পাথেয়

অপ্রত্যাশিত দায়িত্ব অদেখা রিজিকের দরজা খোলে

জীবনে হঠাৎ করেই এমন কিছু ঘটে যায়, যা আমাদের পুরো পরিকল্পনাকে ওলট–পালট করে দেয়। একটা গল্প দিয়ে শুরু করি। ধরুন, আপনি প্রতি মাসে গ্রামের বাড়িতে দশ হাজার টাকা পাঠান। বাজেট মিলিয়ে সংসার চলছে কোনো রকমে। হঠাৎ একদিন এমন একটা পরিস্থিতি এল, যেখানে আরও দশ হাজার টাকা বাড়তি খরচ করতে হবে। মাথায় হাত! এত টাকা আসবে কোথা থেকে?

প্রথমে মনে হয় আল্লাহ কেন এমন করলেন? কীভাবে সামলাব এত দায়িত্ব? কিন্তু কিছুদিন পরেই দেখা যায়, এক অভাবনীয় জায়গা থেকে রিজিকের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। যে দায়িত্বটি নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেটিই খুলে দিয়েছে নতুন উপার্জনের দরজা। যে কাজটা আপনার করার কথাই ছিল না, আল্লাহ সেখান থেকেই আপনার সম্মানজনক একটি আয়ের ব্যবস্থা করে দিলেন।

প্রথমে মনে হয় আল্লাহ কেন এমন করলেন? কীভাবে সামলাব এত দায়িত্ব? কিন্তু কিছুদিন পরেই দেখা যায়, এক অভাবনীয় জায়গা থেকে রিজিকের ব্যবস্থা হয়ে গেছে।

আল্লাহ তাআলা কোরআনে বলেছেন: ‘আর যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য নিষ্কৃতির পথ করে দেবেন। এবং তিনি তাকে তার ধারণাতীত উৎস থেকে রিজিক দেবেন।’ (সুরা আত-তালাক, আয়াত: ২-৩)

এই আয়াতে আল্লাহ যে কথা বলেছেন, তা আমাদের জীবনে বারবার ঘটে। যে বোঝা আজ কাঁধে চেপে বসেছে, কাল হয়তো সেটিই হবে আপনার উন্নতির সিঁড়ি।

বিজ্ঞান যা বলে

মজার ব্যাপার হল, আধুনিক মনোবিজ্ঞানও এই সত্যকে স্বীকার করে। গবেষকেরা দেখেছেন, চাপ ও চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি মানুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সক্ষমতা বের করে আনে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা জীবনে মধ্যম মাত্রার চাপ সামলেছেন, তারা পরবর্তী সময়ে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলায় বেশি দক্ষ হয়ে ওঠেন। (সিওয়ার্ড এট আল., সাইকোলজি অব স্ট্রেস, জোনস অ্যান্ড বার্টলেট লার্নিং, ২০১৮, পৃ. ১২৩-১২৫)

এর মানে হলো, আল্লাহ যখন কাউকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেন, তখন সেই দায়িত্ব পালনের ক্ষমতাও তার ভেতরে তৈরি করে দেন। এটা কোনো শাস্তি নয়, বরং প্রশিক্ষণ। যে দায়িত্ব আজ ভারী মনে হচ্ছে, কাল সেটিই আপনাকে শক্তিশালী করবে।

আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না।
কোরআন, সুরা বাকারা, আয়াত: ২৮৬

আপনার ভেতরে থাকা সুপ্ত প্রতিভাকে প্রকাশ করে কাজে পরিণত করবে। এই অতিরিক্ত দায়িত্ব আপনার কাঁধে না এলে হয়তো আপনার এই সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ কখনোই হতো না।

বাস্তব জীবনের উদাহরণ

আমরা অনেক সময় দেখি, কেউ চাকরির পাশাপাশি হঠাৎ করে অসুস্থ মা–বাবার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বেসামাল হয়ে পড়ে। কখনো কখনো কাজের পাশাপাশি নতুন কিছু দায়দায়িত্ব তাকে ভারাক্রান্ত করে তোলে।

প্রথমে মনে হয়, সব শেষ। কিন্তু কিছুদিন পর দেখা যায়, অফিসে প্রমোশন হয়েছে, অথবা কোনো পুরোনো বিনিয়োগ থেকে টাকা এসেছে, অথবা একটা নতুন আয়ের পথ খুলে গেছে, যা সে কখনো কল্পনাও করেনি।

আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৮৬)

মানে, যে বোঝা তিনি দিয়েছেন, সেটা বহন করার ক্ষমতাও তিনিই তাঁর বান্দাকে দিয়ে দেন। শুধু দরকার ধৈর্য, বিশ্বাস আর তাওয়াক্কুল।

তাওয়াক্কুল মানে হাত গুটিয়ে বসে থাকা নয়

অনেকে ভাবেন, আল্লাহর ওপর ভরসা মানে কিছু না করে বসে থাকা। কিন্তু এটা ভুল ধারণা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘যদি তোমরা আল্লাহর ওপর যথার্থভাবে তাওয়াক্কুল করতে, তাহলে তিনি তোমাদের রিজিক দিতেন, যেভাবে পাখিদের রিজিক দেন—সকালে খালি পেটে বের হয় এবং সন্ধ্যায় পেট ভরে ফিরে আসে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২,৩৪৪)

খেয়াল করুন, পাখিরা কিন্তু বসে থাকে না। তারা সকালে খাবারের খোঁজে বের হয়। এটাই তাওয়াক্কুলের আসল মানে—আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। দায়িত্ব এলে ভয় না পেয়ে এগিয়ে যাওয়া।

সন্তানদের যা শেখানো দরকার

আমাদের সন্তানদের ছোটবেলা থেকে শেখানো দরকার যে দায়িত্ব মানে বোঝা নয়, সম্মান। যে বাচ্চা ছোটবেলায় ছোট ভাইবোনের দেখাশোনা করে, সে বড় হয়ে ভালো নেতা হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, যে শিশুরা ছোটবেলায় দায়িত্ব নিতে শেখে, তারা পরবর্তী সময়ে সমস্যা সমাধানে বেশি পারদর্শী হয়। (রথবার্ট এট আল., হ্যান্ডবুক অব চাইল্ড সাইকোলজি, উইলি, ২০০৬, পৃ. ৯৯-১০১)

যদি আমরা সন্তানদের সব দায়িত্ব থেকে দূরে রাখি, তাহলে তারা জীবনের কঠিন সময়ে দুর্বল হয়ে পড়বে। তাদের বুঝতে হবে, দায়িত্ব মানে প্রশিক্ষণ, শাস্তি নয়।

নবীজির জীবন থেকে শিক্ষা

নবীজি (সা.) যখন মক্কা ছেড়ে মদিনায় গেলেন, তখন তাঁর কাঁধে ছিল পুরো উম্মাহর দায়িত্ব। একজন মানুষের জন্য কি সম্ভব ছিল একটি নতুন রাষ্ট্র, নতুন সমাজ গড়া? কিন্তু আল্লাহ তাঁকে সেই দায়িত্বের সঙ্গে শক্তিও দিয়েছিলেন।

মদিনায় গিয়ে তিনি শুধু মসজিদ বানাননি, গড়েছেন একটি পূর্ণাঙ্গ সভ্যতা। এই ঘটনা থেকে আমরা শিখি, দায়িত্ব এড়িয়ে নয়, বরং গ্রহণ করেই সফলতা আসে।

হজরত ইউসুফ (আ.) জেলখানা থেকে মিসরের শাসক হয়েছিলেন। মুসা (আ.) ফেরাউনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন জাতিকে মুক্ত করতে। এই সব নবী সফল হয়েছেন, কারণ তাঁরা দায়িত্ব থেকে পালাননি।

যখন দায়িত্ব বাড়ে, মনে রাখবেন

আজকের দিনে মানুষ দায়িত্ব এড়াতে চায়। বিয়ে, সন্তান, পরিবার—সবকিছু থেকে দূরে থাকতে চায় নিজেকে ‘ফ্রি’ মনে করে। কিন্তু আসল স্বাধীনতা আসে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে। দায়িত্ব থেকে পালিয়ে নয়।

যখন হঠাৎ দায়িত্ব বেড়ে যায়, মনে করবেন—এটা হয়তো নতুন কোনো দরজার শুরু। যে দায়িত্ব আজ আপনাকে ক্লান্ত করছে, কাল সেটাই হয়তো আপনাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আল্লাহ আপনার রিজিক আগে থেকেই নির্ধারণ করে রেখেছেন।

‘অপ্রত্যাশিত দায়িত্ব অদেখা রিজিকের দরজা খোলে’—এটা শুধু কোরআনের একটি বক্তব্য বা থিওরি নয়, বরং এটি জীবনের একটি চিরন্তন সত্য। এই সত্যকে আমাদের প্রতিদিনের জীবনে, প্রতিটি সিদ্ধান্তে মনে রাখতে হবে।

আরবি প্রবাদে আছে, ‘যে আল্লাহর ওপর ভরসা করে দায়িত্ব নেয়, আল্লাহ তার চলার পথ সহজ করে দেন।’ তাই অপ্রত্যাশিত দায়িত্ব এলে ভয় নয়, বরং আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে এগিয়ে যান। মনে রাখবেন—যে দায়িত্ব আপনাকে আজ ক্লান্ত করছে, সেটিই হতে পারে আপনার উন্নতির সিঁড়ি।

muhsin.du@gmail.com

মুহাম্মাদ মুহসিন মাশকুর: খণ্ডকালীন শিক্ষক, আরবি বিভাগ, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়