বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস উপলক্ষে আয়োজতি ‘পরিবার থেকেই শুরু হোক হেপাটাইটিস প্রতিরোধ: টেস্ট করুন, টিকা নিন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ২১ জুলাই ২০২৫ ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে
বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস উপলক্ষে আয়োজতি ‘পরিবার থেকেই শুরু হোক হেপাটাইটিস প্রতিরোধ: টেস্ট করুন, টিকা নিন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ২১ জুলাই ২০২৫ ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে

বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস

পরিবার থেকেই শুরু হোক হেপাটাইটিস প্রতিরোধ: টেস্ট করুন, টিকা নিন

আলোচনা

অধ্যাপক মো. শাহিনুল আলম

অধ্যাপক মো. শাহিনুল আলম

উপাচার্য, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

সভাপতি, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ

হেপাটাইটিস নিয়ে সমাজে নানা কুসংস্কার এখনো বিরাজমান। ফলে তৈরি হচ্ছে বৈষম্য। এ বৈষম্য শুরু হচ্ছে ব্যক্তিপর্যায় থেকে এবং তা বিস্তৃত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। এখনো অনেক দেশ হেপাটাইটিস ভাইরাস বহনকারীদের চাকরির অযোগ্য ঘোষণা করে থাকে, যা বৈজ্ঞানিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। ইতিমধ্যে চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ এ ধরনের বিধান বাতিল করেছে। অথচ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে এখনো বৈষম্যমূলক এ বিধিনিষেধ বলবৎ রয়েছে। আমাদের কূটনৈতিকভাবে সেখানে কার্যকর তৎপরতা চালাতে হবে, যাতে এসব বিধি তুলে নেওয়া হয়।

হেপাটাইটিস বি সম্পর্কে সচেতনতা ঘাটতির কারণে বাংলাদেশেও রোগীর ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ বিষয়ে হেপাটোলজি সোসাইটি একটি গবেষণা করেছে, যেখানে ১ হাজার ৩৯ জন অংশগ্রহণকারী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ৭৯ দশমিক ৭ শতাংশ (৮২৮ জন) পুরুষ ও ২০ দশমিক ৩ শতাংশ (২১১ জন) নারী। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ চাকরিতে, ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ সামাজিক ক্ষেত্রে, ৮ দশমিক ৭ শতাংশ চিকিৎসাসেবায়, ৭ দশমিক ৩ শতাংশ পারিবারিক ক্ষেত্রে ও ৪ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া ৪৫ দশমিক ৭ শতাংশ চাকরি ক্ষেত্রে, ৭৬ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও ৭ দশমিক ১ শতাংশ পরিবারে তাঁদের রোগ-সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করেননি।

হেপাটাইটিস বি ভাইরাসকে ঘিরে সমাজে প্রচলিত নানা ভুল ধারণার ফলে অনেকেই চিকিৎসা গ্রহণে বাধার সম্মুখীন হন। শুধু তা–ই নয়, কখনো কখনো সরকারি ও বেসরকারি নীতিতেও এসব কুসংস্কারের প্রতিফলন দেখা যায়। ২০১৭ সালে ওয়ার্ল্ড হেপাটাইটিস অ্যালায়েন্স পরিচালিত একটি জরিপে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সিভিল সোসাইটির ৯৩ শতাংশ জানিয়েছেন, হেপাটাইটিস বি–তে আক্রান্ত ব্যক্তিরা তাঁদের দেশে বৈষম্যের শিকার হন।

দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা চিকিৎসকেরাও অনেক সময় হেপাটাইটিসে আক্রান্ত রোগীদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করি। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত সবাইকে হেপাটাইটিস বিষয়ে সঠিক জ্ঞান দিতে হবে এবং কুসংস্কার দূর করার জন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে। চিকিৎসা পরিষেবার অংশ হিসেবেই হেপাটাইটিস বি পরীক্ষা নিশ্চিত করা উচিত। তবে তা অবশ্যই রোগীর সম্মতি ও শুধু চিকিৎসার প্রয়োজনে, চাকরি বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির শর্ত হিসেবে নয়।

হেপাটোলজি সোসাইটি ২০ বছর ধরে এ কুসংস্কার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা রেখে চলেছে। আমরা অন্তত ২০০ হেপাটাইটিস বি–তে আক্রান্ত যুবককে চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে সহায়তা করেছি। বিভিন্ন ইনভেসিভ চিকিৎসাপদ্ধতি, যেমন করোনারি অ্যানজিওগ্রাম, ভাসকুলার সার্জারি কিংবা কোলেসিসটেকটমি। এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের আশ্বস্ত করেছি, যাতে রোগীরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হন।

