ইরানের মাশহাদ শহরের মিল্লাত পার্কে নিজামুল মুলকের একটি ভাস্কর্য
ইরানের মাশহাদ শহরের মিল্লাত পার্কে নিজামুল মুলকের একটি ভাস্কর্য

বই পরিচিতি

‘ইসলামি শাসনে’ নিজামুল মুলকের ব্যবস্থাপত্র

আজকের অনেক মুসলিম মনে করেন, ইসলামি শাসনব্যবস্থা আর বাস্তবসম্মত নয়। আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ব্যর্থতা দেখে তাঁরা ধরে নেন, আমাদের ঐতিহ্যে কোনো সমাধান নেই। ফলে অজ্ঞাতসারে তাঁদের মধ্যে হীনম্মন্যতা জেঁকে বসে। মুসলিমদের নিজস্ব রাজনৈতিক মাস্টারপিস—নিজামুল মুলকের সিয়াসাতনামার কথা ভুলে যান। যে বই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উজির, সুলতান এবং রাষ্ট্রনায়কদের দ্বারা অধ্যয়ন করা হয়েছে।

এটি কেবল কৌশলই নয়, নীতি, ন্যায়বিচার এবং দূরদর্শিতাও প্রদান করেছে। আমরা আমাদের মডেল ভুলে গেছি। কেউ কেউ তুর্কি ধারাবাহিকের মাধ্যমে নিজামুল মুলকের নাম শুনেছেন, কিন্তু তাঁর অবদানের গভীরতা খুব কমই বোঝেন। এখন সময় এসেছে টেলিভিশনের বাইরে গিয়ে আমাদের হারানো উত্তরাধিকার পুনরুদ্ধারের।

নিজামুল মুলক কে ছিলেন?

নিজামুল মুলক (মৃত্যু: ১০৯২) কোনো সাধারণ উজির ছিলেন না। তিনি সেলজুক শাসক আলপ আরসালান ও মালিক শাহের অধীনে কাজ করেছেন এবং ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী মুসলিম সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। তিনি কেবল রাজদরবার পরিচালনা করেননি, একটি সভ্যতা নির্মাণ করেছেন।

তাঁর সিয়াসাতনামা (শাসনের গ্রন্থ) কর, বিচার এবং সামরিক শৃঙ্খলার মতো বিষয়ে শাসকদের জন্য নির্দেশিকা। নিজাম প্রতিটি ধারণাকে আল্লাহর ভয় এবং ন্যায়বিচারের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। তিনি শাসনকে আল্লাহর আমানত হিসেবে দেখতেন, ক্ষমতা দখলের খেলা হিসেবে নয়। তিনি বুঝতেন, শাসক জনগণের পাশাপাশি স্রষ্টার কাছেও জবাবদিহি করবেন।

মুসলিমদের নিজস্ব রাজনৈতিক মাস্টারপিস—নিজামুল মুলকের সিয়াসাতনামার কথা ভুলে যান। যে বই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উজির, সুলতান এবং রাষ্ট্রনায়কদের দ্বারা অধ্যয়ন করা হয়েছে।

নিজাম কেবল বই লিখেই থেমে থাকেননি। তিনি প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত নিজামিয়া মাদ্রাসাগুলো ছিল ইসলামি বিশ্বের শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এগুলো কেবল ধর্মতত্ত্ব নয়, ইসলামি বিজ্ঞান, দর্শন, রাষ্ট্রকৌশল ও তাসাউফ শিক্ষা দিত। ইমাম গাজ্জালি এই ব্যবস্থার একজন স্নাতক ও বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসার সেলিব্রিটি অধ্যাপক ছিলেন।

এই ব্যবস্থা এমন প্রজন্ম তৈরি করেছে, যারা আইনি দক্ষতা, আধ্যাত্মিক শৃঙ্খলা এবং মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের সমন্বয় করেছে। সালাহউদ্দিন আইয়ুবি পরোক্ষভাবে এই বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের সুবিধাভোগী ছিলেন। তিনি এবং তাঁর সামরিক ও প্রশাসনিক অভিজাতরা নিজামিয়া দৃষ্টিভঙ্গি—ইসলামি ঐক্য, আধ্যাত্মিক পরিশীলন এবং উম্মাহর সেবা—দ্বারা গঠিত হয়েছিলেন।

