গির্জাগুলো সেজেছে বর্ণাঢ্য সজ্জায়
গির্জাগুলো সেজেছে বর্ণাঢ্য সজ্জায়

শুভ বড়দিন

যিশু খ্রিষ্টের জীবনদর্শন: ভালোবাসা ঘৃণার চেয়ে শক্তিশালী

মানবসভ্যতার ইতিহাসে দেখা গেছে অধর্ম ও অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত মানবজাতিকে মুক্তির পথ দেখাতে নানা যুগে নানা সময়ে মহামানব বা ঈশ্বরের অবতারদের আবির্ভাব ঘটেছে। তবে ইতিহাসে অধিকাংশ মহামানবদের আবির্ভূত শুভক্ষণ সবসময় সঠিকভাবে লিখিত হয়নি। অনেকটাই অনুমানের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়েছে ইতিহাসবিদদের।

প্যালেস্টাইন তখন রোমান সাম্রাজ্যের অধীন। রোমান শাসকগোষ্ঠী ও তাদের আজ্ঞাধীন দেশীয় শাসকদের প্রাণঘাতী শাসন-শোষণ ও অত্যাচারে জর্জরিত ইহুদিদের বিশ্বাস ছিল ইহুদি-ত্রাণকর্তা বা মেশায়া-রাজা আসবেন এবং তাদের মুক্ত করে রোমানদের উপর বিজয় দান করবেন।

তারা এমন এক মহা শক্তিমান রাজার প্রতীক্ষায় ছিল যিনি তাদের হারানো সুখসমৃদ্ধি ও অতীত গৌরব ফিরিয়ে এনে তাদের জগতের শীর্ষস্থানে অধিষ্ঠিত করে দেবেন।

ইহুদিদের মেশায়া সত্যিই এলেন। ইহুদিরা যখন সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে আধ্যাত্মিক মৃত অবস্থায় পতিত হয়ে পড়েছিল মেশায়া এলেন পথভ্রষ্ট সেই ইহুদি জাতিকে সত্য, ন্যায়,কল্যাণ ও মুক্তির পথ দেখাতে; তাদের কাছে ঈশ্বরের বাণী প্রচার করতে।

বিধর্মী রোমানদের হাত থেকে তাদের উদ্ধার করতে নয়, বরং অধর্মের বন্ধন থেকে তাদের আত্মাকে মুক্তি দিয়ে প্রকৃত গৌরবে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি এলেন।

তারা এমন এক মহা শক্তিমান রাজার প্রতীক্ষায় ছিল যিনি তাদের হারানো সুখসমৃদ্ধি ও অতীত গৌরব ফিরিয়ে এনে তাদের জগতের শীর্ষস্থানে অধিষ্ঠিত করে দেবেন।

ঈশ্বর ভবিষ্যদ্বক্তা ভাববাদীদের মাধ্যমে তাঁর লোকদের জন্য যে মেশায়া-রাজার আবির্ভাবের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন অতি দরিদ্র ঘরে জন্ম নেওয়া যিশুই যে সেই রাজা ইহুদিরা তা মেনে নিতে পারল না। ইহুদিদের কেউই তাঁকে মেশায়া বলে চিনে নিতে পারল না। কারণ ইহুদি পুরাণে বর্ণিত মেশায়ার সঙ্গে যিশুর কোথাও কোনো মিল নেই।

ইহুদিরা বুঝেছিল মেশায়া হচ্ছেন পার্থিব দুর্গতি থেকে ইহুদিদের উদ্ধারকর্তা রাজা। কিন্তু যিশু এলেন মোক্ষদাতা হয়ে অমৃতলোকের সন্ধান দিতে; অনন্ত জীবনের পথ দেখাতে; পাপ-তাপ, দুঃখ-শোক, বিবাদ-বিসম্বাদ দূর করে মানুষের অন্তরে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে। তিনি শুধু ইহুদিদের ত্রাণকর্তা হয়ে এলেন না, সমগ্র মানবজাতির ত্রাণকর্তা হয়ে এলেন। তিনি বললেন, ঈশ্বর পরমপিতা। প্রত্যেক মানুষই ঈশ্বরের সন্তান।

পরম কারুণিক মহাপুরুষ যিশুর জীবদ্দশায় তাঁর জীবনী লেখা হয়নি। তাঁর সম্বন্ধে নানা কাহিনী ও তাঁর উপদেশাবলি শুধু লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে ছিল। তাঁর তিরোধানের অনেক বছর পর মার্ক, ম্যাথিউ, লুক ও জন এই চারজন খ্রিষ্টান সাধু চারটি সুসমাচার বা গসপেল লেখেন।

এই চার সাধুর কেউই যিশুর সাক্ষাৎ শিষ্য ছিলেন না, লিখিত ঘটনা বা বিবরণসমূহের প্রত্যক্ষদর্শীও ছিলেন না। যিশুর শিষ্য-প্রশিষ্যদের নিকট শুনেই সেগুলি লেখা হয়। এছাড়া সুসমাচারগুলি একই সময়ে লেখা হয়নি। এগুলি সম্ভবত ৭০ কি ৭৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে আরম্ভ করে ১০০ কি ১১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লেখা হয়েছিল।

যিশুর জীবনের ঘটনাবলি নিয়ে সুসমাচারগুলিতে অনেক মিল যেমন আছে তেমনই ছোট-বড় অনেক প্রভেদও রয়েছে। অনেক গবেষকের মতে, এই চারটি সুসমাচারের সবকিছু ঐতিহাসিকভাবে বিশ্বাসযোগ্য ও সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃত নয়। যিশুর জন্ম, মৃত্যু ও জীবনী সম্পর্কে তাঁদের মধ্যে অনেক মতবিরোধ রয়েছে।

এই চারটি সুসমাচারের মধ্যে সাধু মার্ক-লিখিত সুসমাচারটি সর্বাগ্রে রচিত। যিশুর সাক্ষাৎ শিষ্য পিটারের কাছ থেকে যিশু সম্বন্ধে যা জেনেছেন সেসব তিনি নিজের মতো করে প্রকাশ করেছেন। যিশু প্যালেস্টাইনে প্রচলিত একটি কথ্য ভাষা অ্যারামেয়িক ভাষায় উপদেশ দিতেন।

সুসমাচারগুলির মূল ভাষা গ্রিক। সেসময় রোমান সাম্রাজ্যের অধীন রাজ্যগুলোতে রাজকার্যের ভাষা ছিল গ্রিক। তাই সেখানকার প্রায় সবাই এই ভাষা বুঝতেন। সুসমাচারের লেখকেরা যিশুর উপদেশগুলোকে গ্রিক ভাষায় তর্জমা করে নেন।

যিশুর জীবনবৃত্তান্ত সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা না গেলেও সুসমাচারগুলিতে বর্ণিত কাহিনীগুলি নিজেদের মতন করে সাজিয়ে নিয়ে তাঁর জীবন সম্বন্ধে একটা ধারণা করা সম্ভব হয়। মহা কারুণিক যিশুর উপদেশাবলিই তাঁর জীবন। তাঁর মুখনিঃসৃত বাণী থেকে তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের যে রূপটি ফুটে ওঠে তাতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, তিনি যা উপদেশ দিতেন জীবনযাপনও করতেন ঠিক সেই ধরনেরই।

যিশুর জীবনদর্শন মানুষকে শেখায়—ভালোবাসা ঘৃণার চেয়ে শক্তিশালী, ক্ষমা প্রতিহিংসার চেয়ে মহৎ, আর আত্মত্যাগই মানবজীবনের সর্বোচ্চ সার্থকতা।

যিশু খ্রিষ্টের জীবনদর্শনের কেন্দ্রে রয়েছে ভালোবাসা, ক্ষমা ও আত্মোৎসর্গ। তিনি ঈশ্বরকে কেবল উপাসনার বিষয় হিসেবে নয়, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অন্তরঙ্গ সঙ্গী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর বাণীতে ঈশ্বর মানে ভয় নয়, বরং করুণা ও পিতৃ-স্নেহ।

যিশুর বার্তা ছিল প্রেম ও শান্তির। তিনি গল্পচ্ছলে, উপমা ব্যবহার করে উপদেশ দিতেন যা মানুষকে আকৃষ্ট করত। তিনি শিক্ষা দিয়েছিলেন—মানুষের প্রতি ভালোবাসাই ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসার প্রকৃত রূপ। তাই তিনি বলেছিলেন, “তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মতো ভালোবাসো”।

সুসমাচারগুলিতে যিশুর অনেক অলৌকিক ক্ষমতার কাহিনী পাওয়া যায় যেগুলি বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন সময়ে বর্ণনা করেছেন।

তবে পরার্থপর যিশু নিজের স্বার্থে, নিজের কাম্যবস্তু অর্জন করতে কখনও অলৌকিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেননি। শোষিত, পীড়িত, নিঃসহায়, দীনদরিদ্র, মৃতপ্রায় মানুষের কাতর প্রার্থনায় ব্যথিত হয়ে তাদের দুঃখ-কষ্ট দূর করতে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে ক্ষুধার্তের মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন, অজ্ঞানকে জ্ঞান দান করেছেন, পীড়িত, অন্ধ, বধির, পক্ষাঘাতগ্রস্ত ও কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্ত মানুষদের সুস্থ করে তুলেছেন, মৃতপ্রায় মানুষকে জীবন দান করেছেন। সমাজের অবহেলিত, দরিদ্র, পাপী ও নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি দেখিয়েছিলেন যে মানব-মর্যাদা জন্মসূত্রে নয়, মানবিকতায় প্রতিষ্ঠিত।

ক্ষমা যিশুর দর্শনের অন্যতম স্তম্ভ। প্রতিশোধের বদলে তিনি ক্ষমার পথ দেখিয়েছেন—এমনকি ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার মুহূর্তেও তাঁর প্রার্থনা ছিল অত্যাচারীদের জন্য। এই ক্ষমা দুর্বলতার চিহ্ন নয়, বরং নৈতিক শক্তির সর্বোচ্চ প্রকাশ।

যিশুর জীবন ছিল আত্মত্যাগের উদাহরণ। তিনি ব্যক্তিগত লাভ বা ক্ষমতার সন্ধান করেননি; বরং সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাঁর কাছে জীবন মানে ছিল অন্যের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া।

সংক্ষেপে বলা যায়, যিশুর জীবনদর্শন মানুষকে শেখায়—ভালোবাসা ঘৃণার চেয়ে শক্তিশালী, ক্ষমা প্রতিহিংসার চেয়ে মহৎ, আর আত্মত্যাগই মানবজীবনের সর্বোচ্চ সার্থকতা। এই দর্শন আজও বিশ্বমানবতার জন্য এক চিরন্তন আলোকবর্তিকা।

দীপান্বিতা দে : শিশুতোষ গ্রন্থপ্রণেতা ও প্রাবন্ধিক