‘কেমন বাংলাদেশ চাই: দেয়াল থেকে ইশতেহারে’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে
‘কেমন বাংলাদেশ চাই: দেয়াল থেকে ইশতেহারে’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে

গোলটেবিল বৈঠক

কেমন বাংলাদেশ চাই: দেয়াল থেকে ইশতেহারে

আইআইডি ইয়ুথ ফর পলিসি ও প্রথম আলো আয়োজিত ‘কেমন বাংলাদেশ চাই: দেয়াল থেকে ইশতেহারে’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে।

নাজিফা জান্নাত

শিক্ষার্থী, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক।

জুলাই আন্দোলনের সময় আমাদের দেয়াললিখন ও গ্রাফিতি কার্যক্রম মূলত দুই পর্বে হয়েছে—৫ তারিখের আগে ও পরে। ৫ তারিখের পর দেয়ালের ভাষা বদলাতে শুরু করে। আগের দাবিগুলো পূরণ হওয়ার পর প্রশ্ন ওঠে—এখন কী? তখন দেয়ালে উঠে আসে রাষ্ট্র গঠন, বৈষম্য বিলোপ ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নিয়ে ভাবনা। আমি নিজেও এই লেখার প্রক্রিয়ার অংশ ছিলাম। তখন মনে হয়েছে, শুধু সমস্যা চিহ্নিত করলেই হবে না, আমাদের স্পষ্ট ভিশন দরকার—আমরা কোথায় পৌঁছাতে চাই। আমার কাছে সেই ভিশন হলো বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সুখী দেশ হিসেবে গড়ে তোলা। পরিসংখ্যান বলছে, সুখী দেশের সূচকে আমাদের অবস্থান দ্রুত পিছিয়েছে। অথচ আমরা উন্নয়ন নিয়ে কথা বলি, জিডিপি নিয়ে গর্ব করি, কিন্তু অর্থনীতির মৌলিক সংস্কার, সামাজিক সহায়তা, কমিউনিটি সংহতি ও মানুষের প্রতি সহানুভূতির মতো বিষয়গুলো রাজনৈতিক আলোচনায় গুরুত্ব পায় না। গড় হিসাবের আড়ালে বৈষম্য ঢেকে যায়।

দেয়ালের এই ইশতেহার আসলে জনগণের ইশতেহার-বটম টু আপ পদ্ধতিতে উঠে আসা আকাঙ্ক্ষা। সেখানে স্থিতিশীলতা, সহানুভূতি ও ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতির কথা আছে। ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’-এর মতো লেখায় আমি মানবিক ও স্বাস্থ্যকর রাজনীতির ইঙ্গিত দেখি।

আরিফুল ইসলাম আদীব 

সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)  

৫ আগস্ট–পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ বলতে আমি যে স্বপ্ন দেখি, তা মূলত গত ৫৪ বছরের ব্যবস্থার একটি মৌলিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থেকে জন্ম নেওয়া। এত বছর পরও নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সামাজিক অবস্থান, ধর্মীয় পরিচয়, পেশা, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে মানুষ প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।

শিক্ষাক্ষেত্রেই এই বৈষম্য সবচেয়ে স্পষ্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীর অধিকার লঙ্ঘিত হলে তা গুরুত্ব পায়, কিন্তু একই ঘটনা ঢাকা কলেজ, নারায়ণগঞ্জ বা পঞ্চগড়ের কোনো কলেজে ঘটলে সমাজ বা রাষ্ট্র তেমনভাবে সাড়া দেয় না। পেশাগত ক্ষেত্রেও একই চিত্র—রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে থাকা ব্যক্তিরা যে সেবা পান, একজন গার্মেন্টস শ্রমিক বা নিম্ন আয়ের মানুষ তা পান না। জুলাই–আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানের কেন্দ্রে ছিল জীবিকার নিরাপত্তা। জীবিকার প্রশ্ন সামনে আসতেই তরুণেরা রাজপথে নেমেছেন। এতে বোঝা যায়, বৈষম্য কত গভীরে প্রোথিত।