সামাজিক কুসংস্কার দূর করা এবং বৈষম্য রোধে আমাদের জনস্বাস্থ্য নীতিতেও পরিবর্তন আনতে হবে। এ কাজ একা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। চিকিৎসক, সাংবাদিক, আইনপ্রণেতা, সুশীল সমাজ সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে। তাহলেই হেপাটাইটিস বি–তে আক্রান্ত মানুষদের প্রতি সমাজে সমতা ও সহানুভূতির পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

ডা. মো. গোলাম আযম

ডা. মো. গোলাম আযম

বিভাগীয় প্রধান, লিভার ও গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগ, বারডেম

সাধারণ সম্পাদক, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা বাংলাদেশ।

হেপাটাইটিস বা লিভার প্রদাহ মূলত ভাইরাস দিয়ে সংক্রমিত হয়। ফ্যাটি লিভারের একটি অংশ অর্থাৎ নন–অ্যালকোহলিক স্টিয়াটো হেপাটাইটিস, মদ্যপানজনিত, ড্রাগ–উদ্ভূত বা অটোইমিউনের কারণে হেপাটাইটিস হতে পারে। হেপাটাইটিস এ এবং হেপাটাইটিস ই ভাইরাস দুটি মূলত খাদ্য ও পানিবাহিত। এগুলো স্বল্পমেয়াদি হেপাটাইটিস সংক্রমণ। বিশুদ্ধ খাদ্য ও পানীয় গ্রহণের মাধ্যমে দুটি ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু হেপাটাইটিস বি ও হেপাটাইটিস সি লিভার সিরোসিস, লিভার ক্যানসার এবং লিভার ফেইলিউরের অন্যতম কারণ।

সারা বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১৫ লাখ মানুষ এভাবে মারা যায়, যা এইডসের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। এ দুটি ভাইরাস জনসচেতনতা বাড়ানোর ও টিকা প্রদানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ বিষয়গুলো সফল করার লক্ষ্যে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস পালন করা হয়।

বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস কীভাবে এল? চার্লস গোর নামের একজন ব্রিটিশ নাগরিক, যিনি ১৯৯৫ সালে হেপাটাইটিস সি রোগে আক্রান্ত হন, পরে মাত্র তিন বছরের মধ্যে তাঁর লিভার সিরোসিস শুরু হয়। ওই সময়ে হেপাটাইটিস সি–এর সঠিক চিকিৎসা নিয়ে কোনো সর্বসম্মত গাইডলাইন ছিল না। যা ছিল তা–ও অনেক ব্যয়বহুল। কোনো গাইডলাইন না থাকায় স্বাস্থ্যবিমা তখনো এই রোগের কভারেজ দিত না। ২০০০ সালে এ ধরনের আরও তিনজন রোগীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ‘হেপাটাইটিস সি ট্রাস্ট’ গঠন করেন। তারপর ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের রোগীদের নিয়ে ২০০৪ সালের ১ অক্টোবর প্রথম আন্তর্জাতিক হেপাটাইটিস সি সচেতনতা দিবস পালন শুরু করেন। ইতিমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রোগী গ্রুপগুলো বিচ্ছিন্নভাবে হেপাটাইটিস দিবস পালন করে আসছিল। এ জন্য ২০০৮ সালে রোগীদের সব কটি গ্রুপ মিলে ‘ওয়ার্ল্ড হেপাটাইটিস অ্যালায়েন্স’ গঠন করে এবং ১৯ মে দিনটিকে প্রথম বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস হিসেবে পালন শুরু হয়।

বিশ্বব্যাপী রোগী কল্যাণ সমিতি ও জনমতের ব্যাপক প্রচার–প্রচারণার কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১০ সালের ৬৩তম ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলিতে একটি নীতি গ্রহণ করা হয়, যেখানে হেপাটাইটিস সির সঙ্গে হেপাটাইটিস বি যুক্ত করা হয়। হেপাটাইটিস বি–এর আবিষ্কারক অধ্যাপক বারুচ স্যামুয়েল ব্লুমবার্গের জন্মদিন স্মরণীয় করে রাখতে ২৮ জুলাইকে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস ঘোষণা করা হয়। অধ্যাপক ব্লুমবার্গ শুধু হেপাটাইটিস বি আবিষ্কারকই নন, তিনি এ ভাইরাসের প্রতিষেধক বা টিকাও আবিষ্কার করেন, যে কারণে ব্লুমবার্গ ১৯৭৬ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বিভিন্ন বছর বিভিন্ন স্লোগান নিয়ে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান

জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান

সভাপতি, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি;

সাম্মানিক সভাপতি, বাংলাদেশ গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি সোসাইটি

সবার প্রতি আন্তরিক শুভেচ্ছা। আজকের এ গুরুত্বপূর্ণ আয়োজনের জন্য আমি আয়োজক প্রতিষ্ঠান প্রথম আলো ও হেপাটোলজি সোসাইটির প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। হেপাটাইটিস বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরির জন্য এমন আয়োজন সত্যিই প্রশংসনীয় ও সময়োপযোগী।

প্রতিবছর ২৮ জুলাই বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। এ দিবসের উদ্দেশ্য একটাই—বিশ্বের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হেপাটাইটিস ভাইরাসজনিত সংক্রমণের ভয়াবহতা ও প্রতিরোধের উপায়গুলোর দিকে। লাখ লাখ মানুষ এখনো জানেন না, তাঁরা হেপাটাইটিসে আক্রান্ত। অনেকেই জানেন না, তাঁরা কীভাবে এই ভাইরাস থেকে নিজেদের ও পরিবারের সদস্যদের রক্ষা করতে পারেন। তাই দিবসটি শুধু একটি প্রতীকী আয়োজন নয়, এটি একটি জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের ডাক।

এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘পরিবার থেকেই শুরু হোক হেপাটাইটিস প্রতিরোধ: টেস্ট করুন, টিকা নিন’, আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রতিরোধ শুরু হয় আমাদের নিজেদের ঘর থেকেই। আমাদের নিজেদের সচেতনতার জায়গাটুকুই পারে বড় পরিবর্তনের সূচনা করতে।

হেপাটাইটিস একধরনের লিভারের প্রদাহ, যা সাধারণত ভাইরাসের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। হেপাটাইটিস বি এবং হেপাটাইটিস সি—এই দুই ধরনের সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের। তবে আশার কথা হলো হেপাটাইটিস বি সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধযোগ্য ও হেপাটাইটিস সি নিরাময়যোগ্য। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন সময়মতো শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা।

আমাদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত, সংক্রমিত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা এবং তাঁদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা। সেই সঙ্গে আরও জরুরি হয়ে উঠেছে হেপাটাইটিস বি এবং সি স্ক্রিনিংয়ের সুযোগ ও প্রাপ্যতা বাড়ানো। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সুলভ ও সহজলভ্য স্ক্রিনিং প্রক্রিয়া চালু করতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ নির্ভয়ে পরীক্ষা করাতে পারেন।

হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধে একটি অত্যন্ত কার্যকর, নিরাপদ ও সুলভ টিকা রয়েছে। জন্মের পরপরই শিশুকে এই টিকা দিলে সে আজীবনের জন্য সুরক্ষিত থাকে। তাই প্রতিটি পরিবারকে দায়িত্ব নিতে হবে, যাতে ঘরের শিশুরা ও অন্য সদস্যরা এই টিকা সময়মতো গ্রহণ করেন।

মানুষকে জানতে হবে হেপাটাইটিস রোধযোগ্য, প্রতিরোধযোগ্য ও নিরাময়যোগ্য। আমরা চাই, ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হবে হেপাটাইটিসমুক্ত একটি দেশ। চলুন, আমরা সবাই মিলে একটি হেপাটাইটিসমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলি।

অধ্যাপক ডা. নাজমুন নাহার

অধ্যাপক ডা. নাজমুন নাহার

শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস এখনো বিশ্বজুড়ে বড় স্বাস্থ্য সমস্যা। আমাদের দেশেও এর প্রভাব কম নয়। যদি কোনো গর্ভবতী মায়ের হেপাটাইটিস বি থাকে, তাহলে জন্মের সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাকে হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন দিতে হবে। এটা খুবই কার্যকর একটা সুরক্ষা। কিন্তু এখনো সরকারিভাবে জন্মের সময় এই টিকা দেওয়া হয় না। জাতীয় ইপিআই টিকাদান কর্মসূচিতে এটা নেই, যেটা অবশ্যই যুক্ত করা দরকার।

এদিকে অনেক পরিবার হেপাটাইটিসে আক্রান্তের বিষয়টা গোপন রাখতে চায়। স্ক্রিনিংয়ের কথা বললে প্রথমে বাবা আপত্তি করেন আর মা লজ্জা বা ভয় থেকে কিছু বলেন না। এই ভীতি দূর করে সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

