
প্রিয় নবীজি (সা.) মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। আল্লাহ তাআলা কোরআন করিমে বলেন: ‘নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তাঁর নবীর ওপর রহমত ও বরকত অবতীর্ণ করেন এবং আল্লাহর ফেরেশতারা তাঁর নবীর প্রতি রহমত ও বরকত কামনা করেন; হে বিশ্বাসীরা! তোমরাও তাঁর নবীর জন্য রহমত ও বরকত প্রার্থনা করো এবং বিশেষভাবে শান্তি নিবেদন করো।’ (সুরা-৩৩ আহজাব, আয়াত: ৫৬)।
দরুদ শরিফের বিধান
জীবনে অন্তত একবার নবীজির প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করা ফরজ। নবীজির নাম ‘মুহাম্মদ’ (সা.) শুনলে দরুদ শরিফ পাঠ করা ওয়াজিব। তাশাহহুদের নামাজে নবীজির প্রতি সালাম প্রদান করা ওয়াজিব। নামাজে দরুদ শরিফ পাঠ করা সুন্নত। একই মজলিশে একাধিকবার
তাঁর নাম মোবারক শুনলে প্রতিবার দরুদ শরিফ পড়া মোস্তাহাব। সব সময় দরুদ শরিফের আমল করা নফল ইবাদত। আমরা নবীজির নামের পরিবর্তে ব্যবহৃত বিকল্প বা সর্বনামের ক্ষেত্রেও দরুদ শরিফ পড়ে থাকি; এটি আফজল বা উত্তম।
নাতে রাসুল ও দরুদ শরিফ
নবীপ্রেমের আনন্দের প্রকাশ নাতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও দরুদ শরিফ। আশেকে রাসুল বিখ্যাত পারস্য কবি শেখ মুসলিহ উদদীন সাদি সিরাজি প্রিয় নবীজি (সা.)-এর শানে নাত কবিতা লিখেছেন। তিনি একটি রুবায়ি (চতুর্পদী) লিখতে গিয়ে তিন লাইন (বালাগাল উলা বি কামা-লি হি/ কাশাফাদ দুজা বি জামা-লি হি/ হাছুনাত জামিউ খিছ-লি হি) লিখে চতুর্থ লাইনটি আর মেলাতে পারছিলেন না কোনোভাবেই। অনেক চেষ্টার পর রণে ভঙ্গ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। যাঁর উদ্দেশ্যে এ নাত কবিতা, তিনি ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ বা বিশ্বজগতের রহমত হজরত মুহাম্মদ (সা.) স্বপ্নে দেখা দিয়ে নিজেই বলে দিলেন চতুর্থ লাইনটি (সল্লু আলাইহি ওয়া আলি হি)। ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে তিনি লিখে ফেললেন তা, সঙ্গে যুক্ত হলো আরও ২০ লাইন; মোট ২৪ চরণের ৬টি রুবায়ি। ওই নাতই আজ জগদ্বিখ্যাত দরুদের স্থানে অধিষ্ঠিত।
দরুদ অর্থ
দরুদ শরিফ ফারসি ও আরবির জোড়া শব্দ। দরুদ শব্দটি ফারসি, শরিফ শব্দটি আরবি। দরুদ অর্থ হলো শুভকামনা, কল্যাণ প্রার্থনা। দরুদ শব্দের আরবি হলো ‘সলাত’। সলাত শব্দের মূল চারটি অর্থ—দরুদ বা শুভকামনা, তাসবিহ বা গুণকীর্তন, রহমত বা দয়া করুণা ও ইস্তিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা। পরিভাষায় দরুদ বলতে ‘আস সলাত আলান নাবি’, অর্থাৎ নবীজির প্রতি দরুদ পাঠ বা তাঁর জন্য শুভকামনা, তাঁর গুণকীর্তন, তাঁর প্রতি আল্লাহর দয়া করুণা প্রার্থনা বোঝায়। সলাত শব্দের আদি অর্থ হলো আগুনে পুড়িয়ে বাঁকা সোজা করা বা আগুনের তাপ দিয়ে বাঁশ ও কাঠকে কাঙ্ক্ষিত নির্দিষ্ট আকৃতিতে আনা।
কর্তা ও কর্মভেদে সলাতের বিভিন্ন অর্থ নির্ধারিত হয়। আল্লাহ যখন সলাতের কর্তা হন, তখন সলাতের অর্থ হয় রহমত ও দয়া করুণা। ফেরেশতা যখন সলাতের কর্তা হন, তখন সলাতের অর্থ হয় পবিত্রতা বর্ণনা ও ক্ষমা প্রার্থনা। মানুষ যখন সলাতের কর্তা হয়, তখন সলাতের অর্থ হয় দোয়া ও শুভকামনা। সুতরাং আল্লাহ ‘সলাত’ করেন অর্থ হলো, আল্লাহ রহমত করেন। ফেরেশতাগণ ‘সলাত’ করেন মানে হলো, ফেরেশতারা পবিত্রতা বর্ণনা ও শুভকামনা করেন। তোমরা (মুমিনরা) ‘সলাত’ করো অর্থ হলো, তোমরা তাঁর জন্য শুভকামনা ও রহমত প্রার্থনা করো।
দরুদ অতীব মর্যাদা ও সম্মানের, তাই শব্দটি একা ব্যবহার না করে এর সঙ্গে ‘শরিফ’ তথা সম্মানিত বিশেষণ যুক্ত করে বলা হয় ‘দরুদ শরিফ’। দরুদ শরিফ যেকোনো ভাষায় যেকোনো উত্তম শব্দ ও বাক্য দ্বারা হতে পারে। আরবিতে সাধারণত সংক্ষেপে ‘সাল্লাল্লাহু আলা মুহাম্মদ’ বা ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ বলা হয়।
দোয়া দরুদ ও নফল ইবাদত
দরুদ শরিফ ইবাদতের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ এবং ইবাদত কবুলের সহায়ক ও দোয়া কবুলের শর্ত। প্রিয় নবীজি (সা.) বলেন, যে আমার প্রতি একবার দরুদ পাঠ করল, আল্লাহ তার প্রতি দশটি রহমত নাজিল করেন, তাকে দশটি নেকি দান করেন, তার দশটি গুনাহ মাফ করেন। (বুখারি ও মুসলিম)। দরুদ পাঠের এহেন গুরুত্ব ও ফজিলত শুনে এক সাহাবি (রা.) বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)! আমি যত নফল ইবাদত করব, তার এক-চতুর্থাংশ দরুদ শরিফ পড়ব। নবীজি বললেন, তা ভালো, আরও বেশি হলে আরও ভালো। সাহাবি (রা.) বললেন, নফলের এক-তৃতীয়াংশ দরুদ শরিফ পড়ব। নবীজি বললেন, তা ভালো, আরও বেশি হলে আরও ভালো। সাহাবি (রা.) বললেন, নফলের অর্ধাংশ দরুদ শরিফ পড়ব। নবীজি বললেন, তা ভালো, আরও বেশি হলে আরও ভালো। সাহাবি (রা.) বললেন, নফলের দুই-তৃতীয়াংশ দরুদ শরিফ পড়ব। নবীজি বললেন, তা ভালো, আরও বেশি হলে আরও ভালো। সাহাবি (রা.) বললেন, নফলের তিন-চতুর্থাংশ দরুদ শরিফ পড়ব। নবীজি বললেন, তা ভালো, আরও বেশি হলে আরও ভালো। সাহাবি (রা.) তখন আর কিছু বললেন না। (মুসলিম ও তিরমিজি)। দরুদ শরিফ রহমত ও কল্যাণলাভের রাজতোরণ; মুমিনজীবনের পাথেয়।
দরুদ শরিফ না পড়ার ভয়াবহ পরিণতি
একবার জুমার দিনে রাসুলুল্লাহ (সা.) মিম্বারের প্রথম ধাপে পা রাখলেন এবং বললেন, আমিন! অতঃপর দ্বিতীয় ধাপে পা রাখলেন এবং বললেন, আমিন! তারপর তৃতীয় ধাপে পা রাখলেন এবং বললেন, আমিন! এরপর খুতবা দিলেন ও নামাজ আদায় করলেন। নামাজ
শেষে সাহাবায়ে কিরাম প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)! আজ যা দেখলাম, তা ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি (আপনি একেক ধাপে পা রেখে আমিন! আমিন!! আমিন!!! বললেন); এটা কি কোনো নতুন নিয়ম? নবী করিম (সা.) বললেন, না, এটা নতুন কোনো নিয়ম নয়; বরং আমি মিম্বারে ওঠার সময় হজরত জিবরাইল (আ.) এলেন। আমি যখন মিম্বারের প্রথম ধাপে পা রাখি, তখন হজরত জিবরাইল (আ.) বললেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যারা পিতামাতা উভয়কে বা একজনকে বার্ধক্য অবস্থায় পেয়েও তাদের খেদমতের মাধ্যমে জান্নাত অর্জন করতে পারল না, তারা ধ্বংস হোক। তখন আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম, আমিন! (তা-ই হোক)। আমি যখন মিম্বারের দ্বিতীয় ধাপে পা রাখি, তখন হজরত জিবরাইল (আ.) বললেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যারা রমজান পেল কিন্তু ইবাদতের মাধ্যমে তাদের গুনাহ মাফ করাতে পারল না, তারা ধ্বংস হোক। তখন আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম, আমিন! আমি যখন মিম্বারের তৃতীয় ধাপে পা রাখি, তখন হজরত জিবরাইল (আ.) বললেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যারা আপনার পবিত্র নাম মোবারক (‘মুহাম্মদ’) শুনল কিন্তু দরুদ শরিফ পাঠ করল না, তারা ধ্বংস হোক। তখন আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম, আমিন! (মুসলিম শরিফ)।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
smusmangonee@gmail.com