এই অভিজ্ঞতা থেকেই আমি মনে করি, নতুন বাংলাদেশের প্রথম শর্ত কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা। একজনের চাকরি মানে একটি পরিবারের নিরাপত্তা। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সেবায় নাগরিক পরিচয়ের বাইরে কোনো বৈষম্য চলতে পারে না; জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

শামা ওবায়েদ ইসলাম

সাংগঠনিক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, বিএনপি

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা নেমেছিল একটি ভালো সমাজ, গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের অধিকার, ফ্যাসিবাদের অবসান ও কার্যকর রাষ্ট্রব্যবস্থার দাবিতে। এই আকাঙ্ক্ষাই জুলাই আন্দোলনের দেয়ালজুড়ে গ্রাফিতিতে প্রকাশ পেয়েছে।

একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমি মনে করি, আমাদের সমাজে বৈষম্য এখনো রয়ে গেছে। হাসপাতালে চিকিৎসা পেতে তদবির করতে হয়—এমন বাস্তবতা দেখলে বোঝা যায়, বৈষম্য দূর করতে সময় লাগবে। এই বাস্তবতাকে সামনে রেখেই বিএনপি বহু আগে সংস্কারের কথা বলেছে। দমন–পীড়নের মধ্যেও আমরা বৈষম্য দূর, সবার জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার কথা ২৭ দফা, পরে ৩১ দফায় তুলে ধরেছি।

দেয়ালে যে ভাষা উঠে এসেছে—পাহাড় থেকে সমতল, শিক্ষা থেকে শ্রম, পেশাগত মর্যাদা থেকে সামাজিক ন্যায়ের দাবি—তারই প্রতিফলন আছে আমাদের ৩১ দফায়। আমি বিশ্বাস করি, বৈষম্য দূর করতে হলে যুব উন্নয়নকে কেন্দ্রে আনতে হবে। আমাদের তরুণ জনশক্তি ১৯৭১-এর মতোই আজও সবচেয়ে বড় শক্তি। দলিত, আদিবাসীসহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্র গঠনে অন্তর্ভুক্ত না করলে ন্যায্য বাংলাদেশ সম্ভব নয়। সে কারণেই আমরা ‘ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি’ বা রেইনবো নেশনের কথা বলি। নতুন প্রজন্ম বিভাজন নয়, বাস্তব সমাধান চায়—যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি, ঘুষহীন সেবা, স্বচ্ছ প্রশাসন চায়। 

জুনায়েদ সাকি

প্রধান সমন্বয়কারী, গণসংহতি আন্দোলন

পরিবর্তনের প্রশ্নে সবচেয়ে জরুরি হলো সচেতনতা—কোন বাস্তবতা থেকে আমরা কোথায় যেতে চাই। আজ ‘কেমন বাংলাদেশ চাই’ প্রশ্নে বৈষম্যহীনতার কথা জোরালোভাবে উঠে আসছে, যা ১৯৭১-এর সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়ের প্রতিশ্রুতিরই নতুন ভাষা।

জুলাই আন্দোলনের দেয়ালের গ্রাফিতি আমাদের এই সচেতনতার ঘাটতিই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। আন্দোলনের সময় নারীর প্রতি সাইবার বুলিং, ভিন্নমতকে দমন কিংবা পুলিশের সহিংসতাকে সমর্থনের ঘটনাগুলো দেখিয়ে দিয়েছে—আমরা অনেক সময় নিজের মধ্যেই নিপীড়নের সংস্কৃতি বহন করি। ফ্যাসিবাদ শুধু ক্ষমতাসীনদের মধ্যে নয়, বিরোধিতাকারীদের আচরণেও ঢুকে পড়ে। তাই কথার সঙ্গে কাজের মিল না হলে পরিবর্তন টেকসই হয় না।

আমি মনে করি, একটি সমাজ কতটা মানবিক—তার বড় সূচক হলো সবচেয়ে বঞ্চিত মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে কি না। দলিত, আদিবাসী বা বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, ভূমির অধিকার, ভাষা ও সংস্কৃতির সুরক্ষা অপরিহার্য। মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার না থাকলে সেই জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বই ঝুঁকিতে পড়ে।