২০১৯ সালের এক সরকারি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ইপিআই টিকা কভারেজ এখনো ৮৩ দশমিক ৯ শতাংশ। অনেক নবজাতক জন্মের সময় টিকা পাচ্ছে না। একটি স্টাডিতে দেখা গেছে, মাত্র ৪৫ শতাংশ নবজাতক জন্মের পরপর হেপাটাইটিস বি টিকা পাচ্ছে। এটা পরিষ্কার, জন্মের সময় টিকা দেওয়ার প্রক্রিয়াটা এখনো সর্বজনীন হয়নি।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো টিকার কার্যকারিতা যাচাইয়ের জন্য অ্যান্টিবডি টেস্ট। বিশেষ করে কিশোরী মেয়েদের ক্ষেত্রে এটা আরও জরুরি। কারণ, তারাই ভবিষ্যতের মা। ১৬-১৮ বছর বয়সী মেয়েদের স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনলে ভবিষ্যতে ঝুঁকি অনেক কমে যাবে।

যেসব শিশু টিকা নেয়নি অথবা টিকা কাজ করেনি কিংবা যারা ইতোমধ্যে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের প্রতি পাঁচ বছর অন্তর স্ক্রিনিং, প্রয়োজন হলে বুস্টার ডোজ দিতে হবে। এ জন্য শিশুস্বাস্থ্য ও হেপাটোলজি সোসাইটিকে একত্রে কাজ করতে হবে এবং সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।

সবশেষে বলি, সরকারকে অবশ্যই জন্মের সময় হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন জাতীয় কর্মসূচিতে যুক্ত করতে হবে। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, নবজাতক পর্যায়ে সময়মতো টিকা দিয়ে ভবিষ্যতের প্রজন্মকে এ নীরব ঘাতক থেকে রক্ষা করা।

অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী

অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী

প্রতিষ্ঠাতা, ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ

সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড হেপাটাইটিস ডে উপলক্ষে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ৬১টি পোস্টার তৈরি করেছিল সচেতনতামূলক প্রচারের জন্য। আমি যখন তাদের জিজ্ঞেস করলাম—তারা প্রথমে হেপাটাইটিস প্রতিরোধের উদ্যোগ কোথা থেকে নেবে, প্রায় ৪০ শতাংশ বলল, তারা শুরু করবে নিজের পরিবার থেকে। এটা আমার কাছে খুব তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে, কারণ পরিবার থেকেই প্রতিরোধের ভিত্তি তৈরি হয়।

আমি লিভার ফাউন্ডেশন থেকে ১৯৯৯ সাল থেকে কাজ করছি, ২০০৭ সালে ওয়ার্ল্ড হেপাটাইটিস অ্যালায়েন্সের ফাউন্ডিং মেম্বারও ছিলাম। এ অভিজ্ঞতায় আমি বারবার বলেছি—একটি মায়ের শরীরে যদি হেপাটাইটিস বি থাকে, তবে নবজাতকও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, আক্রান্ত মায়ের ৩০ থেকে ৮৫ শতাংশ শিশুই সংক্রমিত হয়। তাই যদি মায়ের সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়, বড় একটি সমস্যার সমাধান সম্ভব।

আমাদের দেশে বছরে প্রায় ৩০ লাখ গর্ভবতী নারী থাকেন, এর মধ্যে প্রায় ৬২ শতাংশই গ্রামাঞ্চলে। তাঁদের অনেকেরই জানা নেই যে গর্ভাবস্থায় হেপাটাইটিস পরীক্ষা করা দরকার। ইউনিয়ন বা উপজেলা পর্যায়ে এই পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।

জন্মের পর শিশুদের বার্থ ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তা শহরকেন্দ্রিক থেকে যাচ্ছে। তাইওয়ানের উদাহরণ দেওয়া যায়। সেখানে মাদার-টু-চাইল্ড ট্রান্সমিশন বন্ধ করে তারা সংক্রমণের হার ২৫ শতাংশ থেকে ১ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছে।

আমি বলতে চাই, যদি আমরা সত্যি ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হেপাটাইটিস নির্মূলের লক্ষ্য পূরণ করতে চাই, তবে কাগজে–কলমে নয়, বাস্তবসম্মত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। মাঠপর্যায়ে গিয়ে সমস্যার আসল জায়গা বুঝে কাজ করতে হবে। আমি আমার জীবনভর এই কাজ করে যাচ্ছি এবং চাই সবাই মিলে এটাকে বাস্তবে রূপ দিই।

