তারেক রহমান
তারেক রহমান

ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষণ

তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ১৭ বছরের নির্বাসন জীবনের অবসান ঘটিয়ে এক সন্ধিক্ষণে দেশে ফিরছেন। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, আসন্ন নির্বাচনে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপিই সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। তবে সে পথ এখনো নিষ্কণ্টক নয়। রয়েছে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ। এসব আশা ও দোলাচল নিয়ে লিখেছেন ব্রাসেলসভিত্তিক অলাভজনক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) থমাস কিয়ান। আইসিজির বাংলাদেশ ও মিয়ানমারবিষয়ক জ্যেষ্ঠ এ কনসালট্যান্টের বিশ্লেষণটি গতকাল বুধবার সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে, তা হুবহু অনুবাদ করা হলো।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আজ বৃহস্পতিবার রাজধানী ঢাকায় পৌঁছেছেন। এর মধ্য দিয়ে তাঁর ১৭ বছরের স্বেচ্ছানির্বাসনের অবসান ঘটেছে। জাতীয় নির্বাচনের মাত্র দুই মাসেরও কম সময় আগে তিনি দেশে ফিরে এসেছেন।

আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। গত বছরের আগস্টে ব্যাপক গণ-আন্দোলনের মুখে দীর্ঘদিনের শাসক শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশটিতে এটিই প্রথম নির্বাচন। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারছে না, তা ছাড়া শেখ হাসিনাও দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন।

এই প্রেক্ষাপটে ফেব্রুয়ারির আসন্ন নির্বাচনে বিএনপিই এগিয়ে আছে বলে ধরা হচ্ছে। দলটির নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলে তারেক রহমানই পরবর্তী সরকারপ্রধান হবেন—এই ধারণা ক্রমে জোরালো হচ্ছে।

তারেক রহমান বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তিনি ১৯৮১ সালে আততায়ীর গুলিতে নিহত সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং দুইবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সন্তান। ১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকে দুইবার (তবে নথিপত্র অনুযায়ী তিনবার) প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী খালেদা অসুস্থ হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি এখনো বিএনপির চেয়ারপারসন। তবে মায়ের অসুস্থতার কারণে এক দশক ধরে লন্ডন থেকে দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন তারেক রহমান।  

গত বছর শেখ হাসিনার আকস্মিক পতনের আগপর্যন্ত তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন অসম্ভব বলে মনে হচ্ছিল। তিনি ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ ছেড়েছিলেন। তখন দেশ সামরিক-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়েছিল, তিনি চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাচ্ছেন।

তারেক রহমানের দেশ ত্যাগের কয়েক মাসের মধ্যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। দেশে উপস্থিত না থেকেও তিনি একাধিক অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হন। কিন্তু তিনি সব সময় দাবি করে এসেছেন, এসব অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। চলতি বছরের শুরুতে দেশের হাইকোর্ট এসব অভিযোগ বাতিল করে দিয়েছেন।

গত জুনে তারেক রহমান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে নির্বাচন ও সংবিধান সংস্কার নিয়ে (লন্ডনে) একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছান। এর মধ্য দিয়ে তাঁর প্রত্যাবর্তনের পথ সুগম হয়।

বিএনপির নেতারা তারেক রহমানের আগমন উপলক্ষে দলের ‘সবচেয়ে বড় শোভাযাত্রা’ করেছেন। তাঁরা আশা করেন, নির্বাচনী প্রচারে তাঁর উপস্থিতি বিএনপির সম্ভাবনাকে জোরদার করবে।

তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন বিএনপির জন্য একটি বড় প্রেরণা। কমতে থাকা জনপ্রিয়তা নিয়ে দলটির নেতাদের উদ্বিগ্ন বলে মনে হয়। তবে এ জন্য তাঁরা দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও সহিংসতার ‘ভিত্তিহীন প্রচার’-কে দায়ী করছেন।

বিপরীতে দেশটির বৃহত্তম ইসলামি দল এবং বিএনপির একসময়কার মিত্র জামায়াতে ইসলামীর প্রতি সমর্থন বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে, বিশেষ করে সেই সব তরুণদের মধ্যে, যাঁরা প্রচলিত রাজনীতি নিয়ে হতাশ। কিন্তু এখনো বিএনপিই জিতবে বলে মনে করা হচ্ছে।

তবে অল্প সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জিতলে তা দলটির জন্য হতাশাজনক ফল হিসেবে ধরা হবে। এতে করে জামায়াত নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম পেয়ে যাবে এবং তা দলটিকে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করবে।তারেক রহমানের আগমন বিএনপিকে উদ্দীপ্ত করলেও অনিশ্চয়তা কম নয়। তিনি এত দিন বিদেশ থেকে দলকে দক্ষতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর একটি বড় কৃতিত্ব হলো ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনের আগে দলের ভাঙন রোধ করতে পারা। বিএনপির বিপুলকর্মী তাঁর প্রতি অগাধ আনুগত্য পোষণ করেন।

ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে তারেক রহমান বাংলাদেশের কঠিন রাজনীতির ঝড়ঝাপটা থেকে নিজেকে কিছুটা রক্ষা করতে পেরেছিলেন। কিন্তু এখন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের পরবর্তী ধাপের সাফল্য নির্ভর করছে কিছু বিষয়ের ওপর।

এর মধ্যে রয়েছে—তিনি হতাশ তরুণ ভোটারদের মন জয় করতে পারবেন কি না, বার্তা সুস্পষ্ট করতে পারবেন কি না, প্রার্থী নির্বাচনের দ্বন্দ্বে বিভক্ত দলকে একত্র করতে পারবেন কি না, সর্বোপরি উত্তাল এক কালপর্ব থেকে বের হয়ে আসা একটি জাতিকে প্রত্যাশিত উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দিতে পারবেন কি না।