একই সঙ্গে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থায় অভিন্ন মান, শিক্ষকের মর্যাদা এবং সবার জন্য সুযোগ তৈরি না হলে বৈষম্য থেকেই যাবে।

সাইফুল আলম খান

কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী

আমরা ইশতেহার তৈরির কাজ করছি, যদিও তা এখনো চূড়ান্ত নয়। সেখানে সবচেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা দুর্নীতি—রাস্তাঘাট থেকে বাজার, বাসস্ট্যান্ড থেকে সরকারি দপ্তর, সর্বত্রই তার ছাপ। তাই দুর্নীতিকে ‘লাল কার্ড’ দেখানো আমাদের প্রধান অঙ্গীকার।

ইশতেহারে নারীর বিষয়টি থাকবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। আমার নিজস্ব গবেষণা ও অভিজ্ঞতা থেকে জানি, নারীর শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা একটি বড় সংকট। নিরাপদ কর্মপরিবেশ, পর্যাপ্ত টয়লেট সুবিধা—এসব মৌলিক বিষয় আজও উপেক্ষিত। ধর্ষণের মতো অপরাধের ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির প্রশ্নও আমাদের আলোচনায় আছে।

এরপরে আমরা যেটি বলতে চাচ্ছি, বাংলাদেশে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য এই দুটি খাতে বাজেট বরাদ্দ কম। এটা বাড়াতে হবে। আমরা যদি ফ্যাসিলিটেট করতে চাই তাহলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেতের বাজেট বাড়াতে হবে ।

এ দেশের সবাই নাগরিক—হিন্দু, মুসলমান, পাহাড়ি বা সমতলের মানুষ আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। পাহাড়ি অঞ্চলের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগব্যবস্থা সমতলের মতো করাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

সাঈদ আহমদ

সিইও, আইআইডি

জুলাই আন্দোলন-পরবর্তী গ্রাফিতিতে ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ মানুষের স্বপ্নের বাংলাদেশ কেমন হবে, সেই আকাঙ্ক্ষাই সবচেয়ে বেশি জায়গা করে নেয়। আন্দোলনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘বৈষম্যবিরোধী’ সংগ্রাম’। তাই দেয়ালের গ্রাফিতিতেই তারা এঁকে দিয়েছিল সম-অধিকার আর বৈষম্যহীন এক নতুন বাংলাদেশের সনদ।

কিন্তু বাস্তবে বৈষম্য আরও তীব্র হয়েছে—হোক তা নারীর প্রতি আক্রমণ, ধর্মীয় বিভেদ, প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা কিংবা সংস্কৃতির ওপর হামলা। ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় রাষ্ট্রক্ষমতার সমঝোতার কথা বেশি উঠে এলেও, বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশের স্বপ্নের কথা সেখানে তুলনামূলকভাবে কম।

অথচ সারা দেশ থেকে আমরা যে গ্রাফিতির ছবি সংগ্রহ করেছি, সেগুলোতে অর্থনৈতিক, লিঙ্গ, ধর্মীয়, জাতিগত, শিক্ষা ও পেশাগতসহ সব ধরনের বৈষম্য দূর করার দাবিগুলো স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। আজ আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসেছি সেই জুলাই গ্রাফিতিতে আঁকা ‘দেয়ালের জুলাই সনদ’ নিয়ে। দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে বৈষম্যহীন, ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার সুস্পষ্ট অঙ্গীকার অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে।

জুলাই আন্দোলনের ‘বৈষম্যবিরোধী’ চেতনা যাতে হারিয়ে না যায়, তাই দেয়ালে ফুটে ওঠা এই আকাঙ্ক্ষাগুলো ইশতেহারে জায়গা করে নেবে, এটাই আমাদের মূল প্রত্যাশা।