সবশেষে আমি বলব, হেপাটাইটিস বি ভাইরাস প্রতিরোধে শুধু চিকিৎসা নয়, আমাদের পরিবারে সচেতনতা বাড়াতে হবে, নিরাপদ যৌন সম্পর্ক ও নবজাতকের সময়মতো টিকাদান নিশ্চিত করতে হবে। এসব আলোচনা জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে আমরা জাতীয় পর্যায়ে হেপাটাইটিস বি নির্মূলে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারব।

অধ্যাপক দেওয়ান সাইফুদ্দিন আহমেদ

অধ্যাপক দেওয়ান সাইফুদ্দিন আহমেদ

চেয়ারম্যান, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি সোসাইটি

আমি সাড়ে তিন বছর সুনামগঞ্জের একটি হাওর অঞ্চলে একটি সাব-সেন্টারে কাজ করেছি, আর সেই সময়ের অভিজ্ঞতা আমাকে গ্রামীণ মানুষের চিন্তাধারা, সমস্যা ও বাস্তবতা খুব কাছ থেকে জানতে সাহায্য করেছে। আমি দেখেছি কীভাবে মানুষ হাওরের দূষিত পানি পান করে, বিশেষ করে কার্তিক-অগ্রহায়ণের মতো মৌসুমে, যেখানে সেই পানির গুণগত মান অত্যন্ত খারাপ হয়। আমি সেখানে কলেরা, ডায়রিয়া, হেপাটাইটিস এ এবং ই ভাইরাসের প্রকোপ দেখেছি।

বাস্তবতা হলো, দেশের স্যানিটেশন–ব্যবস্থায় মারাত্মক ঘাটতি আছে—শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশেই। আমাদের খাদ্য প্রস্তুতের পদ্ধতি, পানির মান ও খাদ্য পরিবেশনের নিরাপত্তা হেপাটাইটিস প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শুধু চিকিৎসক দিয়ে এই সমস্যা মোকাবিলা সম্ভব নয়, সবাইকে সচেতন হতে হবে। অনেকের ভুল ধারণা হচ্ছে, জন্ডিস বা হেপাটাইটিসের কোনো অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা নেই। এই বিশ্বাসে মানুষ হারবাল বা কবিরাজি চিকিৎসার দিকে ঝোঁকে, যার ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। তাই সচেতনতা বাড়ানো ছাড়া এর কোনো কার্যকর সমাধান নেই।

আমি মনে করি, কমিউনিটি লেভেলে হেপাটাইটিস বি টেস্ট যদি প্রতিটি গর্ভবতী নারীর জন্য বাধ্যতামূলক করা হয় এবং সরকারের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে টিকা প্রদান করা হয়, তাহলে আমরা নবজাতককে হেপাটাইটিস ট্রান্সমিশন থেকে রক্ষা করতে পারব। যেহেতু হেপাটাইটিস বি-র অধিকাংশ কেসই এই উপায়ে ছড়ায়, এটিকে রোধ করতে পারলে ভবিষ্যতে এই ভাইরাস নির্মূল করা সম্ভব। আমি বিশ্বাস করি, শুধু চিকিৎসক নয়, সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে—সচেতনতা তৈরি করতে হবে, কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে এবং এই জনস্বাস্থ্য সমস্যার সমাধানে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

ডা. শারমিন আব্বাসি

ডা. শারমিন আব্বাসি

স্ত্রীরোগ-বিশেষজ্ঞ, অ্যাডভাইজার, ইন্টারন্যাশনাল FIGO সায়েন্টিফিক কমিটি

মায়েদের শরীর থেকে শিশুর শরীরে হেপাটাইটিস সংক্রমিত হওয়ার বেশি ঝুঁকি থাকে শিশুর জন্মের সময়। এই সংক্রমণ থেকে প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হলো গর্ভাবস্থায় প্রতিটি সময়ে নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো।

বিশ্বে বর্তমানে প্রায় ৩৫ কোটির বেশি মানুষ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত, যাদের মধ্যে অনেকেই প্রজননক্ষম নারী। এক গবেষণা অনুযায়ী, প্রায় ১৮ লাখ প্রজননক্ষম নারী হেপাটাইটিস বি পজিটিভ, যা আমাদের দেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে গৃহিণীদের মধ্যে সংক্রমণের হার প্রায় ৬৮ শতাংশ হওয়ায় পরিবারকেন্দ্রিক প্রতিরোধ উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে। শিশুর গর্ভে থাকাকালে ভাইরাসে সংক্রমণের হার তুলনামূলক কম—মাত্র ৩-৪ শতাংশ। কিন্তু প্রসবকালেই নবজাতকের ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি—প্রায় ৯০ শতাংশ।

এ জন্য ওজিএসবি থেকে সারা দেশে লেবার রুম প্রোটোকল বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই সংক্রমণ রোধে কাজ করছে। এ ছাড়া গর্ভাবস্থায় রুটিন এইচবিএসএজি স্ক্রিনিং চালু করা হয়েছে, যদিও এখন পর্যন্ত কম সংখ্যক গর্ভবতী মা এই সেবার আওতায় এসেছেন, যা যথেষ্ট নয়। এই স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে শনাক্ত মা যদি পজিটিভ হন, ২৮-৩২ সপ্তাহের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের মনিটরিং ও অ্যান্টিভাইরাল থেরাপি দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, পারিবারিক সহায়তার অভাব, আর্থিক সংকট ও সামাজিক কুসংস্কারের কারণে বিপুল সংখ্যক মা এই থেরাপি পান না।

ডেলিভারির সময় ও পরে নবজাতকের সময়মতো ভ্যাকসিন ও ইমিউনোগ্লোবুলিন দেওয়া এবং ছয় মাসে পূর্ণ ডোজ সম্পন্ন করা ও ৯-১২ মাসে স্ক্রিনিং করা জরুরি। কিন্তু এখানে বড় গ্যাপ রয়েছে। চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ, মায়েদের কাউন্সেলিং ও হাসপাতালের ফলোআপ সিস্টেম দুর্বল হওয়ায় বহু শিশু স্ক্রিনিংয়ের বাইরে থেকে যায়। তাই এ ক্ষেত্রে শিশুরোগ-বিশেষজ্ঞ, স্ত্রীরোগ-বিশেষজ্ঞ, সরকার, এনজিও এবং হেপাটোলজিস্টদের যৌথভাবে একটি শক্তিশালী গাইডলাইন বাস্তবায়ন করতে হবে।

ডা. আবদুল্লাহ আল মাহমুদ

ডা. আবদুল্লাহ আল মাহমুদ

সহযোগী অধ্যাপক, লিভার বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ

সাধারণ সম্পাদক, অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য স্টাডি অব লিভার ডিজিজেস বাংলাদেশ

হেপাটাইটিস প্রতিরোধে জনসচেতনতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। গণমাধ্যমের মাধ্যমে আমরা জনগণকে হেপাটাইটিস সংক্রমণের ঝুঁকি, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য দিতে পারি। হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের সংক্রমণ অনেক সময় উপসর্গহীন থাকে, তাই সঠিক সময়ে টেস্ট করা অত্যন্ত জরুরি। টেস্টের মাধ্যমে যদি কেউ পজিটিভ হন, তাহলে আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা ও ওষুধ এখন সহজলভ্য। এ কথা জনগণকে জানাতে হবে।

হেপাটাইটিস প্রতিরোধে ভ্যাকসিনও একটি কার্যকর ব্যবস্থা। গণমাধ্যম এ বিষয়গুলো তুলে ধরলে নীতিনির্ধারকেরা আরও সচেতন হবেন। সমাজে হেপাটাইটিস নিয়ে নানা ভুল ধারণা ও কুসংস্কার আছে, যেমন আক্রান্ত ব্যক্তিকে এড়িয়ে চলা বা সামাজিকভাবে একঘরে করা। এমনকি চাকরি, বিবাহ বা চিকিৎসার ক্ষেত্রেও বৈষম্যের শিকার হতে হয়। এসব ভুল ধারণা দূর করতে গণমাধ্যম বিজ্ঞাপন, টক শো, ডকুমেন্টারি বা সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সচেতনতামূলক ভূমিকা রাখতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবও এখন ব্যাপক। জনপ্রিয় কনটেন্ট ক্রিয়েটর, চিকিৎসকদের পেজ ও ভিডিওর মাধ্যমে যদি হেপাটাইটিস নিয়ে সচেতনতা ছড়ানো যায়, তবে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব।

২০৩০ সালের মধ্যে ভাইরাল হেপাটাইটিস নির্মূলের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। আমি বিশ্বাস করি, গণমাধ্যম ও চিকিৎসক সমাজ একসঙ্গে কাজ করলে হেপাটাইটিস নির্মূলের পথে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারব।

ডা. মো. সাইফুল ইসলাম

ডা. মো. সাইফুল ইসলাম

সহযোগী অধ্যাপক, লিভার বিভাগ, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা বাংলাদেশ।

হেপাটাইটিস বি ভাইরাস যে কারও হতে পারে, যেকোনো বয়সেই এটি আক্রমণ করতে পারে। হেপাটাইটিস দুই রকম হয়—একটি একিউট বা স্বল্পমেয়াদি এবং অন্যটি হলো ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি, যা ছয় মাসের বেশি স্থায়ী হলে লিভারে স্থায়ী প্রদাহ সৃষ্টি করে। বর্তমানে আমাদের দেশে ক্রনিক হেপাটাইটিসের ৭৫ শতাংশ, সিরোসিসের ৬০ শতাংশ এবং লিভার ক্যানসারের ৬৫ শতাংশের জন্য এককভাবে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসই দায়ী। ২০০৩ সালে ইপিআই টিকাদান কর্মসূচিতে হেপাটাইটিস বি টিকা যুক্ত করার পর প্রাদুর্ভাব কমতে শুরু করে। একসময় ১৯৮৪ সালে এই ভাইরাসে আক্রান্তের হার ছিল ৯ দশমিক ৭ শতাংশ, যা এখন কমে ৫ দশমিক ১ শতাংশ হয়েছে।

২০১৮ সালে অধ্যাপক শাহিনুল আলম স্যারের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি গবেষণায়ও এই হার ৫ দশমিক ১ শতাংশ হিসেবেই ধরা হয়েছে, যেখানে দেখা যায় পুরুষেরা নারীদের তুলনায় বেশি আক্রান্ত এবং শহরবাসী গ্রামবাসীর তুলনায় বেশি আক্রান্ত। সংখ্যার বিচারে প্রায় এক কোটি মানুষ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত, যার মধ্যে ৫৭ লাখ পুরুষ, ২৮ লাখ নারী ও প্রায় ৪ লাখ শিশু। পরিবারভিত্তিক হিসাব করলে অন্তত ১৫ লাখ পরিবারে এই ভাইরাসের উপস্থিতি রয়েছে। আজকের প্রতিপাদ্য—‘পরিবার থেকেই শুরু হোক প্রতিরোধ, টেস্ট করুন, টিকা নিন’—এই বাস্তবতার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়।

বর্তমানে ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী কর্মক্ষম তরুণ-তরুণীদের মধ্যে প্রায় ২৫ লাখ আক্রান্ত, যাঁদের অনেকেই চাকরির পরীক্ষায় অংশ নেন এবং কেবল এইচবিএসএজি পজিটিভ হলেই তাঁদের চাকরি থেকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়, যা মোটেও বৈজ্ঞানিক নয়। আমি এ বিষয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

ডা. মোহাম্মদ কামরুল আনাম

ডা. মোহাম্মদ কামরুল আনাম

লিভার বিশেষজ্ঞ, জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং

আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, হেপাটোলজি সোসাইটি ঢাকা, বাংলাদেশ।

হেপাটাইটিস বি একটি মারাত্মক এবং নীরব যকৃতের রোগ, যা বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী একটি বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত। ভাইরাসটি মূলত দুটি উপায়ে–মাতৃগর্ভ থেকে সন্তানের মধ্যে এবং সরাসরি সংস্পর্শের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়।

তাই আমি মনে করি পরিবারের সদস্যদের স্ক্রিনিং করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, এই রোগ প্রায়ই উপসর্গহীন থাকে এবং একজন ব্যক্তি নিজের অজান্তেই পরিবারের অন্যদের মধ্যে ভাইরাসটি ছড়িয়ে দিতে পারেন। অনেক সময় দেখা যায় একই পরিবারে একাধিক সদস্য আক্রান্ত হন, যা হতে পারে গর্ভবতী মায়ের থেকে নবজাতকে সংক্রমণের মাধ্যমে, যৌন সঙ্গীর মাধ্যমে এবং রক্তের মাধ্যমে। সে ক্ষেত্রে আমাদের স্ক্রিনিং গাইডলাইন অনুযায়ী, আক্রান্ত ব্যক্তির নিকটাত্মীয়দের (যেমন সন্তান, পিতামাতা, ভাইবোন) স্ক্রিনিং করতে হবে। স্ক্রিনিংয়ের জন্য এইচবিএসএজি এবং এন্টি-এইচবিসি পরীক্ষা প্রয়োজন। যদিও গর্ভবতীদের ক্ষেত্রে শুধু এইচবিএসএজি পরীক্ষাই যথেষ্ট।

টিকাদানের দিক থেকে ইপিআই প্রোগ্রামের আওতায় নবজাতকদের টিকা দেওয়া হলেও বাকি শিশু-কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্ক ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদেরও টিকা দিতে হবে। বিশেষ করে যাঁরা এখনো সংক্রমিত নন এবং টিকাও নেননি, তাঁদের দ্রুত ইমিউনাইজ করা দরকার।

টিকা দেওয়ার পর নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে ৪০ বছরের বেশি বয়সী বা স্বাস্থকর্মী-পোস্ট ভ্যাকসিনেশন টেস্ট করতে হয় এবং প্রয়োজন হলে বুস্টার ডোজ দিতে হয়।

ডা. তানভীর আহমাদ

ডা. তানভীর আহমাদ

মিডিয়া ও প্রকাশনা সম্পাদক,

হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ।

যদি পরিবারের একজন সদস্য হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত হন, তাহলে একই পরিবারের অন্য সদস্যদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।

এই বিষয়ে আমি বিশেষভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার কথা বলব, যেটি করেছেন হেপাটোলজি সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. গোলাম আযম। তাঁর গবেষণাটি ছিল বাংলাদেশে পরিবারভিত্তিক হেপাটাইটিস বি সংক্রমণের ধরন ও মাত্রা বিশ্লেষণ নিয়ে। গবেষণাটি ছিল ১০০টি পরিবারের ৫৩২ জন সদস্যের ওপর।

আমরা যখন এই ফলাফল দেখি, তখন সত্যিই উদ্বিগ্ন হয়ে যাই। কারণ দেখা গেছে, এসব পরিবারের প্রায় ৫৮ শতাংশ সদস্য হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের সংস্পর্শে এসেছেন। এর মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ সদস্যের ক্রনিক ইনফেকশন হয়েছে, ৫ দশমিক ৫ শতাংশ সদস্যের ছিল একিউট ইনফেকশন এবং ২১ শতাংশ সদস্য সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। গৃহিণীদের মধ্যে সংক্রমণের হার ছিল ৬৮ শতাংশ, চাকরিজীবীদের মধ্যে ৬৬ শতাংশ, ব্যবসায়ীদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিল প্রায় ৪৮ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের হার দেখা গেছে প্রবীণদের মধ্যে—প্রায় ৮৩ শতাংশ।

এ ছাড়া দেখা গেছে, যাঁরা জন্ডিসে আক্রান্ত হয়েছেন বা যাঁদের আগে কোনো সার্জারি বা রক্ত গ্রহণের ইতিহাস আছে, তাঁদের মধ্যেও হেপাটাইটিস বি সংক্রমণের হার ছিল বেশ উচ্চ। এসব তথ্য আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় একজন সদস্য আক্রান্ত হলে পুরো পরিবারই হুমকির মুখে পড়ে। তাই আমি বলব, শুধু আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসা দিলেই চলবে না, পরিবারের সব সদস্যকে স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনতে হবে, টিকা দিতে হবে।

সম্মানিত অতিথি: জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান, সভাপতি, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি; সাম্মানিক সভাপতি, বাংলাদেশ গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি সোসাইটি।

সম্মানিত আলোচক: অধ্যাপক মো. শাহিনুল আলম, উপাচার্য, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সভাপতি, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা বাংলাদেশ। ডা. মো. গোলাম আযম, বিভাগীয় প্রধান, লিভার ও গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগ, বারডেম ও সাধারণ সম্পাদক, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা বাংলাদেশ। অধ্যাপক ডা. নাজমুন নাহার, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, প্রতিষ্ঠাতা, ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশন অফ বাংলাদেশ। অধ্যাপক দেওয়ান সাইফুদ্দিন আহমেদ, চেয়ারম্যান, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি সোসাইটি। ডা. শারমিন আব্বাসি, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ও অ্যাডভাইজার, ইন্টারন্যাশনাল FIGO সাইন্টিফিক কমিটি। ডা. আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, সহযোগী অধ্যাপক, লিভার বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এবং সাধারণ সম্পাদক, এসোসিয়েশন ফর দ্য স্টাডি অব লিভার ডিজিজেস বাংলাদেশ। ডা. মো. সাইফুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক, লিভার বিভাগ, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও বিজ্ঞান বিষয়ক সম্পাদক, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা বাংলাদেশ। ডা. মোহাম্মদ কামরুল আনাম, লিভার বিশেষজ্ঞ, জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, হেপাটোলজি সোসাইটি ঢাকা, বাংলাদেশ। ডা. তানভীর আহমাদ, মিডিয়া ও প্রকাশনা সম্পাদক, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ।

সঞ্চালনা: ফিরোজ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো ।