জ্ঞান-বিজ্ঞানে নারী ০৩

মুসলিম নারী চিকিৎসকেরা হারিয়ে গেলেন কেন

ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই চিকিৎসা শাস্ত্রে নারীরা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। মুসলিম নারীরা চিকিৎসা, নার্সিং, ওষুধ তৈরি, এমনকি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় নারীদের অবদান অনস্বীকার্য। মধ্যযুগে মুসলিম নারী চিকিৎসকদের ভূমিকা নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক রচনার আজ তৃতীয় শেষ পর্ব

কর্দোভার সংকীর্ণ গলিতে এক নারী দ্রুত পা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর হাতে একটি কাঠের বাক্স, ভেতরে হাতে তৈরি মলম ও ঔষধি গাছ। তিনি আল-জাহরাভির কন্যা, একজন ধাত্রী, যিনি প্রসূতি মায়েদের সেবা করছেন। তাঁর কাজ শুধু শারীরিক নিরাময় নয়, বরং একটি সম্প্রদায়ের আস্থা ও আশার প্রতীক।

মধ্যযুগের মুসলিম বিশ্বে মুসলিম নারী চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এমন অগণিত গল্প রচনা করেছেন, যা চিকিৎসাবিজ্ঞান ও সমাজের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলেছে। তৃতীয় ও শেষ পর্বে আমরা তাঁদের প্রভাব, আধুনিক স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে তুলনা এবং তাদের ঐতিহাসিক স্বীকৃতির চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করব।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে নারীদের ছাপ

মুসলিম নারী চিকিৎসকদের কাজ মুসলিম বিশ্বের চিকিৎসাব্যবস্থাকে একটা কাঠামো দিয়েছে। রুফায়দা আল-আসলামিয়া (রা.)-এর মোবাইল হাসপাতালের ধারণা আধুনিক ফিল্ড হাসপাতালের পূর্বসূরি। তাঁর তাঁবু যা মদিনার মসজিদে নববিতে স্থাপিত হয়েছিল, স্বাস্থ্যসেবার মডেল হিসেবে কাজ করেছে।

২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারিতে মসজিদগুলো চিকিৎসা ও টিকাকরণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা রুফায়দার মসজিদভিত্তিক তাঁবুর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।

এই মডেল পরবর্তী সময়ে আব্বাসীয় যুগের বিমারিস্তানে (হাসপাতাল) প্রতিফলিত হয়, যেখানে শিহাবুদ্দিন আল-সায়িগের (মৃ. ১৬২৭ খ্রি.) কন্যার মতো নারীরা নেতৃত্ব দিয়েছেন। (আল-সাঈদ, আত-তিব ওয়া রায়িদাতুহু আল-মুসলিমাত, পৃ. ১৮৯, আম্মান: দারুল ফিকর, ১৯৮৫)

নারীদের ওষুধ তৈরি ও শল্যচিকিৎসার কাজ চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। আল-জাহরাভির (৯৩৬-১০১৩ খ্রি.) গ্রন্থ আত-তাসরিফ নারী চিকিৎসকদের জন্য শিক্ষার ভিত্তি ছিল, বিশেষ করে প্রসূতি ও গাইনোকোলজিতে। এই গ্রন্থ ইউরোপে অনূদিত হয়ে রেনেসাঁসের চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রভাব ফেলেছে। ১৯০৮ সালে গ্রন্থটির আধুনিক সংস্করণ প্রকাশ পেয়েছে কায়রো ‘দারুল কুতুব’ থেকে।

আন্দালুসে উম্ম হাসান বিনত কাজি তানজালি (১৪ শতক) চিকিৎসাশিক্ষার মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম তৈরি করেন, যা শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। (আবু বকর ও আল-সাদি, আন-নিসা ওয়া মিহনাত আল-তিব, পৃ. ২১২, কায়রো: দারুল কুতুব, ১৯৯৯)

এই কাজগুলো আধুনিক পাবলিক হেলথ সিস্টেমের পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচিত হয়।

নারীদের ওষুধ তৈরি ও শল্যচিকিৎসার কাজ চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে
আধুনিক স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে তুলনা

মুসলিম নারী চিকিৎসকদের কাজ আধুনিক স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। রুফায়দার মোবাইল হাসপাতালের ধারণা আজকের জরুরি চিকিৎসা ইউনিটের (ইএমইউ) সঙ্গে তুলনীয়।

২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারিতে মসজিদগুলো চিকিৎসা ও টিকাকরণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা রুফায়দার মসজিদভিত্তিক তাঁবুর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। (বিবিসি, ‘বার্মিংহাম মসক বিকামস ইউকে’স ফার্স্ট টু অফার কোভিড ভ্যাকসিন’, ২৫ জানুয়ারি ২০২১)

নারীদের শল্যচিকিৎসা ও ওষুধ তৈরির কাজ আধুনিক ফার্মাসিউটিক্যাল ও সার্জিকাল প্র্যাকটিসের ভিত্তি। তুরস্কে শরফুদ্দিন সাবুনচুওগলুর (১৩৮৫-১৪৬৮ খ্রি.) গ্রন্থে বর্ণিত নারী শল্যচিকিৎসকদের গাইনোকোলজিকাল অস্ত্রোপচার আধুনিক স্ত্রীরোগ চিকিৎসার প্রাথমিক রূপ। (মুসলিম হেরিটেজ, ‘উইমেনস কন্ট্রিবিউশন টু ক্ল্যাসিক্যাল ইসলামিক সিভিলাইজেশন’, ৭ জুলাই ২০২০)