এস এম শামীম রেজা

অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইশতেহারের পরিবেশ তৈরি হয়নি। বড় রাজনৈতিক দলগুলো এখনো কর্মপরিকল্পনা বা নীতিমালা মেলাতে পারেনি। বিএনপি বা অন্যান্য দলের পুরোনো টেমপ্লেট আছে, কিন্তু নতুন তরুণ দলগুলোর লেখা ইশতেহার বা কর্মসূচি নেই বা খুব সীমিত। তাই তরুণদের অংশগ্রহণ, তাদের সংস্কৃতি, মতপ্রকাশ ও ডিজিটাল বা সাইবার নীতি ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করা অপরিহার্য।

ইশতেহারে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়গুলো হলো মুক্ত গণমাধ্যম, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ডিজিটাল ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসংক্রান্ত নীতি, সংস্কৃতির অধিকার, মানবাধিকার, ধর্মীয় ও জাতিগত বৈচিত্র্য, নারী-পুরুষ সম–অধিকার। তরুণেরা শুধু অর্থনৈতিক সম্পদ নয়, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক সম্পদ হিসেবেও মূল্যায়িত হোক।

জুলাই গ্রাফিতির বার্তা অনুযায়ী, তরুণদের আকাঙ্ক্ষা, সমাজের ন্যায়বিচার, বৈষম্যবিরোধী সংস্কৃতি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি ইশতেহারে প্রতিফলিত হতে হবে। শিক্ষার ন্যায্যতা, কর্মসংস্থান ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে ইশতেহার শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তবায়নযোগ্য নীতি হিসেবে তৈরি হওয়া প্রয়োজন। শুধু ক্ষমতা বা অর্থের ভিত্তিতে নয়, সংস্কৃতি, মতপ্রকাশ ও মানুষের নৈতিক শক্তি অনুযায়ী যেন তরুণেরাও স্থান পায়। জুলাই আন্দোলনে দেশের সব স্তরের জনগণ একসঙ্গে নিজেদের দাবি উত্থাপন করেছিল। সেই স্পিরিটকে এখন নীতিতে রূপান্তরিত করতে হবে।

নাসরিন সুলতানা

যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, এবি পার্টি

আমরা বারবার বলেছি, দেয়ালে দেয়ালে তরুণদের যে আশা ও আকাঙ্ক্ষাগুলো প্রতিফলিত হয়েছে, সেগুলোই হবে আগামীর বাংলাদেশের নবযাত্রার বেজলাইন। এই বেজলাইনটাই আমাদেরকে ধরতে হবে। যারা ধরতে পারবে না, তারা কিন্তু ইতিহাসে কালো গহ্বরে হারিয়ে যাবে।

শিক্ষার প্রসঙ্গ থেকে শুরু করে সামাজিক নিরাপত্তা, নারী-পুরুষ সম–অধিকার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি নিশ্চিত করতে হবে। নাগরিককে দক্ষ এবং স্বনির্ভর করে তোলার উপযোগী কারিগরি ও ট্রানজিশন স্কিল শেখানোর ওপর জোর দিতে হবে।

নারীর নিরাপত্তা ও ওয়ার্ক সেফটি নিশ্চিত হলে তাঁরা রাজনীতি, কর্মক্ষেত্র এবং সমাজের সব ক্ষেত্রে সমভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবে। নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখলে অপরাধ প্রতিরোধ হবে এবং সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।

জুলাই গ্রাফিতির স্পিরিট অনুযায়ী, তরুণদের আশা—শিক্ষা, কর্মসংস্থান, নিরাপত্তা, মানবাধিকার, নারীর অংশগ্রহণ, সাংস্কৃতিক ও জাতিগত স্বীকৃতি—ইশতেহারে প্রতিফলিত হতে হবে।

ইশতেহার কেবল প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তবায়নযোগ্য নীতি হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। রাজনৈতিক দল ও তরুণ দলগুলো যেন এই নীতিকে অন্তর্ভুক্ত করে, নির্বাচনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করে।

আবু হানিফ

উচ্চতর পরিষদের সদস্য, গণ অধিকার পরিষদ–জিওপি

কেমন বাংলাদেশ চাই—সেই প্রশ্নের উত্তর জুলাই আন্দোলনের গ্রাফিতিতেই স্পষ্ট ছিল; এখন সেই দেয়ালের ভাষাই ইশতেহারে আনার সময়। প্রশ্ন হলো, এই গ্রাফিতি কি শুধু দেয়ালেই থাকবে, নাকি রাজনৈতিক দলগুলো তা ধারণ করবে?

