বিধান

পশু জবাই করার নিয়ম ও দোয়া

ইসলামে খাদ্য গ্রহণ কেবল দৈহিক চাহিদা পূরণের বিষয় নয়; এটি ইবাদত ও তাকওয়ার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। একজন মুসলমান কী খাবে, কীভাবে খাবে—এমনকি সেই খাদ্য প্রস্তুতের প্রক্রিয়াও ইসলামি শরিয়তের অধীন।

পশু জবাই করার নিয়ম এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কোরআন ও হাদিসে পশু জবাইয়ের পদ্ধতি সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়েছে, যাতে মানবিকতা, পবিত্রতা ও আল্লাহভীতির সমন্বয় ঘটে।

পশু জবাই কেন নিয়মবদ্ধ

কোরআন ঘোষণা করেছে, “তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত জন্তু, রক্ত, শূকরের মাংস এবং যা আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে জবাই করা হয়েছে।” (সুরা মায়িদা, আয়াত: ৩)

এই আয়াত স্পষ্ট করে দেয়, জবাইয়ের পদ্ধতি ও উদ্দেশ্য যদি আল্লাহর জন্য না হয়, তবে সেই খাদ্য হালাল নয়। তাই পশু জবাই কেবল ছুরি চালানোর কাজ নয়; এটি একটি ইবাদতসম আচরণ।

পশু জবাইয়ের মৌলিক শর্ত

ইসলামি ফিকহ অনুযায়ী পশু জবাই সহিহ হওয়ার জন্য কয়েকটি শর্ত পূরণ হওয়া জরুরি।

প্রথমত, জবাইকারী মুসলমান অথবা আহলে কিতাব হতে হবে। কারণ কোরআনে আহলে কিতাবের জবাই করা খাদ্য হালাল বলা হয়েছে। (সুরা মায়িদা, আয়াত: ৫)

দ্বিতীয়ত, জবাইয়ের সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা আবশ্যক। ইচ্ছাকৃতভাবে বিসমিল্লাহ না বললে জবাই বিশুদ্ধ হয় না এবং সেই প্রাণীর গোশত খাওয়া মুসলমােনর জন্য বৈধ হবে না। আল্লাহ বলেছেন, “যে জবাইয়ের সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে না, তা খেয়ো না।” (সুরা আনআম, আয়াত: ১২১)

তৃতীয়ত, ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করতে হবে এবং পশুকে অপ্রয়োজনীয় কষ্ট দেওয়া যাবে না।

রাসুল (স.) বলেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ সব বিষয়ে দয়া নির্ধারণ করেছেন। তোমরা যখন জবাই করো, তখন সুন্দরভাবে জবাই করো; ছুরি ধারালো করো এবং পশুকে কষ্ট দিও না।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৯৫৫)

জবাইয়ের সময় কাটা আবশ্যক অঙ্গ

ফিকহবিদদের মতে, জবাইয়ের সময় অন্তত চারটির মধ্যে তিনটি কাটা আবশ্যক—

  • গলা (হালকুম)

  • খাদ্যনালি

  • এবং দুই পাশের রগ

এতে পশুর দ্রুত মৃত্যু ঘটে এবং রক্ত বের হয়ে যায়, যা স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। ইমাম নববি বলেন, এই পদ্ধতি পশুর কষ্ট কমায় এবং মানুষের জন্য খাদ্যকে নিরাপদ করে। (শারহ সহিহ মুসলিম, ১৩/১২৩, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯৬)

পশু জবাই করার দোয়া

জবাই করার সময় আল্লাহর নাম নেওয়া অপরিহার্য। আর দোয়া পড়া সুন্নাহ:

দোয়া: বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার।

অর্থ: আল্লাহর নামে শুরু করছি, আল্লাহ সবচেয়ে মহান।

কোরবানির সময় অতিরিক্ত এই দোয়া পড়া সুন্নাহ: আল্লাহুম্মা হাজা মিনকা ওয়া লাকা (অর্থ: হে আল্লাহ, এটি তোমার পক্ষ থেকেই এবং তোমার জন্যই)।

পশুর প্রতি দয়া ও মানবিকতা

ইসলাম পশুদের প্রতিও দয়ার শিক্ষা দেয়। রাসুল (স.) একবার দেখলেন, এক ব্যক্তি ছুরি ধার দিচ্ছে পশুর সামনে। তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “তুমি কি তাকে দু’বার হত্যা করতে চাও?” (মুসতাদরাক হাকিম, হাদিস: ৭৫৭৩)

এই হাদিস প্রমাণ করে, পশুকে ভয় দেখানো, অযথা কষ্ট দেওয়া বা নিষ্ঠুর আচরণ ইসলামে নিষিদ্ধ।

আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, দ্রুত ও সঠিকভাবে গলা কেটে রক্ত বের করে দিলে মাংসে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া কম থাকে। ইসলামি জবাই পদ্ধতিতে পশুর রক্ত প্রায় সম্পূর্ণ বের হয়ে যায়, যা মাংসকে স্বাস্থ্যসম্মত করে।

পশু জবাই ইসলামে একটি পূর্ণাঙ্গ ইবাদত, যেখানে বিশ্বাস, মানবিকতা ও স্বাস্থ্য—এই তিনটির সমন্বয় ঘটে। সঠিক নিয়ম অনুসরণ করে জবাই করলে তা কেবল হালাল খাদ্যের নিশ্চয়তা দেয় না; বরং তা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম হয়।

তাই একজন মুসলমানের কর্তব্য হলো জবাইয়ের প্রতিটি ধাপে সুন্নাহ ও শরিয়তের নির্দেশনা অনুসরণ করা এবং পশুর প্রতি দয়া ও সম্মান বজায় রাখা।