মদিনার আউস গোত্রের আমর ইবনে আউফ বংশের অধিবাসী ছিলেন তিনি। তাঁর পিতা আবু আমির ছিলেন মদিনার অন্যতম নেতৃ-পুরুষ। নবীজির শুভাগমনের পূর্বে আবু আমের শেষ নবীর আগমনের সুসংবাদ শোনাতেন। তাঁর সত্যবাদিতার সাক্ষী দিতেন। একপর্যায়ে বৈরাগ্যবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এ কারণে তিনি ‘রাহিব; বা ‘সন্ন্যাসী’ উপাধি লাভ করেন।
আর মা ছিলেন মোনাফেক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের বোন।
তবে রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন নবুয়ত ঘোষণা করেন, তখন মদিনার পুরনো নেতৃবৃন্দের, বিশেষত আবু আমের ও আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের প্রভাব কমে যায়। আবদুল্লাহ মুনাফেকি নীতি নিয়ে মদিনাতেই থেকে গেলেও আবু আমির মদিনা ছেড়ে মক্কায় চলে যান এবং উহুদের যুদ্ধে তিনি কুরাইশ বাহিনীর সঙ্গে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অংশ নেন। এ কারণে রাসুল (সা.) তাঁকে ‘ফাসিক’ বলে অভিহিত করেন।
তাঁর পিতা আবু আমির ছিলেন মদিনার অন্যতম নেতৃ-পুরুষ। নবীজির শুভাগমনের পূর্বে আবু আমের শেষ নবীর আগমনের সুসংবাদ শোনাতেন।
মক্কা বিজয়ের পর আবু আমির রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং ১০ম হিজরিতে সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম: ২/৭৫, ১২৩)
যেখানে তাঁর পিতা কুফরে নিমজ্জিত, সেখানে হানজালা (রা.) ছিলেন ঈমান, তাকওয়া ও সাহসিকতার উজ্জ্বল উদাহরণ। তিনি নবীজির নিকট একবার বলেছিলেন, ‘আল্লাহর রাসুল, যদি আপনি আদেশ দেন, আমি নিজ হাতে আমার পিতা আবু আমিরকে হত্যা করতে প্রস্তুত।’ নবীজি (সা.) অবশ্য তাঁকে এ থেকে নিবৃত্ত করেন। (আল-ইসাবা: ১/৩৬১)
হানজালা (রা.) বদর যুদ্ধে অংশ নেননি, তবে উহুদযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন; আর এটাই ছিল তাঁর মুসলিম জীবনের প্রথম ও শেষ যুদ্ধ। যুদ্ধে যাওয়ার আগে তিনি সদ্যবিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন, এমন সময় জিহাদের ডাক আসে। তিনি গোসল রেখেই উহুদ প্রান্তরে উপস্থিত হন। মাঠে তিনি মুখোমুখি হন কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান ইবনে হারবের। তাকে প্রায় পরাস্ত করে ফেলেছিলেন; কিন্তু ঠিক তখনই শাদ্দাদ ইবনে আসওয়াদ নামের এক শত্রুসেনা পেছন থেকে এসে আঘাত করে তাঁর মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। (সিরাতে ইবনে হিশাম: ২/৭৫)
যুদ্ধে যাওয়ার আগে তিনি সদ্যবিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন, এমন সময় জিহাদের ডাক আসে। তিনি গোসল রেখেই উহুদ প্রান্তরে উপস্থিত হন।
এর আগের বছর বদরের যুদ্ধে আরেকজন হানজালা নিহত হন, যিনি কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের পুত্র। সে কারণে উহুদের যুদ্ধে হানজালা (রা.)-কে শহিদ করার পর কুরাইশরা বলেছিল, ‘হানজালার বদলে হানজালা।’
উহুদযুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে একটি বেদনা-বিধুর অধ্যায়। এই যুদ্ধে ৭০ জন সাহাবি শহিদ হন। যুদ্ধ শেষে আল্লাহর রাসুল (সা.) নিজ হাতে শহিদদের লাশ একত্র করছিলেন। গুনে গুনে ৬৮ জনের লাশ পাওয়া গেলেও তাঁর প্রিয় চাচা হামজা (রা.) এবং সদ্যবিবাহিত সাহাবি হানজালা (রা.)-এর লাশ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। নবীজি (সা.) অস্থির হয়ে ওঠেন।
এ–সময় আপাদমস্তক ঢাকা এক নারী এসে নবীজিকে জানান, গতকাল তিনি যে বিয়ে পড়িয়েছেন এবং খেজুর ছিটিয়েছেন, সেই বিয়ের বধূই তিনি। নারীটি বললেন, ‘এই দেখুন আমার হাতের মেহেদি এখনো শুকায়নি। যাওয়ার আগে লজ্জায় আমি তাঁকে বলতেও পারিনি যে, আপনার গোসল বাকি রয়ে গেছে।’
প্রিয় সাহাবির এমন আবেগ দেখে নবীজি (সা.) তখন কাঁদতে লাগলেন।
হানজালার ঘটনায় আল্লাহ এত খুশি হয়েছেন যে, তিনি ফেরেশতাদের আদেশ করলেন তাঁকে জমজমের পানি দিয়ে গোসল করাতে।আল-ইসতিয়াব: ১/২৮০-২৮২
এমন সময় এক সাহাবি জানান, ‘হানজালার মরদেহ পাওয়া গেছে।’ নবীজি দেখেন, তাঁর লাশ থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে। নবীজি তখন হানজালার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। জিবরীল (আ.) এসে বললেন, ‘আল্লাহর রাসুল, হানজালার ঘটনায় আল্লাহ এত খুশি হয়েছেন যে, তিনি ফেরেশতাদের আদেশ করলেন তাঁকে জমজমের পানি দিয়ে গোসল করাতে।’ (আল-ইসতিয়াব: ১/২৮০-২৮২; হায়াতুস সাহাবা: ২/২১৮)
এ–কারণে তার উপাধি হয়—‘গাসিলুল মালায়িকা’, অর্থাৎ ‘ফেরেশতাদের গোসলকৃত’। (হায়াতুস সাহাবা: ২/২১৮)
পরবর্তী সময় হানজালা (রা.)–এর ঔরস থেকে জন্ম নেয় এক পুত্র—আবদুল্লাহ। নবীজি (সা.)-এর ওফাতের সময় তাঁর বয়স ছিল সাত-আট বছর। ৬৩ হিজরিতে ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার বাহিনী মদিনায় হামলা চালায়, ইতিহাসে যা ‘ওয়াকিয়ায়ে হাররা’ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে আবদুল্লাহ (রা.) ইয়াজিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং তাঁর আটজন সন্তান শহিদ হয়। তিনি নিজেও শহিদ হন। (হায়াতুস সাহাবা: ২/২১৮)