আমাদের রাজনৈতিক দল ২০১৮–পরবর্তী সময়ের অভিজ্ঞতা থেকেই গড়ে উঠেছে। পুরোনো দলগুলো জনগণের ন্যায্য চাহিদা পূরণে ব্যর্থ বলেই নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান। এখানে আমি ‘সমান অধিকার’-এর চেয়ে ‘ন্যায্য অধিকার’কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। সবাইকে এক রকম দেওয়া সম্ভব নয়; যার যতটুকু প্রাপ্য, তাকে ততটুকুই দিতে হবে—এই ন্যায্যতাই রাষ্ট্রের ভিত্তি হওয়া উচিত।

তরুণদের দল হিসেবে আমরা কর্মসংস্থানকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিই। একই সঙ্গে বাস্তবমুখী ও প্র্যাকটিক্যাল শিক্ষার মাধ্যমে তরুণদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার কথা ভাবি। ধর্ম বা জাতিগত পরিচয়ের চেয়ে আমাদের কাছে নাগরিক পরিচয়ই মুখ্য। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সবার অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করাই লক্ষ্য। নারীদের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় বাস্তবতা হলো সাইবার বুলিং। রাজনীতিতে যুক্ত হতে গিয়ে নারীরা সবচেয়ে বেশি এর শিকার হন। আমরা চাই, নারীদের সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিক। দেয়ালে লেখা জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষাগুলো—ন্যায্যতা, মর্যাদা ও নিরাপত্তা—ইশতেহারে প্রতিফলিত হলেই কেবল আমরা কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশের পথে এগোতে পারব।

মুক্তা বাড়ৈ

সভাপতি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট

সাম্য ও মর্যাদার ভিত্তিতে বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার কাজ এখনো অসম্পূর্ণ। বৈষম্যের মূল কারণ নির্ণয় করে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নীতিগত ব্যবস্থার সংস্কার অপরিহার্য। শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের সর্বজনীন, বৈষম্যহীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, সেকুলার ও গণতান্ত্রিক হওয়া প্রয়োজন। প্রাইমারি থেকে স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার ব্যবস্থা রাষ্ট্রের দায়িত্বে নিয়ে প্রতিটি এলাকায় স্কুল, মিড-ডে মিল, খেলাধুলার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভঙ্গুর অবস্থা মোকাবিলায় জনস্বাস্থ্যকে রাষ্ট্রের অঙ্গীকারে আনা জরুরি।

নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন ও সমান অধিকার বাস্তবায়ন, সম্পত্তি ও মাতৃত্বকালীন সুবিধা–সমতা, ডে–কেয়ার সেন্টারের ব্যবস্থা, সাইবার নিরাপত্তা—এটি নীতিগতভাবে নিশ্চিত করতে হবে। সংবিধানে থাকা অধিকার বাস্তবায়নের পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক, ন্যায়সংগত আইন ও অগণতান্ত্রিক বিধি বাতিল করা প্রয়োজন। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি, মাতৃভাষায় শিক্ষা, ভূমি কমিশন ও ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা দরকার। শ্রমজীবী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, শ্রম শোষণ বিলুপ্ত করা এবং বৈষম্যহীন বাংলাদেশ নিশ্চিত করা—এটাই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য।

দেয়ালে লেখা গ্রাফিতি শুধু চেতনা নয়, এটি রাজনৈতিক ইশতেহারে পরিণত হলে সমান অধিকার, ন্যায়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর নিরাপত্তা ও নাগরিক মর্যাদা নিশ্চিত করে, বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক ও মর্যাদাশীল বাংলাদেশ গড়ার পথ সুপ্রতিষ্ঠিত হবে।

সানজিদা রহমান

প্রধান, ইয়ুথ ফর পলিসি এবং সিনিয়র যুগ্ম পরিচালক, আইআইডি

ইয়ুথ ফর পলিসি আইআইডির একটি যুব নেটওয়ার্ক। ‘তারুণ্যের ইশতেহার’ আমাদের ফ্ল্যাগশিপ কর্মসূচি, যা ২০১৩ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে চলছে এবং ২০২৫ সালে ১২ বছর পূর্তি উদ্‌যাপন করছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে তরুণদের কণ্ঠস্বর রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে পৌঁছানোই ‘তারুণ্যের ইশতেহার ২০২৫’-এর মূল উদ্দেশ্য। এবারের প্রক্রিয়া ভিন্ন, আমরা একে বলছি ‘দেয়াল থেকে ইশতেহারে’।

জুলাই আন্দোলনের পর বিভিন্ন জেলার স্বেচ্ছাসেবকেরা এক হাজারের বেশি গ্রাফিতি সংগ্রহ করেছেন। ২৪টি জেলা থেকে ৩২ জন তরুণ-তরুণীকে ঢাকায় এনে বাছাই করা ১০০টি গ্রাফিতি উপস্থাপন করা হয়েছে, এরপর তাঁরা গ্রাফিতিতে কোন কোন বৈষম্যের কথা উঠে এসেছে, তা চিহ্নিত করেছেন এবং সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছেন। তাঁদের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে পাহাড়-সমতল, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বৈষম্য, পাশাপাশি নারীর নিরাপত্তা, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবা, এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার। এসব বিষয় আগামী সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন।

তামান্না সিং বড়াইক

চা–জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি; প্রকল্প কর্মকর্তা, দলিত নারী ফোরাম

বাংলাদেশের ইতিহাসে বহু গণ–অভ্যুত্থান ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেখা গেছে, যে জনগোষ্ঠীগুলো সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার, তাদের কথা প্রায়ই সমাজে উপেক্ষিত থাকে। ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশেও দলিত, পাহাড়ি ও চা-শ্রমিক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, জেলে সম্প্রদায়ের মতো জনগোষ্ঠী প্রজন্মের পর প্রজন্ম বৈষম্যের মুখোমুখি হয়েছে। এই জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ও প্রয়োজনে স্পষ্ট পরিসংখ্যান নেই, ফলে তাদের সঠিক স্বীকৃতি ও নীতি গঠন করা কঠিন। জুলাই আন্দোলনের দেয়াল থেকে দেখা যায়, তরুণদের আকাঙ্ক্ষা ও চেতনা প্রকাশ পেয়েছে। এখন সেই আকাঙ্ক্ষা ইশতেহারে রূপান্তরিত করতে হবে। তরুণদের জন্য দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ, বিকল্প পেশা, বিনোদন ও জ্ঞানচর্চার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তাঁরা দেশের উন্নয়নে নেতৃত্ব দিতে পারেন। মেয়েদের নিরাপত্তা, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ও সমান সুযোগ নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

সংসদে প্রতিনিধি থাকা জরুরি। চাকরি, শিক্ষা ও সামাজিক সুযোগে ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে এই কোটাব্যবস্থার মাধ্যমে তাঁদের অন্তর্ভুক্তি সম্ভব।

দেয়ালে লেখা গ্রাফিতি শুধু চেতনা নয়, এটি একটি নীতিমূলক নির্দেশ, যা ইশতেহারে রূপান্তরিত হলে বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক ও মর্যাদাশীল বাংলাদেশ গড়তে সাহায্য করবে।

আফিয়া জামান

ভলেন্টিয়ার, ইয়ুথ ফর পলিসি

২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের সময় গ্রাফিতি শুধু চিত্রকর্ম নয়, বরং মানুষের গল্প, ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে উত্থিত হয়। যেখানে মানুষ সরাসরি কথা বলার সুযোগ পান না, সেখানে গ্রাফিতি সেই চুপ থাকা কণ্ঠকে প্রকাশ করে। অনলাইনে এই আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ইংরেজি ও বাংলা—উভয় ভাষায় স্প্রে পেইন্টিংয়ের মাধ্যমে প্রতিবাদকে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার নজরে আনা হয়।

জুলাই আন্দোলনের সময় গ্রাফিতিগুলো মূলত মিডিয়া কাভারেজ এবং প্রতিবাদের জন্য করা হয়। এরপরের সময়ে গ্রাফিতি স্বাধীনতার সেলিব্রেশন ও নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নকে প্রকাশের মাধ্যম হয়ে ওঠে। এগুলোতে ফুটে উঠেছে বৈষম্যহীন, সমানাধিকারী ও সম্মানজনক দেশের আকাঙ্ক্ষা। প্রতিটি মানুষ যেন তাঁর চাহিদা পূরণ করতে পারেন, সামাজিক নিরাপত্তা পান এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারেন—এটাই গ্রাফিতির মূল বার্তা।

গ্রাফিতি কেবল অতীতের স্মৃতির প্রতিফলন নয়, এটি তরুণদের অনুপ্রেরণা, তাঁদের দেশের জন্য কিছু করার সংকল্প। রাস্তায় এখনো যে গ্রাফিতি দেখা যায়, তা স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের আশা, স্বপ্ন ও দায়িত্ব এখনো জীবন্ত।

রুমা রায় মনা

ভলান্টিয়ার, ইয়ুথ ফর পলিসি, দিনাজপুর

২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের সময় বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে দিনাজপুরে সংখ্যালঘু ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর শোনা গুজব ও সমস্যা মোকাবিলায় তরুণেরা গ্রাফিতির মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করেন। গ্রাফিতি ছিল সরাসরি মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছে দেওয়ার ও মানুষকে জাগিয়ে তোলার বড় একটি মাধ্যম।

অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া হলেও অনেক বয়স্ক বা প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত নন, এমন মানুষ তা দেখার সুযোগ পান না, তাই দেয়ালকে সরাসরি বার্তা পৌঁছে দেওয়ার একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই চিত্র ও বার্তাগুলো তরুণদের আকাঙ্ক্ষা, দেশের জন্য তাঁদের দায়িত্ববোধ ও সমতার প্রতি প্রতিশ্রুতিকে প্রকাশ করে।

গ্রাফিতি থেকে ইশতেহারে যাওয়ার বার্তা স্পষ্ট—একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে হবে। প্রতিটি সম্প্রদায় ও প্রত্যেক নাগরিক সমান মর্যাদা ও সুযোগ পাবে। সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও নারী–পুরুষ সবার জন্য নিরাপত্তা, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

গ্রাফিতি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে দেশের নতুন রূপ গড়ার জন্য তরুণদের চেতনা, ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতার মূলনীতিকে ইশতেহারে প্রতিফলিত করতে হবে।

মো. হামিম ইসলাম

ভলান্টিয়ার, ইয়ুথ ফর পলিসি, খুলনা

জুলাই আন্দোলনের মূল থিম ছিল কর্মসংস্থান ও বৈষম্য হ্রাস। তবে শুধু চাকরির সুযোগ তৈরি করলেই সমাধান হবে না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা। কোয়ালিটি এডুকেশন নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষকদের মানসম্মত হতে হবে। এতে শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করবে। শিক্ষানীতি ও শিক্ষা আইন বাস্তবায়ন এখনো অসম্পূর্ণ, যা দেশের যুবসমাজকে প্রভাবিত করছে।

শিক্ষাব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রভাব কমাতে হবে এবং প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বাজেটে শিক্ষার জন্য যথাযথ বরাদ্দ জিডিপির ৫ শতাংশ নিশ্চিত করতে হবে, যা বর্তমানে প্রায় ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ মাত্র। ইনক্লুসিভ শিক্ষা ছাড়া একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়। এর মানে পার্বত্য চট্টগ্রাম, উপকূলীয় অঞ্চল, সিলেটের চা–বাগান, পঞ্চগড়সহ সব প্রান্তিক এলাকায় শিক্ষা পৌঁছানো।

ইনক্লুসিভ শিক্ষা নিশ্চিত করলে বৈষম্যহীন সমাজ, কর্মসংস্থান ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা সম্ভব। জুলাই আন্দোলনের গ্রাফিতি সেই চেতনা ফুটিয়ে তোলে—একটি দেশ, যেখানে প্রত্যেক মানুষ সমান মর্যাদা, সুযোগ ও সুরক্ষা পাবে।

প্রবীণ ত্রিপুরা

কো-অর্ডিনেটর, ইয়ুথ ফর পলিসি

জুলাই আন্দোলনের দেয়াললিখন ও গ্রাফিতিতে যেমন আমরা কেমন বাংলাদেশ চাই—সেই প্রশ্ন উঠেছিল, তেমনি সেই চেতনা এখন ইশতেহারে স্পষ্টভাবে আসা জরুরি। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রশ্নটি এই চাওয়ার কেন্দ্রেই রয়েছে। পাহাড়ে ও সমতলে প্রায় সব সংঘাতের মূলে রয়েছে ভূমি। তাই আদিবাসীদের ভূমি অধিকার নিশ্চিত করা এবং তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা জরুরি।  শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অধিকার থেকেও তারা দীর্ঘদিন বঞ্চিত। অনেক এলাকায় এখনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই, নেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এই বাস্তবতায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত না করলে সমতাভিত্তিক বাংলাদেশের কথা বলা যায় না। এই বাস্তবতা বদলাতে হলে ইশতেহারে স্পষ্টভাবে আদিবাসীসহ সব জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও বিচার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার থাকতে হবে। একই সঙ্গে আদিবাসীদের সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখা যায়, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কথা বললেও ক্ষমতায় যাওয়ার পর সেই অবস্থান ধরে রাখে না। এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে না এলে ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ গঠন করা সম্ভব হবে না। আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায়ও রাজনৈতিক দলগুলোকে গুরুত্বারোপ করতে হবে।

সুপারিশ

  • ইশতেহারে বৈষম্যহীন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায্য বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করতে হবে

  • শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় মানসম্মত, সমানাধিকার ও আঞ্চলিকভাবে সমান সুযোগ প্রদান নিশ্চিত করা জরুরি

  • নারীদের চলাফেরায় নিরাপত্তা, নিরাপদ যানবাহন ও সাইবার নিরাপত্তাসংক্রান্ত নীতি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে

  • সমান কর্মসংস্থান, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, ডে-কেয়ার সুবিধা এবং মাতৃত্বকালীন ছুটিসংক্রান্ত নীতিমালা কার্যকরভাবে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন

  • দুর্নীতি, নৈতিক ও প্রশাসনিক অসংগতি দূর করে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং মানবিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে

  • তরুণদের অংশগ্রহণ, দক্ষতা উন্নয়ন ও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি জাতীয় নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করে আগামী বাংলাদেশের রূপায়ণ করতে হবে

  • মুক্ত গণমাধ্যম, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা (অনলাইন-অফলাইন), আইন ও নীতিমালার অপব্যবহার রোধ—এ বিষয়ে কার্যকর ডিজিটাল পলিসি তৈরি করা জরুরি।

  • সাংস্কৃতিক চর্চার অধিকার নিশ্চিত করা এবং তরুণদের সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও মানবিক সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।

গোলটেবিল বৈঠকে আরও অংশ নেন সাদিয়া জামান, রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, আইআইডি; সৈয়দা নিগার সুলতানা, রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট, আইআইডি; ইমন কাজি, সহকারী পরিচালক (প্রোগ্রাম), আইআইডি; মো. রাকিবুল হাসান নিরব, এক্সিকিউটিভ, আইআইডি; মোহতিনা খানম, সহকারী পরিচালক (কমিউনিকেশনস), আইআইডি; রমজান আহমেদ, সিনিয়র সহকারী পরিচালক, আইআইডি। সঞ্চালক: ফিরোজ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো।