।
দীর্ঘদিন ধরে গুরুতর অসুস্থতায় ভুগে ‘আপসহীন নেত্রী’খ্যাত খালেদা জিয়া গত মঙ্গলবার সকাল ছয়টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।
একটি মঞ্চ বানিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কফিন রাখা হয়েছিল মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর পশ্চিম প্রান্তে। এর পেছনে মিরপুর রোড। কফিন সামনে রেখে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা, ভেতরের দুটি মাঠ কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে পুরো মানিক মিয়া অ্যাভিনিউজুড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন শোকার্ত মানুষ। একপর্যায়ে জানাজায় আসা মানুষের বিস্তৃতি ছড়িয়ে যায় কফিনের পশ্চিম পাশে মিরপুর রোডের ধানমন্ডির ২৭ নম্বর সড়কে, লালমাটিয়া মাঠ, আসাদ গেট থেকে মোহাম্মদপুর টাউন হল, আগারগাঁও মেট্রোস্টেশন থেকে শ্যামলী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় শুধু মানুষ আর মানুষ। পূর্ব পাশে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ হয়ে বিজয় সরণি, আগারগাঁও, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, শাহবাগ পর্যন্ত বিস্তৃত সড়কগুলোতে কোথাও ফাঁকা জায়গা চোখে পড়েনি। আরেক দিকে তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ছাড়িয়ে যায়।
রাস্তায়, ফুটপাতে, বিভাজকের পাশে, বিভিন্ন ভবনের ছাদে, ওভারব্রিজে, মেট্রোস্টেশনে—যে যেখানে পেরেছেন দাঁড়িয়ে জানাজায় শরিক হওয়ার চেষ্টা করেছেন।
জানাজা অংশ নেওয়া এই লাখ লাখ মানুষের সবাই বিএনপির নেতা-কর্মী নন। এঁদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশাসহ অনেক সাধারণ মানুষ অংশ নেন। অনেকে দূরদূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে এসেছেন; কেউ অজু সেরে দাঁড়িয়ে ছিলেন খোলা রাস্তায়, কেউ চোখের সামনে কফিন দেখার অপেক্ষায়। এঁদের কেউ কেউ কয়েক কিলোমিটার পথ হেঁটে জানাজায় শরিক হন। হাঁটতে হাঁটতেই কথা হয় বেসরকারি চাকরিজীবী আমিরুল ইসলামের সঙ্গে। শাহবাগ এলাকা থেকে হাঁটা শুরু করেছেন তিনি। আমিরুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি রাজনীতি করি না। কিন্তু একজন নেত্রী দেশের মানুষের জন্য জীবনে এত অত্যাচার সহ্য করেছেন। তাঁর জানাজায় অংশ নিতে কয়েক কিলোমিটার হাঁটব, এতে আর কষ্ট কী?’
জানাজা শেষ হওয়ার পর অনেক কৌতূহলী মানুষ পরস্পরের কাছে জানতে চান, কত মানুষ হয়েছে। কিন্তু এর সঠিক হিসাব দেওয়া কি সম্ভব? সাধারণত, অনেক বড় রাজনৈতিক বা সামাজিক কর্মসূচিতে মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি হলে সেটাকে সমুদ্রের বিশালত্বের সঙ্গে তুলনা করে ‘জনসমুদ্র’ বলা হয়। খালেদা জিয়ার জানাজায় মানুষের উপস্থিতি অতীতের সব ‘জনসমুদ্র’ ছাড়িয়ে গেছে।
রাজধানীর আরও অনেক জায়গায় অনলাইনে ও মোবাইল ফোনে সরাসরি সম্প্রচার দেখে অসংখ্য মানুষ জানাজায় অংশ নেন। রাজধানীর বাইরে দেশের বিভিন্ন জেলায়ও মানুষ গায়েবানা জানাজায় শরিক হন বলে প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।
ময়মনসিংহ, খুলনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ রাতের আঁধার ভেঙে ঢাকায় এসেছেন। কেউ রাত তিনটায়, কেউ পাঁচটায় রওনা হয়েছেন—শুধু শেষশ্রদ্ধা জানাতে। রাজবাড়ী থেকে আসা জেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, খালেদা জিয়া একটা অনুভূতির নাম। তিনি চলে যাবেন—এটা মেনে নেওয়ার মতো নয়।
জানাজা উপলক্ষে মেট্রোরেলেও ছিল উপচেপড়া ভিড়। অনেক যাত্রী একাধিকবার চেষ্টা করেও ট্রেনে উঠতে পারেননি। অনেক অপেক্ষার পর তাঁরা গন্তব্যে পৌঁছেছেন। কিন্তু স্টেশনে নেমে অধিকাংশ যাত্রী কার্ড পাঞ্চ করতে পারেননি। বহির্গমন যাত্রীদের চাপে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দেয় একাধিক স্টেশনে। শেষ দিকে এসে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ-সংলগ্ন বিজয় সরণি, আগারগাঁও, ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজার মেট্রোস্টেশনের ভেতরেই অনেকে জানাজা পড়েন। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ফার্মগেটমুখী নামার অংশেও জানাজায় দাঁড়িয়েছেন এই সড়কে আসা মানুষ।
গতকাল সকাল ৯টা ১৭ মিনিটে বাংলাদেশের পতাকায় মোড়ানো অ্যাম্বুলেন্সে খালেদা জিয়ার মরদেহ এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে গুলশান অ্যাভিনিউর ১৯৬ নম্বর বাসভবনে নেওয়া হয়। মরদেহ ‘ফিরোজা’য় নেওয়ার কথা থাকলেও গাড়িটি নেওয়া হয় তারেক রহমানের বাসভবনে। সেখানে কফিনের পাশে বসে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করেন তারেক রহমান। পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও দলীয় নেতারা শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানান।
বেলা ১১টা ৫ মিনিটে সেখান থেকে মরদেহ নিয়ে জানাজার উদ্দেশে রওনা হন তারেক রহমান। গাড়িবহরে লাল-সবুজ রঙের সেই বাসটিও ছিল, যেটিতে তিনি দেশে ফিরে বিমানবন্দর থেকে জনসভাস্থলে গিয়েছিলেন। তারেক রহমানের সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী জুবাইদা রহমান, কন্যা জাইমা রহমান, আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রীসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। খালেদা জিয়ার কফিন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর মঞ্চে পৌঁছায় ২টা ৪৫ মিনিটে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও দলের জ্যেষ্ঠ নেতা নজরুল ইসলাম খানের বক্তব্যের পর জানাজা হয়। তারেক রহমান মায়ের জন্য সবার কাছে দোয়া চান।
খালেদা জিয়ার জানাজা ও দাফন ঘিরে ছিল ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা। মঙ্গলবার রাত থেকে বিজিবি মোতায়েন করা হয়। সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পুরো এলাকায় অবস্থান নেন। জানাজা শেষে সংসদ ভবন এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নিরাপত্তায় খালেদা জিয়ার মরদেহ জিয়া উদ্যানে নেওয়া হয়। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে মরদেহ নেওয়া হয় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধির কাছে। সমাধির কাছাকাছি পৌঁছানোর পর সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্যরা কফিন কাঁধে বহন করেন। ৪টা ৫০ মিনিটে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন সম্পন্ন হয়।
জানাজায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি, তিন বাহিনীর প্রধান, গণফোরামের ইমেরিটাস সভাপতি ড. কামাল হোসেন, জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়া দেশি-বিদেশি কূটনৈতিক, বিশিষ্টজন ব্যক্তিরা জানাজায় অংশ নেন।
জানাজায় অংশ নিতে নারীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেখানে নারীদের সঙ্গে তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান, কন্যা জাইমা রহমানসহ পরিবারের সদস্যরা অংশ নেন।
পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকার সরদার আয়াজ সাদিকও জানাজায় অংশ নেন এবং তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সহমর্মিতা জানান। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ঢাকায় এসে তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ভারতের শোকবার্তা হস্তান্তর করেন।
দাফনের সময় তারেক রহমানের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। পরে তাঁরা সবাই দাঁড়িয়ে শোক ও শ্রদ্ধা জানান।
জানাজার আগে বক্তব্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, খালেদা জিয়ার মৃত্যুর দায় থেকে ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা কখনো মুক্তি পাবেন না।
ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা থেকে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় দুই বছরের বেশি সময় অন্ধকার কারাগারে রাখা হয়। পায়ে হেঁটে কারাগারে ঢুকলেও তিনি বের হন চরম অসুস্থতা নিয়ে। পরে চার বছর গৃহবন্দী অবস্থায় তাঁকে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ না দেওয়ায় তাঁর শারীরিক অবস্থা আরও অবনতির দিকে যায়। চিকিৎসকদের মতে, উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবই শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়েছে।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, যারা তাঁকে জেলে পাঠিয়েছে, যারা তাঁকে গৃহহীন করেছে, তারা আজ পালিয়ে বেড়াচ্ছে। রান্না করা খাবার পর্যন্ত খেতে পারেনি। তিনি বলেন, ৪৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনের ৪১ বছর বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে ছিলেন খালেদা জিয়া। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম এবং মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী।
দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম, কারাবরণ, নিপীড়ন আর রাষ্ট্রক্ষমতার উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়া হয়ে উঠেছিলেন এক দৃঢ়চেতা নেত্রীর প্রতীক। বিদায় বেলায় দেশবাসীর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে প্রমাণ করে গেলেন, তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়।
জীবদ্দশায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই, বাংলাদেশই আমার ঠিকানা।’ দেশের মাটিতেই, স্বামী শহীদ জিয়াউর রহমানের পাশে, চিরদিনের জন্য শায়িত হলেন তিনি।