
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ (সর্বাত্মক অবরোধ) কর্মসূচির দ্বিতীয় দিন ছিল ১৯ জুলাই, শুক্রবার। এদিন ব্যাপক বিক্ষোভ, সংঘর্ষ ও সংঘাতে সারা দেশে অন্তত ৫৬ জন নিহত হন। এর মধ্যে শুধু রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গুলি ও সংঘর্ষে অন্তত ৪৪ জন নিহত হন।
এদিন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, পুলিশ, সাংবাদিক, পথচারীসহ বিপুলসংখ্যক মানুষ আহত হন। রাজধানীর রামপুরা-বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী ও উত্তরায় ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ দমাতে হেলিকপ্টার থেকে এদিন কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়।
কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সমর্থনে এদিন বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ‘জাতীয় ঐক্য সমাবেশ ও মিছিলের’ কর্মসূচি দিয়েছিল বিএনপি। এ সমাবেশকে কেন্দ্র করে দলটির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়।
সেদিন তোপখানা রোডে গণতন্ত্র মঞ্চের মিছিল লক্ষ্য করে পুলিশ ছররা গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে এবং লাঠিপেটা করে। পল্টন এলাকায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়।
শুরু থেকে এ আন্দোলনে ছিলেন শুধু শিক্ষার্থীরা। তবে ১৯ জুলাই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় লোকজনকেও অংশ নিতে দেখা যায়। শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে ‘মৃত্যু এত সহজ কেন?: সন্তানের পাশের অভিভাবক’ শিরোনামে ‘সর্বস্তরের অভিভাবক সমাজ’-এর ব্যানারে সমাবেশের আয়োজন করা হয়। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে মৌন প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন ছোট পর্দা ও মঞ্চের অভিনয়শিল্পী, আবৃত্তিশিল্পীসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
এ দিনও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ ছিল। এক বিবৃতিতে দ্রুত ইন্টারনেট পরিষেবা চালুর দাবি জানায় সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ।
এ দিন রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই বৈঠকের পর (১৯ জুলাই) রাত ১২টা থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি এবং সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মুখসারির সমন্বয়কদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও তৎপরতা ছিল। ১৯ জুলাই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম (বর্তমানে এনসিপির আহ্বায়ক), আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া (বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা) ও আবু বাকের মজুমদারকে (বর্তমানে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের আহ্বায়ক) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। সন্ধ্যার পর ধানমন্ডি থেকে বাকেরকে, রাত ১১টার দিকে হাতিরঝিলের মহানগর আবাসিক এলাকা থেকে আসিফকে ও মধ্যরাতে খিলগাঁওয়ের নন্দীপাড়া এলাকা থেকে নাহিদকে তুলে নেওয়া হয়।
ওই সময় সরকারের দমন-পীড়নের বিষয়টি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারফিউ জারির পর থেকে জুলাই মাসের শেষ পর্যন্ত পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনী যৌথভাবে এলাকা ধরে বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করে, যা ‘ব্লক রেইড’ নামে পরিচিত। এটি ছিল গণগ্রেপ্তার অভিযানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ এবং বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলন দমন করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছিল।
১৯ জুলাই রাত সাড়ে নয়টার দিকে ৯ দফা দাবিতে আবারও ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল কাদের (এখন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের নেতা)। ৯ দফার প্রথম দাবিটি ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে।
দ্বিতীয় দাবি ছিল, ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে মন্ত্রিপরিষদ ও দল থেকে পদত্যাগ করতে হবে।
৩. ঢাকাসহ যত জায়গায় ছাত্র শহীদ হয়েছেন, সেখানকার ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ সুপারদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে।
৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টরকে পদত্যাগ করতে হবে।
৫. যে পুলিশ সদস্যরা গুলি করেছেন, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ যেসব সন্ত্রাসী শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলা পরিচালনা করেছে এবং পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছে, তাদের আটক করে এবং হত্যা মামলা দায়ের করে দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার দেখাতে হবে।
৬. দেশব্যাপী যেসব শিক্ষার্থী ও নাগরিক শহীদ ও আহত হয়েছেন, তাঁদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।
৭. ঢাবি, জাবি, চবি, রাবিসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ নামক সন্ত্রাসী সংগঠনসহ দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে ছাত্র সংসদকে কার্যকর করতে হবে।
৮. অবিলম্বে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হলসমূহ খুলে দিতে হবে।
৯. যেসব ছাত্র কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁদের কোনো ধরনের একাডেমিক ও প্রশাসনিক হয়রানি না করার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে।
আন্দোলনকারীদের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল কাদের ৯ দফা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন।
একই দিন মধ্যরাতে আন্দোলনের তিনজন সমন্বয়ককে আট দফা দাবি সামনে আনতে দেখা যায়। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে তা প্রচারও করা হয়। বলা হয়, এর আগে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এবং তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতের সঙ্গে বৈঠক করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ ও সহসমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম। সারজিস ও হাসনাত এখন এনসিপির নেতা আর হাসিব গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের নেতা।
অবশ্য ওই আট দফার মধ্যে ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে’—এই দাবি ছিল না। আট দফার প্রথম দাবি ছিল তদন্ত সাপেক্ষে হত্যায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে হবে; দ্বিতীয় দাবি ছিল, দায়ীদের গ্রেপ্তার করে দ্রুত বিচার করতে হবে।
তবে সারা দেশে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের মধ্যে তখন ৯ দফার প্রতি বেশি সমর্থন তৈরি হয়েছিল। ৯ দফা দাবির বিষয়ে গত বুধবার আব্দুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৭ জুলাই গায়েবানা জানাজায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশ আমাদের ওপর গুলি চালায়। আমিসহ কয়েকজন আহত হই, আবদুল হান্নান মাসউদ (এখন এনসিপির নেতা) গুলিবিদ্ধ হয়। তখন থেকেই আমরা আন্দোলন পরিচালনা করে যাওয়ার স্বার্থে কৌশলী অবস্থান নিয়ে গ্রেপ্তার এড়ানোর সিদ্ধান্ত নিই। বারবার জায়গা পরিবর্তন করছিলাম। ১৬ জুলাইয়ের একটি অনলাইন বৈঠকের আলোচনা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন দাবি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সেক্রেটারি এস এম ফরহাদের সঙ্গে আলোচনা করে সমন্বিতভাবে ৯ দফা তৈরি করা হয়েছিল।’