
ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ১২টা বেজে ৪০ মিনিট। রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের উদ্দেশে যখন হাঁটা শুরু করলাম, আমার সঙ্গী তখন হাজার হাজার মানুষ। প্রত্যেকের গন্তব্যস্থল একটিই—মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ; বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জানাজাস্থল। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ পায়ে হেঁটেই খালেদা জিয়ার জানাজায় অংশ নিতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এই কাতারে যুক্ত হন ঢাকার বাইরে থেকে আসা লোকজনও। দলমত–নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ ছুটছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে শেষ বিদায় জানাতে।
কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ ধরে যতই এগিয়ে যাচ্ছিলাম, মানুষের উপস্থিতি ততই বাড়ছিল। মূল সড়কের দুই পাশে মানুষ, ফুটওভারব্রিজে মানুষ, রাস্তার পাশের বিভিন্ন ভবনের ছাদে মানুষ—ঢাকা শহর যেন শোকযাত্রার নগরীতে পরিণত হয়। কেউ স্লোগান দিচ্ছেন না, কেউ নির্দেশনা দিচ্ছেন না, তবু সবাই একই দিকে যাচ্ছে। এক নীরব শৃঙ্খলা, যা কেবল শোক থেকেই জন্ম নেয়।
জানাজাস্থলের দিকে ছুটতে থাকা হাজার হাজার মানুষের সবাই বিএনপির নেতা–কর্মী নন। এঁদের মধ্যে ছিলেন সাধারণ পেশাজীবীরাও। এঁদের কেউ পাঁচ কিলোমিটার, কেউ সাত কিলোমিটার হেঁটে পাড়ি দিচ্ছেন। হাঁটতে হাঁটতেই কথা হয় বেসরকারি চাকরিজীবী আমিরুল ইসলামের সঙ্গে। শাহবাগ এলাকা থেকে হাঁটা শুরু করেছেন তিনি। আমিরুল বলেন, ‘আমি রাজনীতি করি না। কিন্তু একজন নেত্রী দেশের মানুষের জন্য জীবনে এত অত্যাচার সহ্য করেছেন। তাঁর জানাজায় অংশ নিতে কয়েক কিলোমিটার হাঁটব, এতে আর কষ্ট কী?’
মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর দিকে যত এগোচ্ছি, মানুষের ঢল তত ঘন হচ্ছে। ফার্মগেট মোড় পর্যন্ত পৌঁছাতেই হাঁটার গতি কমাতে হলো। সামনে মানুষ আর মানুষ। কেউ দলবদ্ধভাবে, কেউ একা। অনেকের মাথায় টুপি। কারও কারও হাতে বাংলাদেশের পতাকা—সবার লক্ষ্য সামনের দিকে যাওয়া।
বড় ভাইয়ের হাত ধরে জানাজায় অংশ নিতে এসেছে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আদনান। সামনের ভিড় ঠেলে বারবার এগিয়ে যেতে চাইলেও ব্যর্থ হচ্ছিল তাঁরা। আদনান প্রথম আলোকে বলে, ‘অনেক ইচ্ছা ছিল একেবারে সামনের দিকে দাঁড়িয়ে জানাজা পড়ার। কিন্তু যেতে পারব বলে মনে হচ্ছে না।’ শুধু আদনানরাই নয়, প্রায় সবাই এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের দিকে। তবে বেশির ভাগই ব্যর্থ হচ্ছিলেন। সে সময় সামনের দিকে এগোনোর চেষ্টা করছিলেন নীলফামারী থেকে আসা বিএনপির কর্মী রিয়াজুল ইসলাম। তিনিও ব্যর্থ হন। ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে ফেলেছিলেন সঙ্গীকেও। বারবার ফোনে চেষ্টা করেও তাঁকে পাচ্ছিলেন না। রিয়াজুল প্রথম আলাকে বলেন, ‘গতকাল রাতে রওনা দিয়ে বেলা ১১টার দিকে ঢাকায় পৌঁছেছি। দেশনেত্রীকে শেষবারের মতো বিদায় জানাতে কারওয়ান বাজার থেকে হেঁটে আসছি।’
একপর্যায়ে সামনের দিকে এগোতে না পেরে মূল সড়কের দুই পাশে কাতার ধরে বসে পড়তে শুরু করে মানুষ। কেউ আগে থেকে আনা পাটি বিছিয়ে কেউ আবার সংবাদপত্রের পাতা বিছিয়ে বসে পড়েন মূল সড়কে। এর মধ্যেই জোহরের নামাজের সময় হয়ে যাওয়াই সড়কেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে নামাজ আদায় করেন অনেকে।
