স্পেনের বুকে ইসলামি সংস্কৃতির হাজার বছরের গভীর ছাপ রয়েছে, যা আজও দেশটির স্থাপত্যে উজ্জ্বলভাবে প্রকাশ পায়। গ্রানাদার আলহাম্বরা থেকে কর্ডোভার মহান মসজিদ—এই স্থাপত্যগুলো কেবল পাথরের নির্মাণ নয়, বরং মুসলিম শাসনের সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারের জীবন্ত সাক্ষ্য।
৭১১ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর আফ্রিকার মুসলিমদের আগমনের সঙ্গে শুরু হয়েছিল এই ঐতিহ্য, যা স্পেনের ভাষা, রান্না এবং স্থাপত্যে অমলিন ছাপ রেখেছে। আজ স্পেনে ২৫ লাখ মুসলিম বাস করেন, যা মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশ মাত্র। কিন্তু এই স্থাপত্যগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ইসলাম স্পেনের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর নিদর্শনসমূহ পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে আছে, যাতে মানুষ তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে।’ (সুরা ফুসসিলাত, আয়াত: ৫৩)।
আসুন, স্পেনের পাঁচটি অসাধারণ ইসলামি স্থাপত্যের গল্প শুনি।
গ্রানাদার আলহাম্বরা বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত মুসলিম স্থাপত্যগুলোর একটি। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে নাসরিদ রাজবংশের শাসকেরা এই দুর্গ ও প্রাসাদ কমপ্লেক্স নির্মাণ করেন। ‘আলহাম্বরা’ শব্দটি এসেছে আরবি ‘আল-হামরা’ থেকে, যার অর্থ ‘লাল’, সম্ভবত এর দেয়ালের লালচে আভার কারণে।
এই কমপ্লেক্সে ছিল সেনাবাহিনীর সুরক্ষিত দুর্গ, শাসকদের প্রাসাদ এবং একটি মসজিদ। ১৫ শতকে মুসলিম শাসনের অবসানের পর মসজিদগুলো গির্জায় রূপান্তরিত হয় এবং স্পেনের শাসক চার্লস পঞ্চম (কার্লোস প্রথম) কিছু অংশ ধ্বংস করে ভিন্ন শৈলীতে প্রাসাদ নির্মাণ করেন।
আল্লাহর নিদর্শনসমূহ পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে আছে, যাতে মানুষ তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে।’সুরা ফুসসিলাত, আয়াত: ৫৩
ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির আগা খান প্রোগ্রামের পরিচালক নাসের রাব্বাত বলেন, ‘আলহাম্বরা একটি জীবন্ত প্রকল্প, যা খ্রিষ্টান শাসনেও পুনর্নির্মিত হয়েছে। এর সূক্ষ্ম ও জটিল নকশা এটিকে অনন্য করে রেখেছে।’
এর অলংকৃত খিলান, কাব্যিক পরিবেশ, বাগানসহ প্রাসাদগুলো মুসলিম শিল্পের বারোক শৈলীর প্রতিনিধিত্ব করে। ইউনেসকো স্বীকৃত এই স্থাপত্য পর্যটকদের মনে মুসলিম সংস্কৃতির প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট করে।
কর্ডোভার মহান মসজিদ (মেসকিতা দে কর্ডোভা) মুসলিম স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন। অষ্টম শতকে নির্মিত এই মসজিদ তিনবার সম্প্রসারিত হয়েছিল। এর কাবামুখী মিহরাব একটি পূর্ণাঙ্গ কক্ষের মতো, যা বিশ্বের অন্যান্য মসজিদের মতো নয়। দুটি গম্বুজের মধ্য দিয়ে এই মিহরাবে প্রবেশ করা যায়। ১৩ শতকে এটি গির্জায় রূপান্তরিত হলেও এর স্থাপত্যশৈলী অক্ষুণ্ন রয়েছে।
নাসের রাব্বাত বলেন, ‘এই মসজিদে একটি শান্তির আভা রয়েছে, মনে হয় যেন এটা একটা খেজুরগাছের বাগান।’ লাল-সাদা খিলান, সারিবদ্ধ স্তম্ভ এবং প্রশস্ত প্রাঙ্গণ ইসলামি বিশ্বাসের সরলতা ও সৌন্দর্য প্রকাশ করে। ইউনেসকো স্বীকৃত এই মসজিদ আজও ইসলামি ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
কর্ডোভা শহরের কাছে অবস্থিত মদিনা আজ-জাহরা স্পেনের সবচেয়ে বড় প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। দশম শতকে উমাইয়া খিলাফতের আমির আবদুর রহমান তৃতীয় এই রাজকীয় এস্টেট নির্মাণ করেন। আরবিতে ‘মুনিয়া’ নামে পরিচিত এই এস্টেট ছিল অভিজাতদের জন্য শহরের বাইরে অবকাশ কেন্দ্র, যা মহামারির সময় আশ্রয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আবদুর রহমান এটিকে ‘মদিনা’ বা ‘শহর’ নাম দিয়েছিলেন, কারণ এটি প্রশাসনিক ও আবাসিক উভয় কাজে ব্যবহৃত হতো।
আজও এখানে মুসলিম স্থাপত্যরীতির গোলাকার খিলান, স্তম্ভ এবং দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। নাসের রাব্বাত বলেন, ‘দশম শতাব্দীতে এখানকার প্রাসাদগুলো উপত্যকায় বাগান ও মণ্ডপের আকারে বিস্তৃত ছিল।’ স্থাপত্যটি একই সঙ্গে মুসলিম শাসনের প্রশাসনিক দক্ষতারও প্রতীক।
আরাগনের সারাগোসায় অবস্থিত আলজাফেরিয়া ১১ শতকে হুদিদ রাজবংশের শাসকদের বাসস্থান হিসেবে নির্মিত হয়। ‘আলজাফেরিয়া’ শব্দটি আরবি ‘জাফর’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘আনন্দ বা বিনোদনের প্রাসাদ’। বাইরে থেকে এটি একটি অজেয় দুর্গ, কিন্তু ভেতরে রয়েছে সূক্ষ্ম খিলান, মার্বেল সজ্জা এবং কমলালেবুর গাছসহ একটি মনোরম উঠান। ১২ শতকে খ্রিষ্টান রাজারা প্রাসাদটি দখল করে নেন এবং পরে তা স্প্যানিশ ইনকুইজিশনের কারাগারে পরিণত হয়। বর্তমানে তা আরাগনের আঞ্চলিক সংসদের কার্যালয়।
প্রাসাদটি মুসলিম স্থাপত্যশৈলী, বিশেষ করে খিলান ও উঠান মুসলিম শাসনের শৈল্পিক পরিশীলনের সাক্ষ্য বহন করে। স্পেনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মুসলিম ঐতিহ্যের অনন্য উদাহরণ এই প্রাসাদ।
সেভিয়ার রিয়াল আলকাজার ১০ শতকে সেভিয়ার দুর্গ হিসেবে নির্মিত হয়। ১৩ শতকে ক্যাস্টিল রাজ্যের শাসনের অধীনে এটি প্রায় সম্পূর্ণ পুনর্নির্মাণ করা হয়। গ্রানাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্প ইতিহাসের অধ্যাপক হোসে রদ্রিগেজ-দোমিঙ্গো বলেন, ‘আলকাজার মূলত একটি খ্রিষ্টান প্রাসাদ, কিন্তু এর নান্দনিকতা ইসলামের শিল্প ও সৌন্দর্য দ্বারা প্রভাবিত।’ এর সোনালি খিলান, মার্জিত স্তম্ভ এবং প্যাটিও দে লাস দোনসেলাস (মেয়েদের উঠান) আলহাম্বরার শৈলী থেকে অনুপ্রাণিত।
ইউনেসকো-স্বীকৃত এই প্রাসাদ স্পেনের মুসলিম ঐতিহ্যের সঙ্গে খ্রিষ্টান স্থাপত্যের এক অনন্য মিশ্রণ। এটি দেখায় কীভাবে মুসলিম শিল্প স্পেনের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে গঠন করেছে।
ইসলামি ঐতিহ্য স্পেনের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি সংজ্ঞায়িত উপাদান।হোসে রদ্রিগেজ-দোমিঙ্গো, অধ্যাপক, গ্রানাদা বিশ্ববিদ্যালয়
স্পেনের এই পাঁচটি স্থাপত্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ইসলামি সংস্কৃতি কেবল অতীতের ইতিহাস নয়; বরং আধুনিক স্পেনের পরিচয়ের একটি জীবন্ত অংশ। স্প্যানিশ ফাউন্ডেশন ফর ইসলামিক কালচারের বৈজ্ঞানিক পরিচালক সের্গিও ইসাবেল লুদেনা বলেন, ‘ইসলামি সংস্কৃতির উত্তরাধিকার স্পেনের সংস্কৃতির একটি অংশ।’ রদ্রিগেজ-ডমিঙ্গো যোগ করেন, ‘ইসলামি ঐতিহ্য স্পেনের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি সংজ্ঞায়িত উপাদান।’
সূত্র: হাইফেন অনলাইন ডটকম