ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি ভয়, ঘৃণা বা বৈষম্যমূলক মনোভাব, বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা। বিশেষ করে মুসলিম নারীরা, যাঁরা হিজাব বা ধর্মীয় পোশাকের কারণে সহজেই চিহ্নিত হন, প্রায়ই আক্রমণের শিকার হন।
তাই ভেবে দেখা দরকার, একজন মুসলিম নারী ইসলামোফোবিক আক্রমণের মুখে কী করতে পারেন? মনে রাখতে হবে, কোরআনে (সুরা আহযাব আয়াত: ৫৯) হিজাবের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যাতে মুসলিম নারীরা সম্মান ও নিরাপত্তার সঙ্গে চলাফেরা করতে পারেন।
সম্ভব হলে জনবহুল স্থানে চলে যাওয়া বা কাছাকাছি নিরাপত্তা কর্মীদের সাহায্য নেওয়া উচিত। তাৎক্ষণিক সেবা পাওয়ার জন্য হটলাইন রয়েছে, ৯৯৯ নম্বরে কল করা যেতে পারে।
ইসলামোফোবিক আক্রমণ মৌখিক, শারীরিক বা মানসিক হতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে নিজেকে নিরাপদ ও সম্মানিত রাখার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:
১. শান্ত ও ধৈর্য ধরা: কোরআন মুসলিমদের ধৈর্য ও সংযমের নির্দেশ দেয়। সুরা বাকারাহ (আয়াত: ১৫৩) বলে, ‘হে মুমিনগণ, ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’
আক্রমণের মুখে শান্ত থাকা এবং উত্তেজিত না হওয়া নিজের নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
২. নিরাপত্তার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া: যদি আক্রমণ শারীরিক হুমকির দিকে যায়, তবে নিজেকে নিরাপদ রাখা প্রথম অগ্রাধিকার। সম্ভব হলে জনবহুল স্থানে চলে যাওয়া বা কাছাকাছি নিরাপত্তা কর্মীদের সাহায্য নেওয়া উচিত। তাৎক্ষণিক সেবা পাওয়ার জন্য হটলাইন রয়েছে, ৯৯৯ নম্বরে কল করা যেতে পারে।
৩. ঘটনাটি রিপোর্ট করা: ইসলামোফোবিক আক্রমণ একটি হেট ক্রাইম হিসেবে বিবেচিত হয়। ঘটনাটি স্থানীয় পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করা উচিত। ঘটনার বিবরণ, সময়, স্থান এবং সম্ভব হলে প্রমাণ (যেমন ভিডিও বা ছবি) সংরক্ষণ করা উচিত।
৪. সামাজিক সমর্থন নেওয়া: স্থানীয় মুসলিম সংগঠন বা নাগরিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা, যারা মানসিক ও আইনি সহায়তা দিতে পারে। ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করা সংগঠনগুলো এ ধরনের ঘটনা মোকাবিলায় পরামর্শ দিয়ে থাকে।
৫. পরিস্থিতি বুঝে প্রতিক্রিয়া জানানো: যদি পরিস্থিতি নিরাপদ মনে হয়, তবে সম্মানজনকভাবে উত্তর দেওয়া যেতে পারে। শান্তভাবে বলা যেতে পারে: ‘আপনার কথাগুলো আঘাত করছে, দয়া করে সম্মানের সঙ্গে কথা বলুন।’ বা হিজাব সম্পর্কে ভুল ধারণার জবাবে বলা যেতে পারে, ‘হিজাব আমার ধর্মীয় বিশ্বাসের অংশ এবং আমার পছন্দ, এটি আমাকে শক্তি দেয়।’ এটি তার অজ্ঞতা দূর করতে সাহায্য করতে পারে।
৬. মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া: ইসলামোফোবিক আক্রমণ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করতে পারে। পরিবার, বন্ধু বা কাউন্সেলরের সঙ্গে কথা বলা এবং নামাজ ও দোয়া মাধ্যমে আল্লাহর কাছে শান্তি প্রার্থনা করা মানসিক শক্তি ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। সুরা শারহ (আয়াত: ৫-৬) বলে, ‘নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গে স্বস্তি আছে।’
সলামোফোবিক আক্রমণ একটি হেট ক্রাইম হিসেবে বিবেচিত হয়। ঘটনাটি স্থানীয় পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করা উচিত।
ইসলামোফোবিয়া বিশ্বব্যাপী একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা। ২০১৭ সালে রানিমেড ট্রাস্টের একটি প্রতিবেদনে ইসলামোফোবিয়াকে ‘সাংস্কৃতিক বর্ণবাদ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, কারণ এটি প্রায়ই মুসলিমদের ‘বহিরাগত’ হিসেবে চিত্রিত করে। (রানিমেড ট্রাস্ট ২০১৭, ইসলামোফোবিয়া, স্টিল আ চ্যালেঞ্জ ফর আস অল)
২০১৮ সালে ব্রিটিশ সংসদের অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপ (এপিপিজি) অন ব্রিটিশ মুসলিমসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে হিজাব পরিহিত নারীরা বিশেষভাবে ইসলামোফোবিক আক্রমণের শিকার হন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ফান্ডামেন্টাল রাইটস এজেন্সি (এফআরএ) ২০১৭ সালে একটি জরিপে জানায় যে ইউরোপের ৩১ শতাংশ মুসলিম নারী বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ১৭ শতাংশ হিজাব পরার কারণে মৌখিক বা শারীরিক হয়রানির শিকার হন।
যুক্তরাষ্ট্রে কেয়ারের ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসলামোফোবিক ঘটনার ৫৬ শতাংশ ক্ষেত্রে মুসলিম নারীরা লক্ষ্যবস্তু হন। এই জরিপগুলো দেখায় যে হিজাব পরিহিত নারীরা ইসলামোফোবিয়ার প্রধান শিকার।
ইসলাম ধৈর্য, সম্মান ও জ্ঞানের মাধ্যমে অজ্ঞতা ও ঘৃণার মোকাবিলার নির্দেশ দেয়। সুরা ফুসসিলাত (আয়াত: ৩৪) বলে, ‘ভালো ও মন্দ এক নয়। তুমি মন্দকে উত্তম পন্থায় প্রতিহত করো, তাহলে দেখবে যে তোমার সঙ্গে যার শত্রুতা ছিল, সে তোমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে যাবে।’
এই আয়াত ইঙ্গিত করে যে শান্ত ও সম্মানজনক প্রতিক্রিয়া ঘৃণা দূর করতে পারে।
হাদিসে নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,০১৮)
এটি মুসলিম নারীদের শিক্ষা দেয় যে অপমানের জবাবে ভালো ব্যবহার বা নীরবতা বেছে নেওয়া উত্তম। তবে নিজের সম্মান ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
ইউরোপের ৩১ শতাংশ মুসলিম নারী বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ১৭ শতাংশ হিজাব পরার কারণে মৌখিক বা শারীরিক হয়রানির শিকার হন।
ইসলামোফোবিয়া মোকাবিলায় সমাজের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। ইসলামোফোবিক আক্রমণের মুখে মুসলিম নারীদের ধৈর্য, সংযম ও শিক্ষিত প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেদের রক্ষা করা উচিত।
নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ঘটনা রিপোর্ট করা এবং সামাজিক সমর্থন নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামের নির্দেশনা অনুসরণ করে এবং শিক্ষার মাধ্যমে অজ্ঞতা দূর করে আমরা একটি সম্মানজনক সমাজ গড়ে তুলতে পারি।
সূত্র: দ্য মুসলিম ভাইব ডট কম