একপর্যায়ে ভিড় সড়ক ছাড়িয়ে ফার্মগেটে যেখানে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নেমেছে, সেখানে ছড়িয়ে পড়ে। সড়কে জায়গা না পেয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ উঠে যায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে। এ সময় কথা হয় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফেরদৌস নাভিদের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সকালে গুলশানে গিয়েছিলাম খালেদা ম্যাডামকে একবার দেখতে। সেখান থেকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলাম। তবে এক্সপ্রেসওয়ের নামার অংশে আটকে গেলাম।’
দূর থেকে মাইকে তখন বাজছে খালেদা জিয়ার কণ্ঠ, ‘দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নাই, এটাই আমার ঠিকানা। এই দেশ, এই দেশের মাটি-মানুষই আমার সবকিছু। কাজেই আমি দেশের বাইরে যাব না।’ খালেদা জিয়া ছিলেন গৃহবধূ। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০ মে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের হাতে নিহত হন। নেতৃত্বের ষড়যন্ত্রে বিএনপি পড়ে যায় অথই সাগরে। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি খালেদা জিয়া বিএনপিতে যোগ দেন। প্রথমে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান, পরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আর শেষে চেয়ারপারসন হন। তখন তাঁর বয়স ছিল চল্লিশের নিচে।
১৯৮২ সালে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে ১৯৮৩ সালে স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নামেন খালেদা জিয়া। তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয় ৭–দলীয় ঐক্যজোট। দীর্ঘ ৯ বছরের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে পরিচিতি পান। ’৯০-এর গণ-আন্দোলনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অভাবনীয় জনসমর্থন পেয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। খালেদা জিয়া দেশের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন। পরে আরও দুবার তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে জনস্রোতের সৃষ্টি হয় জানাজাস্থল এলাকায়। অনেক চেষ্টার পরেও ফার্মগেটের তেজগাঁও কলেজের বেশি এগোনো সম্ভব হলো না। জায়গা না পেয়ে অসংখ্য মানুষ তখন পেছনের দিকে ফিরে আসছিলেন। সেই ঢলের ধাক্কায় শুরু হলো ভয়ানক এক পরিস্থিতি। কেউ সামনে এগোনোর চেষ্টা করছিলেন, কেউ পেছনের দিকে আসছিলেন। তীব্র ভিড়ের মধ্যে দিশা হারিয়ে ফেলেন দুই বৃদ্ধ। ওই পরিস্থিতিতেই তাঁদের একজন জানান, তাঁরা দুজনই কাঁঠালবাগান এলাকার বাসিন্দা। সরকারি চাকরিতে একসময় সহকর্মী ছিলেন, বর্তমানে দুজনই অবসরে। খালেদা জিয়ার জানাজায় অংশ নিয়ে ইতিহাসের সাক্ষী হতে এসেছিলেন তাঁরা। তবে প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে কিছুটা বেকায়দায় পড়েছেন।
ভিড় ঠেলে আবার কারওয়ান বাজারের দিকে ফিরতে শুরু করলে চোখে পড়ে এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য। হাজার হাজার মানুষ সড়কে কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। তাঁদের অপেক্ষা মাইকে ভেসে আসা জানাজা শুরুর নির্দেশনার জন্য।
প্রায় ৪৩ বছর খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন। গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে এসে ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন এক দৃঢ়চেতা, সাহসী নেত্রী। বিপদে-দুর্যোগে বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছিলেন তিনি।
ফিরতে ফিরতে মনে হলো, এই জনসমাগম শুধু কোনো দলীয় প্রধানের জন্য নয়, দেশের সাবেক একজন নেতার প্রতি সব শ্রেণি–পেশার মানুষের ভালোবাসারও প্রকাশ।