আমরা প্রায়ই বক্তব্যে শুনি বা কোনো লেখায় পড়ি যে, এই কাজের ফজিলত বেশি বা অমুক আমল করার এমন এমন ফজিলত। এই ‘ফজিলত’ শব্দের অর্থ কী?
ইসলামে ফজিলত এমন একটি ধারণা, যা আরও বেশি করে করতে উৎসাহ দেয়। এমনিতে ফজিলত মানে মর্যাদা বোঝায়। তবে একই সঙ্গে তা ভালো গুণ, চরিত্র, আচরণ ও জীবনযাপনের উৎকর্ষের একটি মাপকাঠি।
ইসলামে এই ধারণা আরও একটু গভীর এবং জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আসুন, আমরা একটু খতিয়ে দেখি।
‘ফজিলত’ শব্দটি এসেছে আরবি ‘ফজল’ শব্দ থেকে, যার মানে হলো কিছু বাড়তি বা উৎকর্ষ। যেমন কেউ যদি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ভালো কাজ করে, তাকে আমরা ফজিলতের অধিকারী বলতে পারি। কোনো আমল বা ইবাদতে যদি উৎসাহ দেওয়ার উদ্দেশ্য হয়, তখন বলা হয়, এটা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ আমল।
ইসলামে ফজিলত এমন একটি ধারণা, যা আরও বেশি করে করতে উৎসাহ দেয়। এমনিতে ফজিলত মানে মর্যাদা বোঝায়। তবে একই সঙ্গে তা ভালো গুণ, চরিত্র, আচরণ ও জীবনযাপনের উৎকর্ষের একটি মাপকাঠি।
আরবি ভাষার বিখ্যাত অভিধান তাজুল আরুস–এ বলা হয়েছে, ‘ফজল’ হলো এমন কিছু, যা সাধারণের চেয়ে বেশি বা উন্নত। এই বাড়তি গুণ দুই ধরনের হতে পারে—প্রশংসনীয় বা নিন্দনীয়। প্রশংসনীয় ফজল হলো জ্ঞান, ধৈর্য বা উদারতার মতো গুণ। আর নিন্দনীয় ফজল হলো অতিরিক্ত রাগ বা অহংকারের মতো বৈশিষ্ট্য। তবে ‘ফজিলত’ শব্দটি সাধারণত ভালো গুণের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়।
ইসলামে ফজিলত কেবল ভালো গুণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি এমন একটি ধারণা, যা জীবনের সব ক্ষেত্রে ভারসাম্য ও উৎকর্ষ নিয়ে আসে। শিরাজী বলেছেন, ফজিলত হলো অতিরিক্ততা ও ন্যূনতার মাঝামাঝি অবস্থান। (আল–ফাযিলা, পৃ. ১২৩)
যেমন সাহস একটি ফজিলত। কিন্তু অতিরিক্ত সাহস বেপরোয়া হয়ে যায়, আর ন্যূনতা ভিতুত্বের দিকে নিয়ে যায়। এই ভারসাম্যই ফজিলতের মূলকথা।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘সর্বোত্তম কাজ হলো মধ্যম পন্থা।’ (সুনান বায়হাকি, হাদিস: ৬,৪৩৫)
বোঝা যায়, ইসলামে ফজিলতের মূল ধারণা হলো, এমন গুণ, যা শরিয়াহ ও সুস্থ বিবেক দ্বারা প্রশংসিত। যেমন সততা, ধৈর্য, উদারতা বা জ্ঞানার্জন ইত্যাদি।
আজানের পর আমরা দোয়া করি, ‘আ–তি মুহাম্মাদিনিল ওয়াসিলাহ, ওয়াল ফাজিলাহ, ওয়াদ্দারাজাতার রকিআহ।’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ, মুহাম্মদ (সা.)–কে ওয়াসিলা, ফজিলত ও উচ্চ মর্যাদা দান কর।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬১৪)
আল্লাহ তোমাদের কাউকে কারও ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন।সুরা নাহল, আয়াত: ৭১
এই দোয়ায় ফজিলত বলতে নবীজি (সা.)–এর জন্য যে সর্বোচ্চ শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা কামনা করা হয়েছে, তা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় স্থানে প্রযোজ্য।
রাগিব ইসফাহানি ফজিলত বা ফজলের তিনটি ধরন ব্যাখ্যা করেছেন:
১. জাতিগত উৎকর্ষ:যেমন মানুষের তুলনায় অন্য প্রাণীর শ্রেষ্ঠত্ব।
২. প্রকারভেদে উৎকর্ষ: যেমন একজন মানুষের তুলনায় আরেকজনের শ্রেষ্ঠত্ব।
৩. ব্যক্তিগত উৎকর্ষ: যা কেউ নিজের প্রচেষ্টায় অর্জন করতে পারে, যেমন জ্ঞান বা ভালো চরিত্র। (মুফরাদাত ফি গারিবিল কোরআন, পৃ. ৬৪৫)
প্রথম দুটি উৎকর্ষ স্বাভাবিক, যা পরিবর্তন করা যায় না। কিন্তু তৃতীয়টি এমন, যা আমরা নিজেদের চেষ্টায় অর্জন করতে পারি। কোরআনে এসেছে, ‘আল্লাহ তোমাদের কাউকে কারও ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন।’ (সুরা নাহল, আয়াত: ৭১)
এখানে শ্রেষ্ঠত্ব বলতে সম্পদ, মর্যাদা বা ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে। আবার সুরা নিসায় বলা হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহর কাছে তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা কর’ (আয়াত: ৩২)। এখানে ফজল মানে আল্লাহর দেওয়া বাড়তি নিয়ামত।
ইসলামে ফজিলতের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহান প্রতিদান।’ (সুরা ফাতির, আয়াত: ৭)
বোঝা যায়, ফজিলত আমাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতার পথ দেখায়।
সুতরাং ফজিলত মানে শুধু ভালো মানুষ হওয়া নয়, এটি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উৎকর্ষ ও ভারসাম্যের প্রতীক। ভাষাগতভাবে এটি যেমন শ্রেষ্ঠত্ব ও বাড়তি নিয়ামতের ধারণা বহন করে, তেমনি ইসলামেও এটি নৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক গুণের সমন্বয়।
আমরা যদি শুধু ফজিলত শব্দের দিকে লক্ষ না করে ইসলামে ফজিলতের মূল ধারণাটি ধারণ করতে পারি, তাহলে নিজেদের ও সমাজের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারব। ফজিলত আমাদের শুধু ভালো মানুষই নয়, আল্লাহর কাছে প্রিয় বান্দাও করে তুলতে পারে।
সূত্র: ইসলাম অনলাইন ডট নেট