
ইসলাম মানুষকে দুনিয়ায় শান্তি ও পরকালে মুক্তির নির্দেশনা দিয়েছে। মানবজীবনের অন্যতম প্রধান বিষয় হলো অর্থনীতি, ইসলাম এ ক্ষেত্রেও সর্বোত্তম ব্যবস্থা দিয়েছে। সেই ব্যবস্থার নাম হলো জাকাত। জাকাত ইসলামের প্রাণ, ইসলামি সমাজব্যবস্থা ও সুষ্ঠু অর্থনীতির জীবনীশক্তি। পবিত্র কোরআনে কারিমের শুরুতেই হেদায়েতপ্রাপ্ত সফল মুত্তাকিগণের পঞ্চস্তুতির দ্বিতীয়টিই উল্লেখ করা হয়েছে জাকাত। ‘আর তারা নামাজ কায়েম করে এবং আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে।’ (সূরা বাকারা: ৩)। হাদিস শরিফে ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের তৃতীয়টি বলা হয়েছে জাকাত। ‘ইসলাম পাঁচটি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত—সাক্ষ্য দেওয়া যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং নিশ্চয় হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বান্দা ও রাসুল; নামাজ কায়েম করা; জাকাত প্রদান করা; হজ করা; রমজানে রোজা রাখা।’ (বুখারি, মুসলিম)। জাকাত অর্থ ‘পবিত্রতা’ ও ‘প্রবৃদ্ধি’। যেহেতু জাকাত প্রদানে সম্পদ পবিত্র হয় এবং বরকত হয়, তাই এর নাম জাকাত। পরিভাষায় জাকাত হলো, ‘নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে বিশেষ শর্তে নির্ধারিত খাতে নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ ব্যয় করা।’
জাকাত শব্দটি পবিত্র কোরআনে ৩২ বার রয়েছে, নামাজের সঙ্গে ২৬ বার; স্বতন্ত্রভাবে চারবার; পবিত্রতা অর্থে দুবার। জাকাত কখনো সদাকাত, কখনো ইনফাক শব্দ দ্বারা বোঝানো হয়েছে। ইনফাক শব্দটি ব্যাপক, সদাকাহ শব্দটি সাধারণ ও জাকাত শব্দটি বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কখনো এর ব্যতিক্রমও হয়েছে, অর্থাৎ এ তিনটি শব্দ একে অন্যের স্থলে ব্যবহৃত হয়েছে।
জাকাত পবিত্রতা অর্থে এসেছে—সূরা কাহাফ: ৮১; সূরা মারিয়াম: ১৩। স্বতন্ত্রভাবে: সূরা আরাফ: ১৫৬; সূরা মুমিনুন: ৪; সূরা রুম: ৩৯; সূরা হা-মীম সাজদাহ: ৭। জাকাত সালাতের সঙ্গে- সূরা বাকারা: ৪৩, ৮৩, ১১০, ১৭৭, ২৭৭; সূরা নিসা: ৭৭, ১৬২; সূরা মায়িদা: ১২ ও ৫৫; সূরা তাওবা: ৫, ১১, ১৮ ও ৭১; সূরা মারিয়াম: ৩১ ও ৫৫; সূরা আম্বিয়া: ৭৩; সূরা হাজ: ৪১ ও ৭৮; সূরা নুর: ৩৭ ও ৫৬; সূরা নামল: ৩; সূরা লুকমান: ৪; সূরা আহজাব: ৩৩; সূরা মুজাদালা: ১৩; সূরা মুজাম্মিল: ৩০; সূরা বাইয়িনা: ৫।
জাকাত করুণার দান নয়, জাকাত হলো গরিবের পাওনা; যা আল্লাহ ধনীর সম্পদের সঙ্গে রেখেছেন। যেহেতু মালিক বা পাওনাদারকে তার সম্পদ বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সুতরাং তা সসম্মানে দেওয়াই বাঞ্ছনীয়।