৭ম শতকের জয়নাব বিনতে বানি আওদের চোখের মলম আধুনিক অ্যান্টিসেপটিক ক্রিমের পূর্বসূরি (আল-ইসফাহানি, আল-আগানি, ২১/১৪৫, বৈরুত: দারুল কুতুব, ১৯৬০)

আধুনিক বিশ্বে মুসলিম নারী চিকিৎসকেরা এই ঐতিহ্য বহন করছেন। বাহরাইনের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস রুফায়দার (রা.) নামে চিকিৎসায় অ্যাওয়ার্ড প্রদান করছে এবং ইরানে নার্স দিবস জয়নাব বিনত আলীর (৬২৪-৬৮১ খ্রি.) নামে উদ্‌যাপিত হয়, যিনি কারবালার যুদ্ধে আহতদের সেবা করেছেন।

তুরস্কে শরফুদ্দিন সাবুনচুওগলুর গ্রন্থে বর্ণিত নারী শল্যচিকিৎসকদের গাইনোকোলজিকাল অস্ত্রোপচার আধুনিক স্ত্রীরোগ চিকিৎসার প্রাথমিক রূপ।
ঐতিহাসিক স্বীকৃতির চ্যালেঞ্জ

ঐতিহাসিক নারীদের তুলনায় আধুনিক নারীদের কাজ বেশি দৃশ্যমান, কারণ আধুনিক সময়ে ডিজিটাল রেকর্ড ও প্রকাশনার সুযোগ বেশি। যেমন পশ্চিমে প্রথম নিবন্ধিত নারী চিকিৎসক এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েল ১৮৪৯ সালে চিকিৎসা-যোগ্যতা অর্জন করেন এবং তিনি বিশ্বে বেশ আলোচিত। অথচ তাঁর শতাব্দীকাল আগে মুসলিম নারীরা চিকিৎসায় নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, বিশেষ করে ১৭ শতকের শিহাবুদ্দিন আল-সায়িগের কন্যা কায়রোর আল-মানসুরি হাসপাতালে প্রধান চিকিৎসক ছিলেন, তিনি ততটা আলোচিত নন।

মধ্যযুগের মুসলিম নারী চিকিৎসকদের অবদান প্রায়ই ঐতিহাসিক রেকর্ডে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। ইবনে আবি উসাইবিয়া (১২০৩-১২৭০ খ্রি.) তাঁর গ্রন্থ উয়ুন আল-আনবা ফি তাবাকাত আল-আতিব্বাতে মাত্র একজন নারী চিকিৎসকের উল্লেখ করেছেন।

ইসলামের ইতিহাসে নারী চিকিৎসকদের বর্ণনার অভাব কেন, তার প্রধান তিনটি কারণ চিহ্নিত করা যায়:

ইতিহাস পুনরুদ্ধারের জন্য আরবি সূত্রের গবেষণা ও অনুবাদ জরুরি। ভবিষ্যতে গবেষণা ও শিক্ষার মাধ্যমে এই নারীদের গল্প বিশ্বের সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন।

১. লিখিত রেকর্ডের অভাব: তখনকার সময়ের নারীরা, চিকিৎসা গ্রন্থ লেখার চেয়ে ব্যবহারিক কাজে মনোযোগী ছিলেন। যেমন উম্মে হাসান বলতেন, ‘লেখকেরা লেখেন, কর্মীরা করেন।’ (আবু বকর ও আল-সাদি, আন-নিসা, পৃ. ২১২)।

২. আরবি সূত্রের সীমাবদ্ধতা: তাঁদের কাজের বিবরণ প্রধানত আরবি গ্রন্থে রয়েছে, যা ইংরেজি বা অন্য ভাষায় অনূদিত হয়নি। যেমন, ইমাম তাবারির তারিখুল উমাম গ্রন্থের অষ্টম খণ্ডে নারী চিকিৎসকদের কথা বলেছেন, কিন্তু গ্রন্থটি ব্যাপকভাবে পরিচিতি পায়নি এবং অনুবাদও হয়নি।

৩. ইতিহাসের পুরুষদের প্রাধান্য: ঐতিহাসিকেরা পুরুষ চিকিৎসকদের ওপর বেশি ফোকাস করেছেন, নারীদের কাজকে প্রান্তিক করে রেখেছেন।

এই চ্যালেঞ্জের ফলে নারীদের অবদান অস্পষ্ট থেকে গেছে। এই ইতিহাস পুনরুদ্ধারের জন্য আরবি সূত্রের গবেষণা ও অনুবাদ জরুরি। ভবিষ্যতে গবেষণা ও শিক্ষার মাধ্যমে এই নারীদের গল্প বিশ্বের সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন, যেন তাঁদের উত্তরাধিকার পূর্ণাঙ্গভাবে উদ্‌যাপিত হয়।

 (মুসলিম হেরিটেজ ডটকম অবলম্বনে)