লোকমান হাকিম

কোরআনের প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি

লোকমান হাকিম—এক নামেই পৃথিবীব্যাপী পরিচিত। তাঁর প্রজ্ঞাপূর্ণ কথা মানুষকে চুম্বকের মতো টানত। কোরআনে তাঁর নামে রয়েছে একটি পূর্ণ সুরা—সুরা লোকমান, ৩১তম সুরা, মক্কায় অবতীর্ণ। ৩৪টি আয়াত নিয়ে এই সুরা। তিনি ছিলেন আফ্রিকার নাওবা গোত্রের কৃষ্ণাঙ্গ, সুদান-মিসরীয় বংশোদ্ভূত, নাম লোকমান বিন আনকা বিন সাদুন। আরবে এসেছিলেন ক্রীতদাস হয়ে। জাবের (রা.) বলেন, তিনি ছিলেন খর্বাকৃতির, মোটা ঠোঁটের অধিকারী। পেশায় কাঠমিস্ত্রি হলেও তাঁর কথার জাদুতে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসত।

প্রজ্ঞার রহস্য

একবার এক বিশাল সমাবেশে লোকমান হাকিম জ্ঞানগর্ভ কথা বলছিলেন। একজন প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি সেই লোক, যিনি আমার সঙ্গে অমুক বনে ছাগল চরাতেন?’ লোকমান হাকিম হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমিই সে।’ লোকটি অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, ‘তাহলে এত সম্মান কীভাবে পেলেন? সবাই আপনার কথা শুনতে ছুটে আসে!’ লোকমান বললেন, ‘দুটি কাজ—সব সময় সত্য বলা আর অপ্রয়োজনীয় কথা এড়িয়ে চলা।’ আরেক বর্ণনায় তিনি যোগ করেন, ‘দৃষ্টি সংযত রাখা, প্রয়োজনের বাইরে কথা না বলা, হালাল জীবিকায় তুষ্ট থাকা, লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করা, সত্যে অটল থাকা, অঙ্গীকার পূর্ণ করা, মেহমানের আপ্যায়ন করা এবং প্রতিবেশীর প্রতি সদাচরণ। তুমিও এগুলো করলে এমন মর্যাদা পাবে।’ (তাফসিরে ইবনে কাসিরের বরাতে তাফসিরে মারেফুল কোরআন, মুফতি শফি মুহাম্মাদ শফি, অনুবাদ: মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, পৃষ্ঠা: ১,০৫৫)

দাউদ (আ.)-এর আগে লোকমান হাকিম মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকতেন, প্রয়োজনীয় মাসয়ালা শেখাতেন। দাউদ (আ.) নবী হওয়ার পর তিনি এই কাজ বন্ধ করে দেন।

লোকমান হাকিম কে ছিলেন

বিখ্যাত ইতিহাসবেত্তা মুহাম্মদ বিন জারির আত-তাবারি, ইমামুদ্দিন বিন কাসির ও আবুল কাসেম আস-সুহাইলি বলেন, লোকমান হাকিম ছিলেন আফ্রিকান। (তাফসিরে ইবনে কাসির, সুরা লোকমান, আয়াত ১২-এর ব্যাখ্যা)

সাইদ বিন মুসাইয়িব (রা.) বলেন, ‘তিনি ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ, পুরু ওষ্ঠাধরবিশিষ্ট, প্রজ্ঞাবান, তবে নবী নন।’ (আহকামুল কোরআন, মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ আল-আন্দালুসি, ৬/২৮৬)

ইবনে আব্বাস, জাবের ইবনে আবদুল্লাহ ও সাইদ ইবনুল মুসাইয়িবের বরাতে সুফিয়ান সাওরি বলেন, ‘তিনি নবী নন, আল্লাহর সৎ বান্দা ছিলেন।’ অধিকাংশ আলেম মনে করেন, তিনি ছিলেন আল্লাহর ওলি। (কাসাসুল কোরআন, ৮/১৬; আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ২/১২৪)

দাউদ (আ.)-এর আগে লোকমান হাকিম মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকতেন, প্রয়োজনীয় মাসয়ালা শেখাতেন। দাউদ (আ.) নবী হওয়ার পর তিনি এই কাজ বন্ধ করে দেন।

একবার এক বিশাল সমাবেশে লোকমান হাকিম জ্ঞানগর্ভ কথা বলছিলেন। একজন প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি সেই লোক, যিনি আমার সঙ্গে অমুক বনে ছাগল চরাতেন?’ লোকমান হাকিম হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমিই সে।’

ছেলের জন্য উপদেশ

লোকমান হাকিম তাঁর ছেলেকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন, তা আল্লাহর এত পছন্দ হয় যে কোরআনে স্থান পায়। সুরা লোকমানে বর্ণিত ১০টি উপদেশ হলো—

১. আল্লাহর সঙ্গে শরিক না করা: ‘হে ছেলে, আল্লাহর সঙ্গে শরিক কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা মহা অন্যায়।’ (আয়াত: ১৩)

২. পিতা-মাতার সঙ্গে ভালো আচরণ: ‘আর আমি মানুষকে তার মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি…।’ (আয়াত: ১৪)

৩. অন্যায় থেকে বিরত থাকা: ‘হে ছেলে, কোনো বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয়…আল্লাহ তা–ও উপস্থিত করবেন।’ (আয়াত: ১৬)

৪. নামাজ আদায়: ‘হে ছেলে, নামাজ কায়েম করো।’ (আয়াত: ১৭)

৫. সৎ কাজের আদেশ, মন্দ কাজের নিষেধ: ‘সৎ কাজে আদেশ দাও, মন্দ কাজে নিষেধ করো।’ (আয়াত: ১৭)

৬. বিপদে ধৈর্য: ‘বিপদ–আপদে সবর করো। নিশ্চয়ই এটা সাহসিকতার কাজ।’ (আয়াত: ১৭)

৭. মানুষকে অবজ্ঞা না করা: ‘অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা কোরো না।’ (আয়াত: ১৮)

৮. অহংকার না করা: ‘পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ কোরো না।’ (আয়াত: ১৮)

৯. বিনয়ী হওয়া: ‘পদচারণে মধ্যবর্তিতা অবলম্বন করো।’ (আয়াত: ১৮)

১০. নিচু কণ্ঠে কথা বলা: ‘কণ্ঠ নিচু করো। নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।’ (আয়াত: ১৮)

লোকমান হাকিমের এই উপদেশগুলো কেবল তাঁর ছেলের জন্য নয়, সব মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়—সত্য আর সংযমই মানুষকে মর্যাদার শিখরে নিয়ে যায়।

লেখক: আলেম