সবিশেষ

ঈদের সেমাই

ঈদের অন্যতম অনুষঙ্গ সেমাই। ছবি: প্রথম আলো
ঈদের অন্যতম অনুষঙ্গ সেমাই। ছবি: প্রথম আলো

সেসেমাই কি আরবি-ফারসি শব্দ? না। সেমাই কি বিশুদ্ধ মুসলমানি খাবার? তাও না। তারপরও সেমাই ছাড়া বাঙালি মুসলমানের ঈদুল ফিতর কল্পনাই করা যায় না।
সেমাইয়ের সঙ্গে ঈদুল ফিতরের সম্পর্কটা কীভাবে তৈরি হলো তার হদিস পাওয়াটাও বেশ মুশকিল। বাঙালির সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ছিটেফোঁটা মধ্যযুগের ইতিহাস গ্রন্থে যেটুকু পাওয়া যায় তার মধ্যে সেমাইয়ের উল্লেখ নেই। কিন্তু ফিরনির আছে। নবাব আলিবর্দী খাঁর খাদ্য তালিকায় খিচুড়ির উল্লেখযোগ্য অবস্থান ছিল। সেমাইয়ের উল্লেখ পাওয়া যায় না মোগল রসুইঘরেও। অর্থাৎ সেমাই মোগলাই খাবারের মধ্যে পড়ে না।
মধ্যযুগের সাহিত্যে অনেক খাবারের নাম পাওয়া যায়। কিন্তু সেমাইয়ের নাম কোথাও নেই।
ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন ভাষাতে সেমাইয়ের নাম একেক রকমের। বাংলা অবশ্য সেমাই। তবে হিন্দি, উর্দু ও পাঞ্জাবিতে সেমিয়া অথবা সেভিয়াঁ। মারাঠিতে বলে সেমাইয়া, গুজরাটিতে সেই এবং তেলেগু, তামিল ও মালায়লামে সেমিয়া।
ভারতের অনেক অঞ্চলে অবশ্য সেমাইয়ের দুই রূপ—­এক হলো নামকিন সেমাইয়া, অন্যটা হলো সেমিয়া সেভিয়াঁ ক্ষীর। অর্থাৎ তা মিষ্টি। বাংলাদেশের সেমাইয়ের স্বাদ একটাই—আর তা হলো মিষ্টি।
সেমাইয়ের খানিকটা আন্তর্জাতিকতাও আছে। বাঙালি সেমাই ভিন্ন নামে আছে গ্রিসে। আছে আফ্রিকার সোমালিয়াতেও। সেখানে তার নাম কাদ্রিয়াদ। বাংলাদেশে শুধু ঘি দিয়ে ভেজে যেভাবে দমে সেমাই রান্না হয়, সোমালিয়ার কাদ্রিয়াদ রান্নার প্রণালি সেই একই রকম। সেমাইয়ের কাছাকাছি কিছু পদ পাওয়া যাবে ইরান ও তুরস্কেও। নাম অবশ্য ভিন্ন।
বাংলা অভিধানে সেমাই শব্দটাকে কোথাও বলা হয়েছে হিন্দি, কোথাও বলা হয়েছে দেশি। ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, গ্রিক শব্দ সেমিদালিস থেকে সেমাই শব্দের উৎপত্তি। তবে ব্যাপারটা সরাসরি ঘটেনি। সেমিদালিস শব্দের মূল অর্থ হলো ময়দা। ময়দা অবশ্য ফারসি শব্দ। যা হোক, এই সেমিদালিস শব্দ সংস্কৃত ভাষায় প্রবেশ করে সমিদা রূপ ধারণ করে। সমিদা থেকেই তৈরি হয় সেমাই, সেমিয়া ইত্যাদি শব্দ এবং এইসব নামের মিষ্টান্ন দ্রব্য।
আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের মধ্য দিয়ে গ্রিসের সঙ্গে ভারতের পরিচয় ঘটে। সেই সময় খাদ্যদ্রব্য হিসেবে সেমিদালিস বা ময়দার সঙ্গে ভারতের পরিচয় ঘটা বিচিত্র নয়। সেমিদালিসের সমিদা হওয়া এবং সমিদা থেকে সেমাই হওয়া ভাষাতত্ত্বে নতুন কোনো ঘটনা নয়।
শব্দের পথ ধরে ইতিহাসের দিকে এগোনো যায়। শব্দের চাবি দিয়ে খোলা যায় ইতিহাসের অনেক দরজা। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সেমাই শব্দের বুৎপত্তি নির্দেশ করে দেখিয়ে দিয়েছেন—সেমাই শব্দের গায়ে গ্রিসের গন্ধ থাকলেও সেমাই দ্রব্যটা আসলে ভারতীয়। ভারতের অনেক রাজ্যেই সেমাই নানাভাবে খাওয়া হয়। বিভিন্ন পালাপার্বণেও সেমাই রান্নার রেওয়াজ রয়েছে। তা ছাড়া, উপমহাদেশের মুসলমানমাত্রই ঈদের দিনে সেমাই খায়। পাকিস্তানেও সেমাই ছাড়া ঈদ হয় না।
সেমাইয়ের ইংরেজি নাম পাওয়া যায় ভারমিসেলি। শব্দটা ইতালীয় ভারমিয়েল্লি শব্দের ইংরেজি রূপ। স্বাদ ও রন্ধনপ্রণালির দিক থেকে সেমাইয়ের স্বাদ ভারমিসেলি বা ভারমিচেল্লির কোনো সম্পর্ক নেই। মিল রয়েছে শুধু চেহারায়।
আমাদের দেশে এখন ভারমিচেল্লির চেহারার মেশিনে তৈরি সেমাই প্যাকেটজাত অবস্থায় পাওয়া যায়। ঈদে সেমাই অপরিহার্য হলেও সুদূর মফঃস্বল বা গ্রামে সত্তর-আশি বছর আগে প্যাকেটজাত রেডিমেড সেমাই সহজলভ্য ছিল না। বাড়ির মহিলাদের হাতে তখন তৈরি হতো আদি অকৃত্রিম ঈদের সেমাই। তাঁরা সেমাই বলতেন না। বলতেন সেমুই, সিমুই, সিউই বা সেঁউ। ঈদের কয়েক দিন আগে থেকেই বাড়িতে বাড়িতে সেমাই তৈরি শুরু হয়ে যেত। মাটির হাঁড়ি কিংবা কলসি উপুড় করে হাতের অপূর্ব দক্ষতায় ময়দার লেই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাঁরা নামাতেন ময়দার সুতো বা সেমাই। চালের আটার টুকরো সেমাই তৈরি হতো পিঁড়িতে হাত ঘুরিয়ে।
পরে এল পিতলের তৈরি সেমাইকল। কয়েকটা ছাঁচ ছিল সেই কলে—মোটা, মাঝারি ও মিহি। সেমাইকলের হাতল ঘোরানো শ্রমসাধ্য ব্যাপার ছিল। হাতল ঘোরানোর দায়িত্ব পড়ত ছোটদের ওপর। ব্যাপারটা তাদের কাছে নিরানন্দের ছিল না।
সেমাই এখন দুই প্রকারের। তার সেমাই বা খিল সেমাই। আরেকটা হলো লাচ্চা বা লাচ্চি সেমাই। এ সেমাইয়ের প্রকরণ আলাদা। আগে পাওয়া যেত ঘিয়ে ভাজা। এ সেমাইয়ের উৎপত্তি কোথায় তা জানা যায় না। নামটা লাচ্চা হলো কেন তাও বলা মুশকিল। আরবি লম্বুতদার শব্দ ঢাকার আদি বাসিন্দাদের মুখে উচ্চারিত হতো লাচ্ছাদার। লম্বতদার শব্দের অর্থ সুস্বাদু। লাচ্ছাদার মানেও তা-ই। হতে পারে এই লাচ্ছদারই লাচ্ছি হয়ে সেমাইয়ের আগে বসে গেছে। আবার, এমনও হতে পারে লাচ্চা সেমাইয়ের উদ্ভবই ঢাকাতে—ঢাকায় আগত অবাঙালিদের দ্বারা অথবা আদি ঢাকাইয়াদের হাতেই। ময়দার তৈরি সুস্বাদু বাখরখানি তো ঢাকারই অবদান।