নিজাম একটি গোয়েন্দা নেটওয়ার্কও গড়ে তুলেছিলেন, যা বাতিনি ইসমাইলি গোষ্ঠী ‘হাশাশিন’ থেকে সাম্রাজ্যকে রক্ষা করত। তিনি নৃশংসতার পরিবর্তে কৌশল ব্যবহার করে মুসলিম উম্মাহকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করেন। তিনি ছিলেন সেলজুক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার স্থপতি, সুলতানদের পরামর্শদাতা এবং জ্ঞান ও ক্ষমতার ঐক্যের প্রতীক।

১৮৯১ সালে ইরানে প্রকাশিত সিয়াসতনামার প্রচ্ছদ
নিজামুল মুলক ‘মডেল’

নিজামুল মুলক ভিন্ন বিশ্বে বাস করতেন। তিনি আল্লাহভীতি ও শরিয়াহ সম্মানকারী মুসলিম শাসকদের পথ দেখিয়েছেন। নিজাম ন্যায়বিচারের ওপর জোর দেন, জনগণ ও আল্লাহর কাছে জবাবদিহির কথা বলেন। ধর্ম ছিল তাঁর জন্য বৈধতার উৎস। নিজাম রাষ্ট্রকে ঐশী আইনের সেবক হিসেবে দেখতেন।

আজকাল রাজনৈতিক তত্ত্ব এই বিপজ্জনক ধারণা প্রচার করে যে কেউ একই সঙ্গে নৈতিক ও রাজনৈতিক সততা বজায় রাখতে পারবেন না। তাঁদের মতে, সাধুকে দুনিয়া থেকে সরে যেতে হবে আর রাজনীতিবিদকে নীতি ত্যাগ করতে হবে। এই মিথ্যা বিভাজন তাঁদের ধর্মীয় ইতিহাসের ফল—যেখানে গির্জা ও রাষ্ট্র প্রায়ই সংঘাতে লিপ্ত হতো। ইসলাম এই বিভাজন প্রত্যাখ্যান করে।

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন রাষ্ট্রপ্রধান, সেনাপতি, প্রধান বিচারক এবং আধ্যাত্মিকভাবে সর্বোচ্চ মানুষ। তাঁকে রাজনীতি ও তাকওয়ার মধ্যে বেছে নিতে হয়নি। খোলাফায়ে রাশেদিন এই মডেল অনুসরণ করেন। হজরত আবু বকর (রা.) সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেন এবং কোরআন সংরক্ষণ করেন। হজরত ওমর (রা.) ন্যায়বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। হজরত উসমান (রা.) কোরআন সংকলন করেন। হজরত আলী (রা.) পাণ্ডিত্য ও নেতৃত্বের সমন্বয় করেন।

পরবর্তীকালে উমর ইবনে আবদুল আজিজ এমন শাসন করেন যে তাঁকে ‘পঞ্চম খলিফা’ বলা হয়। তাঁরা সবাই শাসন করেছেন, ইবাদত করেছেন এবং সেবা করেছেন।

তিনি দেখিয়েছেন, ইসলামের ধর্মতত্ত্ব সহজ, বিশুদ্ধ ও যুক্তিগ্রাহ্য। এক আল্লাহ, এক বাণী—কোনো রহস্য নেই।

নিজামুল মুলক তাঁর সিয়াসতনামায় ইসলামের শক্তি ও আন্তরিকতার সমন্বয়ে একটি মডেল উপস্থাপন করেছেন এবং তাঁর সময়ে সেগুলো প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ইসলামের ধর্মতত্ত্ব সহজ, বিশুদ্ধ ও যুক্তিগ্রাহ্য। এক আল্লাহ, এক বাণী—কোনো রহস্য নেই।

ইসলামি আইন সামগ্রিক, যা জীবনের প্রতিটি দিক—পরিবার, রাজনীতি, অর্থনীতি—নির্দেশ করে। মসজিদ ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো যুদ্ধ ছিল না। শরিয়াহ ছিল মানদণ্ড, সমস্যা নয়। ফলে ইসলাম ব্যর্থ হয়নি।

বইটি একাদশ শতকে ফারসি ভাষায় লেখা হয়েছে।  এতে ধর্ম, রাজনীতি নিয়ে ৫০টি অধ্যায় ও অন্যান্য বিষয়ে ১১টি অধ্যায় রয়েছে যা নিজামের হত্যার পূর্বে সংক্ষিপ্তরূপে লেখা হয়।

এর সর্বপ্রাচীন পান্ডুলিপি ইরানের তাব্রিজ জাতীয় গ্রন্থাগারে রক্ষিত রয়েছে।

সূত্র: মুসলিম স্কেপটিক ডটকম