অবৈধ সম্পদের ব্যবহার ও জাকাত: ইসলামি বিধানে নিষিদ্ধ উপায়ে অর্জিত বা প্রাপ্ত সম্পদকে অবৈধ সম্পদ বলা হয়। যেমন: চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, লুট, চাঁদাবাজি, দখল, সুদ, ঘুষ ও মাদক ব্যবসা ইত্যাদি। অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদের মালিকানা স্বীকৃত হয় না। এ সম্পদ তার প্রকৃত মালিককে ফেরত দিতে হবে। প্রকৃত মালিকের অবর্তমানে তার ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারীদের প্রদান করতে হবে। তা সম্ভবপর না হলে প্রকৃত মালিকের পক্ষ থেকে (তার সওয়াবের নিয়তে) দান করে দিতে হবে। নিষিদ্ধ বা অবৈধ কাজের বিনিময়ে অর্জিত অর্থ-সম্পদ দান করে দিতে হবে। ফেরত দেওয়া যাবে না; কারণ ফেরত দিলে অপরাধীকে সহযোগিতা করা হবে। প্রাপ্ত সুদ ও অনুরূপ অর্থ-সম্পদ দান করে দিতে হবে। ফেরত দেওয়া বা গ্রহণ না করা সমীচীন নয়। কারণ, এতে ওই অবৈধ কারবারিরাই আরও বেশি লাভবান হবে। কোনো অবৈধ সম্পদ যার কাছ থেকে আহরিত হয়েছে, যদি সে-ও প্রকৃত মালিক না হয়, তথা অবৈধ মালিক হয় এবং নিশ্চিত হওয়া যায় যে সে–ও চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, লুট, চাঁদাবাজি, দখল, সুদ, ঘুষ ও মাদক ব্যবসা ইত্যাদি দ্বারা এ সম্পদ অর্জন করেছে; তবে সে সম্পদ তাকে ফেরত না দিয়ে দান-খয়রাত করে দিতে হবে। অবৈধ অর্থ-সম্পদের জাকাত দেওয়া অর্থহীন।
‘নিম্ন-হীন-তুচ্ছ কাজে’ অবৈধ সম্পদ ব্যয়?: সুদের টাকা ও অবৈধ অর্থ-সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রে অনেকে বলে থাকেন, তা কোনো ‘নিম্ন-হীন-তুচ্ছ’ কাজে ব্যয় করা উচিত। যাতে বোঝা যায় এটি ঘৃণিত বস্তু। এটি আসলে তেমন প্রজ্ঞাপ্রসূত নয়। কারণ, কোনো ভালো কাজই ‘নিম্ন-হীন-তুচ্ছ’ নয়। যেমন কেউ যদি কোনো এলাকায় প্রয়োজনমতো টয়লেট তৈরি করে দেয়, তবে মানুষ এ কাজকে ভালোই বলবে, খারাপ কাজ বলবে না। মূল কথা হলো, যেহেতু এ ব্যক্তি এ অর্থ-সম্পদের প্রকৃত মালিক নয়, তাই এ অর্থ-সম্পদ ব্যয়ে সে সওয়াবের আশা যেমন করবে না, তেমনি দুনিয়াতেও যেন এর বিনিময়ে কোনো প্রাপ্তি না ঘটে, সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। অর্থাৎ সে অবৈধ অর্থ-সম্পদ দান করার ক্ষেত্রে এই দ্বিতীয় প্রকার সুবিধাও না পাওয়ার জন্য নিজেকে যথাসাধ্য গোপন করবে এবং ব্যয়ের ক্ষেত্রে দেখবে কোনটি বেশি প্রয়োজনীয় ও উপকারী? সে খাতেই ব্যয় করবে। এটাই বিজ্ঞতার দাবি।
জাকাত ব্যয়ের খাতগুলো: পবিত্র কোরআনুল কারিমে ঘোষণা হয়েছে, ‘মূলত সদাকাত হলো ফকির, মিসকিন, জাকাত সংগ্রহকারী কর্মী, অনুরক্ত ব্যক্তি, কৃতদাস, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, আল্লাহর পথে জিহাদ ও বিপদগ্রস্ত বিদেশি মুসাফিরের জন্য। এটি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞানী ও পরম কৌশলী।’ (সূরা তাওবাহ: ৬০)। সদাকাত প্রদানে অগ্রাধিকার প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এমন অভাবী লোক, যারা আল্লাহর পথে নিজেদের নিয়োজিত রাখার কারণে (উপার্জনের জন্য) দুনিয়া চষে বেড়াতে পারে না। সম্ভ্রান্ততার কারণে অনভিজ্ঞ লোকেরা তাদের অভাবহীন মনে করে। আপনি তাদের চিহ্ন দেখে চিনতে পারবেন। তারা মানুষের কাছে নির্লজ্জভাবে ভিক্ষা করে না। আর তোমরা যেকোনো উত্তম জিনিস ব্যয় করো, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা সে বিষয়ে অবগত আছেন।’ (সূরা বাকারা: ২৭৩)। এ খাতগুলোর মধ্যে যুগচাহিদা ও গুণাগুণ বিবেচনায় রেখে নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। এতে জাকাত আদায় হওয়ার পাশাপাশি নিয়ত অনুযায়ী ক্ষেত্রবিশেষে সওয়াবেরও তারতম্য হবে।
জাকাত প্রদানের উপকারিতা: পবিত্র কোরআনুল কারিমে ঘোষণা হয়েছে, ‘আল্লাহ সুদকে নিঃশেষ করে দেন, সদাকাতকে প্রবৃদ্ধি ঘটান; আর আল্লাহ অপরাধী কাফিরদের পছন্দ করেন না।’ (সূরা বাকারা: ২৭৬)। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘দাতা আল্লাহর কাছে, মানুষের কাছে, জান্নাতেরও কাছে; জাহান্নাম থেকে দূরে। সাধারণ দাতা কৃপণ আবেদ অপেক্ষা আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়।’ (তিরমিজি শরিফ)। এ ছাড়া জাকাতের সামাজিক অনেক সুফল রয়েছে—
অর্থের প্রবাহ: জাকাত প্রদান করলে নগদ অর্থ হাতবদল হয়। এতে সম্পদে গতিশীলতা আসে। যাতে প্রচুর লোক ক্রয়ক্ষমতা অর্জন করে, তাতে চাহিদা বা ভোক্তা সৃষ্টি হয়। ক্রেতা সৃষ্টি হলে উৎপাদন বৃদ্ধি হয়, শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা হয়, কর্মসংস্থান হয়। ফলে জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হয়।
দারিদ্র্য বিমোচন: সঠিকভাবে জাকাত আদায় করলে সমাজের দারিদ্র্য দূরীভূত হবে, অপরাধপ্রবণতা কমবে এবং আর্থসামাজিক বিপর্যয় থেকে জাতি রক্ষা পাবে। সর্বোপরি সুদের নাগপাশ থেকে মুসলমানরা রক্ষা পাবে।
মানবিক উন্নয়ন: জাকাত আদায়ের মাধ্যমে খাই খাই মানসিকতার অবসান হয়, দাতার তালিকায় নাম ওঠে ও আত্মসম্মান সৃষ্টি হয়। এতে ধনী-গরিবের বিভেদ দূর হবে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা-সম্প্রীতি তৈরি হয়, সহমর্মিতা ও সামাজিক নিরাপত্তাবলয় গঠিত হয়; এতে দাতা-গ্রহীতা উভয়ের আর্থসামাজিক নিরাপত্তা জোরদার হয়। সমাজ থেকে কার্পণ্য, লোভ-মোহ ও হিংসা, পরশ্রীকাতরতাসহ নানাবিধ দুষ্ট উপসর্গ দূরীভূত হয়।
জাকাতের উদ্দেশ্য হলো দারিদ্র্য বিমোচন, তাই এমনভাবে জাকাত দেওয়া উচিত, যাতে জাকাত গ্রহীতা স্বাবলম্বী হতে পারে।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: প্যানেল খতিব, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম ও জাতীয় ঈদগাহ; যুগ্ম মহাসচিব: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক: আহছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম (খান বাহাদুর আহছান উল্লাহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ)।
smusmangonee@gmail.com