
‘কপ৩০ : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে বেলা ও প্রথম আলো।
জলবায়ু সম্মেলন ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য কাঙ্ক্ষিত ফল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। এসব সম্মেলনে উন্নত বিশ্ব প্রতিশ্রুতি না রাখায় উন্নয়নশীল বিশ্বের সঙ্গে আস্থার ঘাটতি বেড়েছে। বাস্তবতা হলো, হতাশ না হয়ে কপ (কনফারেন্স অব পার্টিজ) প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে। কারণ, এসব সম্মেলনে ছোট ছোট যে অর্জন হচ্ছে, সেটি ভবিষ্যতে বড় বিজয়ের পথ তৈরি করবে।
গতকাল শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে আয়োজিত ‘কপ৩০: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথা বলেন বক্তারা। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও প্রথম আলো এ গোলটেবিলের আয়োজন করে।
আপনি বলবেন আর সব হয়ে যাবে, কপে এ রকম কিছু হয় না। ধারাবাহিক দর–কষাকষির মধ্য দিয়ে সফলতা আসবে।এ কে এম সোহেল, অতিরিক্ত সচিব, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়
নভেম্বরের শেষ দিকে ব্রাজিলের বেলেম শহরে অনুষ্ঠিত কপ৩০–এর সাফল্য ও ব্যর্থতা তুলে ধরতে এ গোলটেবিলের আয়োজন করা হয়। জলবায়ু সম্মেলনে সরকারি, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা থেকে অংশগ্রহণকারীরা তাঁদের মতামত তুলে ধরেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ কে এম সোহেল বলেন, কপে চাহিদার তুলনায় তহবিলে অর্থায়ন অনেক কম। ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজের’ যে তহবিল, একটি দেশের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবিলায় তার চেয়ে বেশি টাকা লাগে।
এ কে এম সোহেল বলেন, তারা তহবিল দেওয়া শুরু করেছে, তা–ও ৩০ বছর দেনদরবারের পর। এ জন্য হতাশ হওয়ার কারণ নেই। আপনি বলবেন আর সব হয়ে যাবে, কপে এ রকম কিছু হয় না। ধারাবাহিক দর–কষাকষির মধ্য দিয়ে সফলতা আসবে।
এখন থেকে প্রস্তুতি নেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে এ কে এম সোহেল বলেন, ‘একটি তহবিল থেকে (গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড) টাকা বের করতে আমাদের ৯ বছর লেগেছে। সেই ফান্ড সর্বশেষ সভায় ১ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে, যা অবিশ্বাস্য। এসব প্রকল্প পেতে আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের জলবায়ু পরিবর্তন ও আন্তর্জাতিক কনভেনশন শাখার পরিচালক মির্জা শওকত আলী বলেন, ‘এ সম্মেলনে প্রধান কোনো সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা ছিল না। এবারের কপে স্বাভাবিক যে কার্যসূচি থাকে, সেটাই ছিল। প্রথম থেকে আমাদের খুব বেশি প্রত্যাশা ছিল না।’
মির্জা শওকত আলী বলেন, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে দর–কষাকষির ধারাবাহিকতা খেয়াল করলে দেখবেন কপে একেবারে কোনো কিছু অর্জন করা যায় না। এখানে দুটি পক্ষকেই (উন্নত বিশ্ব ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশ) একটা সমঝোতার জায়গায় আসতে হয়।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ‘জীবাশ্ম জ্বালানির প্রসার রোধ চুক্তি’র বৈশ্বিক সম্পৃক্তকরণবিষয়ক পরিচালক হারজিৎ সিং বলেন, কপের ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে উন্নয়নশীল বিশ্বের আস্থার ঘাটতি কমেনি; বরং আরও বেড়েছে।
হারজিৎ সিং বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলো এই মুহূর্তে গড়ে বছরে অন্তত ৪০০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতির মুখে পড়ছে। এই ক্ষতি ৭০০ বিলিয়ন ছাড়িয়ে এক ট্রিলিয়ন ডলারেও পৌঁছাতে পারে। এবারের সম্মেলনে অভিযোজন বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে। অথচ অভিযোজনের জন্য স্পষ্টভাবে কোনো অর্থায়নে নির্দিষ্ট কোনো অঙ্ক উল্লেখ করা হয়নি। ফলে এটা নিয়েও একটা অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি সরদার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, কপ আলোচনা, বিতর্ক, দর–কষাকষির জায়গা। এখানে বিভিন্ন ধরনের আঙ্গিক, পরিপ্রেক্ষিত, অবস্থান নিয়ে দেশগুলো অংশ নেয়। তার মধ্য দিয়ে সবাই চেষ্টা করে যার যার অবস্থানটা প্রতিষ্ঠিত করতে।
কপকে একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া উল্লেখ করে আসাদুজ্জামান বলেন, এখানে কিছু অর্জন করতে হলে সময় লাগে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত তো আর থেমে থাকবে না। ফেনীতে একটা নজিরবিহীন বন্যা হলো গত বছর। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আগের অভিজ্ঞতায় বন্যার এমন প্রকোপ দেখা যায়নি।
বেলার প্রধান নির্বাহী তাসলিমা ইসলাম প্রস্তুতির ওপর জোর দিয়ে বলেন, ‘প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির যে হিসাব, সেটার পাশাপাশি এখন থেকে আমাদের প্রস্তুতির ওপরও খেয়াল রাখতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত এত তীব্র হয়েছে যে বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষকেরা কৃষি ছেড়ে এখন ব্যাটারিচালিত রিকশা চালাচ্ছে।’
এশিয়ান পিপলস মুভমেন্ট অন ডেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সমন্বয়ক লিডি ন্যাকপিল বলেন, এসব জলবায়ু সম্মেলন থেকে এখনো কোনো কার্যকর পদক্ষেপ আসেনি। ভবিষ্যতে যে আসবে, সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ। সফলতা ও ব্যর্থতার মানদণ্ডে মাপলে এ সম্মেলনও কার্যকর কোনো কিছু দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
এরপরও এসব প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকার ওপর গুরুত্ব দিয়ে লিডি বলেন, ‘এসব সম্মেলনে এমন সব নীতি নিয়ে আলোচনা হয়, যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর প্রতিনিধি উপস্থিত না থাকলে এসব নীতি বাস্তবায়ন হয়ে যাবে। সেসব নীতি ভয়ানক প্রভাব ফেলবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে। আমাদের অংশগ্রহণ সেই ক্ষতি ঠেকানোর প্রয়াস। এখানে ছোট ছোট অর্জন আছে, যা ভবিষ্যতে বড় বিজয়ের পথ তৈরি করবে।’
গোলটেবিলে কপ৩০ নিয়ে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন বেলার পলিসি অ্যান্ড ক্যাম্পেইন কো–অর্ডিনেটর বারিশ হাসান চৌধুরী।
ফ্রেন্ডস অব দ্য আর্থের (ইংল্যান্ড, ওয়েলস, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড) প্রধান নির্বাহী আসাদ রহমান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের অনেক অঞ্চলে তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা অতিক্রম করা প্রায় নিশ্চিত, তাই এখন প্রতিরোধ ও অভিযোজন ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। পাশাপাশি এই শতাব্দীর শেষে ২–৩ ডিগ্রি উষ্ণতার দিকে আমরা এগোচ্ছি, তাই ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির লক্ষ্য ধরে রাখার সঙ্গে সঙ্গে জনগণকে রক্ষা করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।’
ইয়ুথনেট গ্লোবালের নির্বাহী সমন্বয়ক সোহানুর রহমান বলেন, ‘আমরা মনে করি, কপে গেলে টাকাপয়সা পাওয়া যাবে। না পেলে হতাশ হয়ে যাই। কপ একটা বহুপক্ষীয় প্রক্রিয়া। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরেও একটি কপ হয়েছে এবং সেখানে কিছু অর্জনও এসেছে, এটাই এই কপের একটা বড় বিজয়।’
দুর্যোগের মডেলিংয়ে সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের প্রভাষক আবুল কাশেম ফারুকী ফাহিম বলেন, ‘দুর্যোগ কতটুকু বাড়ছে, কোন এলাকায় বাড়ছে, সেটার মডেলিং করতে হবে আমাদের।’
অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সহযোগী ব্যবস্থাপক শেখ নূর আতায়ে রাব্বি, জলবায়ুর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত জনপদ সাতক্ষীরার শ্যামনগরের বাসিন্দা মো. হাফিজুর রহমান ও রাজশাহী অঞ্চলের আফজাল হোসেইন। গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।