ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের নেতা–কর্মীরা। গতকাল সোমবার বিকেলে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে  ছাত্রদলের নেতা–কর্মীরা। গতকাল সোমবার বিকেলে

ডাকসু নির্বাচন: যে প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছে ছাত্রদলকে

ভোটের প্রচারের শুরু থেকে ছাত্রদলকে একটি প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছে। সেটি হলো, ছাত্রদল ডাকসুতে নির্বাচিত হলে গণরুম-গেস্টরুম সংস্কৃতি আবার ফিরে আসবে কি না। এর জবাব নির্বাচনী ইশতেহারের প্রথম দফাতেই স্পষ্ট করে দিয়েছে সংগঠনটি।

ছাত্রদলের প্যানেলের ইশতেহারে বলা হয়েছে, গেস্টরুম-গণরুম সংস্কৃতি, জোরপূর্বক রাজনৈতিক কর্মসূচি ও দমন-পীড়নের মতো ঘৃণিত চর্চা বন্ধ করে ক্যাম্পাসকে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলদারত্ব থেকে চিরকালের জন্য মুক্ত করবে তারা।

ছাত্রদলের প্যানেলের প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারে হলে হলে গিয়েও শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করছেন, গেস্টরুম-গণরুম সংস্কৃতি আর কোনোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরতে দেওয়া হবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন–সংকটের কারণে ‘গণরুম’–ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। এ ব্যবস্থায় এক কক্ষে অনেক শিক্ষার্থীকে গাদাগাদি করে থাকতে হতো। আর ‘গেস্টরুম সংস্কৃতি’র নামে হলের ভেতরে সাধারণত প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের অকথ্য গালিগালাজ, মানসিক নিপীড়ন, এমনকি শারীরিক নির্যাতন করা হতো। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকত, সেই দলের অনুগত ছাত্রসংগঠনের নেতারা এই কাজে জড়িত থাকতেন। আওয়ামী লীগের (এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ) সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে বিভিন্ন হলে ‘গেস্টরুম’ নির্যাতনের শিকার হন অসংখ্য সাধারণ শিক্ষার্থী। নির্যাতকের ভূমিকায় ছিলেন ছাত্রলীগের (এখন নিষিদ্ধ) নেতারা।

গণরুম-গেস্টরুমের প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে বিগত সরকারের সময়ে কোনো শিক্ষার্থীর হলে থাকা প্রায় অসম্ভব ছিল। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণরুম-গেস্টরুম সংস্কৃতির অবসান হয়েছে। এখন আর কোনো ছাত্রসংগঠনের কর্মসূচিতে যাওয়া বাধ্যতামূলক নয়, কনিষ্ঠ শিক্ষার্থীদের অনেকেই নিয়ম অনুযায়ী হলে আসন পেয়েছেন। এখন শিক্ষার্থীদের চাওয়া, মানবাধিকার লঙ্ঘনের সেই সংস্কৃতি আর যেন ফিরে না আসে।

ওই সংগঠনগুলো নানাভাবে শিক্ষার্থীদের মাথায় এটা ঢোকানোর চেষ্টা করছে যে ছাত্রদলকে ভোট দিলে গণরুম-গেস্টরুম ফিরবে।

গত রোববার ও গতকাল সোমবার ক্যাম্পাসে গিয়ে ছাত্রদলের প্যানেল সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের মধ্যে অনেকের ধারণা, আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করবে। আর বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল যদি ডাকসুতে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) জয়ী হয়, তাহলে অতীতের মতো গণরুম-গেস্টরুমের সংস্কৃতি ফিরে আসার আশঙ্কা রয়েছে। আবার কিছু কিছু ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলকে কোণঠাসা করার জন্য এ বিষয়কে ব্যবহার করছে বলেও মনে করেন অনেকে। ওই সংগঠনগুলো নানাভাবে শিক্ষার্থীদের মাথায় এটা ঢোকানোর চেষ্টা করছে যে ছাত্রদলকে ভোট দিলে গণরুম-গেস্টরুম ফিরবে।

গণরুম-গেস্টরুম সংস্কৃতি নিয়ে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে নানাভাবে অপপ্রচার চলছে উল্লেখ করে ভিপি (সহসভাপতি) প্রার্থী মো. আবিদুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিছু সংগঠন সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছে। ছাত্রদল গণরুম-গেস্টরুম সংস্কৃতির মূল উৎপাটন করবে।’

ভোটের হিসাবে দলীয় ও আঞ্চলিক বিবেচনা

শিক্ষার্থীদের অনেকে বলেছেন, প্যানেল ঘোষণার আগপর্যন্ত নির্বাচনকেন্দ্রিক বিভিন্ন আলোচনায় ছাত্রদল পিছিয়ে ছিল। কিন্তু প্যানেল ঘোষণার পর ছাত্রদলের প্রার্থীদের সক্রিয়তা সেই ধারণা বদলে দিচ্ছে।

১৯৯০ সালের ডাকসু নির্বাচনে জয় পেয়েছিল ছাত্রদলের প্যানেল। এবারের নির্বাচনের প্রচারে ‘নব্বইয়ের হাওয়ার পুনরাবৃত্তির’ বিষয়টিকে সামনে রাখছেন ছাত্রদলের প্রার্থীরা। শিক্ষার্থীদের ভোট পেতে অনলাইনের পাশাপাশি সশরীর হলে হলে যাচ্ছেন তাঁরা।

ছাত্রদলের প্যানেলের প্রচার কমিটির দায়িত্বে থাকা দুজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, নানা সূত্র ব্যবহার করে তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বিএনপি-সমর্থক পরিবারের সন্তানদের একটি তালিকা তৈরি করছেন। তাঁদের ধারণা, এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সাত হাজার হবে। তালিকা তৈরি হয়ে যাওয়ার পর ওই শিক্ষার্থীদের কাছেও পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন তাঁরা।

এবারের ডাকসু নির্বাচনে ‘ফ্যাক্টর’ মনে করা হচ্ছে ছাত্রীদের ভোট এবং জগন্নাথ হলের ভোটকে। ছাত্রদলের প্যানেলে ছাত্রী দুজন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী একজন ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দুজন শিক্ষার্থী রয়েছেন।

ছাত্রদল সূত্র জানায়, ভিপি প্রার্থী আবিদুলের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার অনেক শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। সংখ্যাটি দুই হাজারের মতো। তাঁদের উল্লেখযোগ্য অংশের ভোট তিনি পাবেন বলে আশাবাদী ছাত্রদলের নেতারা। এ ছাড়া ছাত্রদলের নিজস্ব ভোটও আছে। সব মিলিয়ে ভিপি পদে তিনি সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন।

জিএস (সাধারণ সম্পাদক) পদে ছাত্রদলের প্রার্থী শেখ তানভীর বারী হামিম খুলনার ছেলে। তাঁর পরিবারও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। খুলনার শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশের ভোট তিনি পেতে পারেন। ছাত্রদলের হিসাবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খুলনা বিভাগের শিক্ষার্থী প্রায় ১০ হাজার।

এবারের ডাকসু নির্বাচনে ‘ফ্যাক্টর’ মনে করা হচ্ছে ছাত্রীদের ভোট এবং জগন্নাথ হলের ভোটকে। ছাত্রদলের প্যানেলে ছাত্রী দুজন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী একজন ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দুজন শিক্ষার্থী রয়েছেন।

এবারের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রী ভোটার ১৮ হাজার ৯৫৯ জন, যা মোট ভোটারের প্রায় ৪৮ শতাংশ। মোট ভোটার ৩৯ হাজার ৮৭৪ জন। ছাত্রদলের প্রার্থীরা তাঁদের প্রচারে ছাত্রীদের দৈনন্দিন নানা সমস্যাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। ছাত্রদলের প্যানেল তাদের ইশতেহারের দ্বিতীয় দফায় বলেছে, নির্বাচিত হলে নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তুলবে। নারী শিক্ষার্থীদের পোশাকের স্বাধীনতা, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সর্বোচ্চ সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা। একই সঙ্গে ‘সান্ধ্য আইন’ বিলোপের মাধ্যমে ছাত্রীদের হলে রাতে প্রবেশের সময়সীমা বৃদ্ধি করতে কাজ করবে ছাত্রদল।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা জগন্নাথ হলে থাকেন। এই হলে ভোটার ২ হাজার ২২২ জন, যা মোট ভোটারের প্রায় ৬ শতাংশ। ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বর্তমান সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় (সাহস) জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থী। এই হলে ছাত্রদলের সাংগঠনিক কার্যক্রম আছে। এখানে তারা কমিটিও দিয়েছে। ছাত্রদল মনে করছে, এই হলের ভোটের উল্লেখযোগ্য অংশ তাদের প্যানেলের প্রার্থীরা পাবেন।

আমাদের বিরুদ্ধে নানা রকম অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। তবে আমরা মনে করি, এবারের ডাকসুতে নব্বইয়ের পুনরাবৃত্তি হবে। ছাত্রদল সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থীর ম্যান্ডেট পাবে।
ছাত্রদলের জিএস প্রার্থী শেখ তানভীর বারী

হল সংসদের চিত্র

ডাকসুর পাশাপাশি ১৮টি হল সংসদে ঘোষিত প্যানেল আছে শুধু ছাত্রদলের। এর মধ্যে ১৪টি হলে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল আছে। আর ছাত্রীদের চারটি হলে তাদের আংশিক প্যানেল আছে। ডাকসু ও হল সংসদের নির্বাচন হবে ৯ সেপ্টেম্বর।

ছাত্রদলের নিজস্ব মূল্যায়ন হলো জগন্নাথ হল, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, বিজয় একাত্তর হল ও স্যার এ এফ রহমান হল সংসদে তাদের ভিপি-জিএস-এজিএস প্রার্থীরা এগিয়ে থাকবেন। তবে ছাত্রীদের পাঁচটি হলে ছাত্রদলের ফল কেমন হবে, তা নিয়ে তারা সন্দিহান।

তবে বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেসব হল সংসদে ছাত্রদলের প্রার্থীরা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকার কথা বলা হচ্ছে, সেসব হলে ভিপি-জিএস-এজিএস প্রার্থীদের কেউ কেউ শিক্ষার্থীদের কাছে তেমন পরিচিত নন। কোথাও কোথাও তাঁদের প্যানেলের প্রার্থীদের মধ্যে ঐক্যের ঘাটতি আছে।

এ বিষয়ে ছাত্রদলের জিএস প্রার্থী শেখ তানভীর বারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে নানা রকম অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। তবে আমরা মনে করি, এবারের ডাকসুতে নব্বইয়ের পুনরাবৃত্তি হবে। ছাত্রদল সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থীর ম্যান্ডেট পাবে।’