Thank you for trying Sticky AMP!!

একুশের গান

চট্টগ্রামের শিল্পীদের গণসংগীত, ১৯৫৪। বাঁ থেকে জাহানারা ইসলাম, বিলকিস নাসিরউদ্দিন, খালেদা রহমান, দীপ্তি খাস্তগীর, কামেলা শরাফী ও কলিম শরাফী, ছবি: রফিকুল ইসলাম

১৯৪৮-এ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনের প্রথম পর্ব থেকে ভাষার গান রচনা শুরু হয়। সর্বপ্রথম গানটি রচনা করেন কবি ও গীতিকার অধ্যাপক আনিসুল হক চৌধুরী। এতে সুরারোপ করেন প্রখ্যাত গণসংগীতশিল্পী শেখ লুৎফর রহমান। গানটির একাংশ এমন:

‘শোনেন হুজুর—

/ বাঘের জাত—এই বাঙালেরা—

/ জান দিতে ডরায় না তারা,

/ তাদের দাবি বাংলা ভাষা/ আদায় করে নেবে তাই’।


তিনি পরবর্তীকালে আরও গান রচনা করেন। যার পটভূমি বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি। দুটি গানের কয়েকটি চরণ:

১. ‘বাংলার বুকের রক্তে রাঙানো আটই ফাল্গুন

/ ভুলতে কি পারি শিমুলে পলাশে হেরি লালে লাল খুন’,

২. ‘বাংলাদেশ আর বাংলা ভাষা যখন একই নামের সুতোয় বাঁধা’।

কিন্তু ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের ঘটনা সারা দেশকে কাঁপিয়ে দেওয়ার পর তা নিয়ে প্রথম গান লেখেন ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হক।

‘ভুলব না,

ভুলব না,

একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’

গানটিতে সুরারোপ করেছিলেন তাঁরই অনুজ নিজাম উল হক।

তিনি ‘দূর হাঁটো দূর হাঁটো।/ঐ দুনিয়াওয়ালে, হিন্দুস্তান হামারা হায়’

—জনপ্রিয় এই হিন্দি গানটির সুর অনুসরণ করেছিলেন। অমর একুশের সূচনাপর্বের গান হিসেবে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

অমর একুশের আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত একাধিক ভাষাসংগ্রামী তাঁদের একুশের স্মৃতিচারণামূলক রচনায় গাজীউল হকের গানটিকে একুশের প্রথম গান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

গানটি সম্পর্কে গাজীউল হক তাঁর একুশের স্মৃতিচারণায় জানিয়েছেন: ‘১৯৫৩-৫৪-৫৫ সালে যে গানটি গেয়ে প্রভাতফেরি করা হতো, সে গানটি লিখেছিলাম আমি।

’ গাজীউল হকের আরেকটি একুশের গানের দুচরণ:

‘শহীদ তোমায় মনে পড়ে, তোমায় মনে পড়ে।/

তোমার কান্না তোমার হাসি আমার চোখে ঝরে।’


১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী ও প্রথম শহীদ দিবসে প্রভাতফেরিতে ভাষাসংগ্রামী প্রকৌশলী মোশারেফ উদ্দিন আহমদের (১৯২০-১৯৫৬)

‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল/

ভাষা বাঁচাবার তরে/

আজিকে স্মরিও তারে’

গানটি গাওয়া হয়।

এটি প্রভাতফেরির প্রথম গান। সুর আলতাফ মাহমুদের।


একুশের প্রথম পর্বে রচিত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর অমর কবিতা

‘একুশে ফেব্রুয়ারি’।

কবিতাটিতে প্রথমে সুর দিয়েছিলেন গীতিকার-সুরকার ও শিল্পী আবদুল লতিফ (১৯২৭-২০০৫)।

পরবর্তী সময়ে এতে সুর-যোজনা করেন আর এক মহৎ সুরস্রষ্টা আলতাফ মাহমুদ। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ আলতাফ মাহমুদের সুরের কারণে প্রভাতফেরির অনিবার্য গান হয়ে ওঠে।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী অমর একুশে নিয়ে আরও কয়েকটি অনিন্দ্যসুন্দর গান রচনা করেছেন।

দুটি গানের কয়েকটি চরণ উদ্ধৃত করি:

১.

‘রক্তে আমার আবার প্রলয় দোলা/

ফাল্গুন আজ চিত্ত আত্মভোলা/

আমি কি ভুলিতে পারি/

একুশে ফেব্রুয়ারি,’

২.

‘শহীদ মিনার ভেঙেছো আমার ভাইয়ের রক্তে গড়া/

দ্যাখো বাংলার হূদয় এখন শহীদ মিনারে ভরা।.../

এত রক্তের প্রাণকল্লোল সাগরে দেবেই ধরা।’

বাংলাদেশের কবি ও গীতিকবিদের প্রায় সবাই একুশের গান লিখেছেন। এ ছোট নিবন্ধে সবার নাম ও তাঁদের গানের চরণ উদ্ধৃত করা সম্ভব নয়।

কিছু অনিবার্য গীতিকারের নাম ও তাঁদের গানের উল্লেখ না করলেই নয়। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন একুশের গানের প্রথম সুরকার আবদুল লতিফ (১৯২৭-২০০৫)।

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ তে সুরারোপ ও পরিবেশনা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।

তিনি লিখলেন কালজয়ী একুশের গান:

‘ওরা আমার মুখের ভাষা/

কাইড়া নিতে চায়,/

ওরা, কথায় কথায় শিকল পরায়/

আমার হাতে পায়।’


তারপর একে একে লিখলেন

‘বুকের খুনে রাখলো যারা/ মুখের ভাষার মান/

ভোলা কি যায়রে তাদের দান?’

, ‘আমি কেমন কইরা ভুলি/

মুখের কথা কইতে গিয়া/

ভাই আমার খাইছে গুলি’, ‘রফিক-শফিক বরকত নামে/

বাংলা মায়ের দুরন্ত কটি ছেলে।/

স্বদেশের মাটি রঙিন করেছে/

আপন বুকের তপ্ত রক্ত ঢেলে’,

‘আবার এসেছে অমর একুশে/

পলাশ ফোটানো দিনে,/

এ দিন আমার ভায়েরা আমায় বেঁধেছে রক্তঋণে’।

এ প্রসঙ্গে একটি কথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন। উল্লিখিত সবকটি গানই তিনি রচনা করেছিলেন ১৯৫৩ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে।

তখনো দেশটির নাম পাকিস্তান। কাজটি খুব সহজ ছিল না।


বিভিন্ন রচয়িতার লেখা কয়েকটি একুশের গানের কয়েকটি করে পঙিক্ত উদ্ধৃত করছি:
১.

‘ঘুমের দেশে ঘুম ভাঙাতে ঘুমিয়ে গেল যারা/

জ্বলছে স্মৃতি আলোর বুকে ভোরের করুণ তারা’ (বদরুল হাসান)

২.

‘শহীদি খুন ডাক দিয়েছে/

আজকে ঘুমের ঘোরে/

আজ রক্তপথের যাত্রী মোরা/

নতুন আলোর ভোরে’ (তোফাজ্জল হোসেন)

৩.

‘রিক্ত শপথে আজিকে তোমারে স্মরণ করি/

একুশে ফেব্রুয়ারি’ (তোফাজ্জল হোসেন)

৪.

আমাদের চেতনার সৈকতে/

একুশের ঢেউ মাথা কুটলো/

শহীদের রক্তের বিনিময়ে/

চোখে জল কয় ফোঁটা জুটলো’ (নাজিম মাহমুদ)

৫. ‘মিলিত প্রাণের কলরবে/

যৌবন ফুল ফোটে রক্তের অনুভবে’ (হাসান হাফিজুর রহমান)

৬.

‘সালাম সালাম হাজার সালাম/

সকল শহীদ স্মরণে,/

আমার হূদয় রেখে যেতে চাই/

তাঁদের স্মৃতির চরণে’ (ফজল-এ-খোদা)

৭.

‘অপমানে তুমি জ্বলে উঠেছিলে/

সেদিন বর্ণমালা/

সেই থেকে শুরু দিনবদলের পালা’ (আবু হেনা মোস্তফা কামাল)

৮.

‘ফসলের মাঠে, মেঘনার তীরে/

ধু ধু বালুচরে, পাখিদের নীড়ে/

তুমি আমি লিখি প্রাণের বর্ণমালা’ (শামসুর রাহমান)

৯. ‘একঝাঁক পলাশের দুরন্ত রক্তে/

রাজপথ জনপথ সিক্ত/

শহীদের শপথেরা হূদয়ের স্তম্ভে/

দুর্জয় উন্মেষে দীপ্ত’ (ইন্দু সাহা)

১০. ‘ভুলব না কোনো দিন ফাল্গুনের ইতিহাস;/

ভুলব না খুন রাঙা এই দিন এই মাস।/

ফাল্গুনের ইতিহাস ভুলব না’ (সিরাজুল ইসলাম)

ভাষা-আন্দোলন শুধু রাজধানী বা দেশের প্রধান প্রধান শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে।

অমর একুশে মর্মান্তিক ঘটনা দেশের প্রধান প্রধান কবি ও গীতিকারদের যেভাবে আলোড়িত করেছিল—একইভাবে আলোড়িত করেছিল দেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আউল-বাউল, স্বভাবকবি, গ্রামীণ বয়াতি ও কবিয়ালদের। শামসুদ্দিন আহমদ, রমেশ শীল, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, শাহ আবদুল করিম, মহিন শাহ, আবদুল হালিম বয়াতি, মাতু মিয়া, কবিয়াল ফণী বড়ুয়া প্রমুখের রচনা একুশের গানকে ভিন্নমাত্রায় উন্নীত করেছে।

এঁরা শুধু গান রচনা করেই থেমে থাকেননি, গ্রামেগঞ্জে, হাটবাজারে গেয়ে বেড়িয়েছেন। একুশের গান গাওয়ার জন্য এঁদের অনেকেই নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। কেউ কেউ শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন।

তাঁদের রচিত কয়েকটি গান :

১.

‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালি/

তোরা ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি।’ (শামসুদ্দিন আহমদ)

২.

‘বাংলা আমার মায়ের ভাষা এমন ভাষা আর যে নাই/

এ ভাষাতে মা-কে ডাকি ডেকেছে মোর সালাম ভাই।’ (মোহাম্মদ মাতু মিয়া)

৩.

সালাম আমার শহীদ স্মরণে/ দেশের দাবি নিয়া দেশপ্রেমে মজিয়া/

প্রাণ দিলেন যেসব বীর সন্তানে’ (শাহ আবদুল করিম)

৪.

‘ভাষার জন্য জীবন হারালি/

বাঙালি ভাইরে রমনার মাটি রক্তে ভাসালি’ (রমেশ শীল)

৫.

‘আমি বাংলা ভালবাসি,/

আমি বাংলার বাংলা আমার ওতপ্রোত মেশামেশি’ (রমেশ শীল)

৬.

‘বাংলাদেশের মানুষ, ফেব্রুয়ারি একুশে ভুলিতে পারবে না জীবনে/

ভাষা আন্দোলনের জন্য জনসমাজ হল বিপন্ন কুখ্যাত সরকারের শাসনে।’ (বিজয় সরকার)

৭. ‘শোন দেশের ভাই-ভগিনী/

শোন আচানক কাহিনী/ কান্দে বাংলা জননী ঢাকার শহরে’ (হেমাঙ্গ বিশ্বাস)

৮.

‘কাইন্দ না মা কাইন্দ না আর বঙ্গজননী/

তুমি যে বীর প্রসবিনী গো তুমি শহীদ জননী।’ (হেমাঙ্গ বিশ্বাস)

৯.

‘বাঙালিদের বাংলা ভাষার রাখি ইজ্জত মান/

হাসিমুখে সফিক বরকত করে জীবন দান।’ (ফণী বড়ুয়া)

১০.

‘এদিক-ওদিক বলতে আমার অনেক হবে দেরি/

মন দিয়া শোনেন ভাষা আন্দোলনের জারি...’ (আবদুল হালিম বয়াতি)


একুশের গানের কবি ও গীতিকারদের মধ্যে রয়েছেন:

সত্যেন সেন, গাজীউল হক, জসীমউদ্দীন, হাসান হাফিজুর রহমান, নাজিম মাহমুদ, আলিমুজ্জামান চৌধুরী, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, সিকান্দার আবু জাফর, সিরাজুল ইসলাম, কাজী লতিফা হক, নরেন বিশ্বাস, দিলওয়ার, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান, আবিদ আনোয়ার, বদরুল হাসান, জাহিদুল হক, নাসির আহমেদ, মতলুব আলী, শাফাত খৈয়াম, মুহাম্মদ মুজাক্কের, এস এম হেদায়েত, আজাদ রহমান, নজরুল ইসলাম বাবু, আবুবকর সিদ্দিক, সৈয়দ শামসুল হুদা, ফজল-এ-খোদা, হামিদুল ইসলাম, মুন্সী ওয়াদুদ, তোফাজ্জল হোসেন, ইন্দু সাহা, হাবীবুর রহমান, আসাদ চৌধুরী, জেব-উন্-নেসা জামাল, মাসুদ করিম, আজিজুর রহমান, আজিজুর রহমান আজিজ, কে জি মোস্তফা, আবদুল হাই আল হাদী, নূরুজ্জামান শেখ প্রমুখ। একুশের গানে সুরারোপ করেছেন: আলতাফ মাহমুদ, আবদুল লতিফ, মোমিনুল হক, নিজাম উল হক, সমর দাস, সত্য সাহা, সাধন সরকার, আজাদ রহমান, আবদুল আহাদ, শেখ লুৎফর রহমান, খোন্দকার নূরুল আলম, অজিত রায়, লোকমান হোসেন ফকির, আবদুল জব্বার, খান আতাউর রহমান, প্রশান্ত ইন্দু, রমেশ শীল, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, কবিয়াল ফণী বড়ুয়া, আবেদ হোসেন খান, দেবু ভট্টাচার্য, বশির আহমেদ, রাম গোপাল মোহান্ত, সুখেন্দু চক্রবর্তী, হরলাল রায় প্রমুখ। তবে কবি, গীতিকার ও সুরকারদের এ তালিকা মোটেও সম্পূর্ণ নয়।

একুশের প্রথম তিনটি সংকলনে—সহকর্মী অর্থাৎ প্রমথ নন্দী সম্পাদিত ওরা প্রাণ দিল (সেপ্টেম্বর ১৯৫২), হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারী (মার্চ ১৯৫৩) এবং ডি এ রশীদ ও মহিউদ্দীন আহমদ সম্পাদিত একুশের সংকলন (১৯৫৬)—একুশের গানের স্বল্পতা বিস্মিতকর।

কারণ, সংকলনগুলো প্রকাশকালের মধ্যেই একুশের বিখ্যাত বেশ কয়েকটি গান রচিত হয়েছিল। প্রথম সংকলনটিতে দুটি, দ্বিতীয়টির প্রথম মুদ্রণে দুটি ও তৃতীয়টিতে মাত্র একটি গান সংকলিত হয়েছে।

হাসান হাফিজুর রহমানের একুশে ফেব্রুয়ারীর দ্বিতীয় সংস্করণে জসীমউদ্দীন ও আবদুল লতিফের একটি করে ও তৃতীয় সংস্করণে ইন্দু সাহার একটি গান যুক্ত হয়।

এ ধারাটি একুশে ফেব্রুয়ারির চতুর্থ সংস্করণে আর অব্যাহত থাকেনি। এবার ১৯৫২ সালের অমর একুশের ৬২ বছর পূর্ণ হলো।

এ কথা এখন দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যায় যে এ ভূখণ্ডের বাঙালির যা কিছু অর্জন তার পুরোটারই পশ্চাৎভূমি হিসেবে রয়েছে অমর একুশের অনন্য ভূমিকা।

বায়ান্নর একুশে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে—তাদের ভাষাকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী চেতনাকে শানিত করেছে।

যার ফলে একাত্তরে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছিল।
অমর একুশের ছয় দশকের অধিক সময় অতিক্রান্ত হলেও আজ অবধি একুশের গানের উল্লেখযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য কোনো সংকলন প্রকাশিত হয়নি।

যার ফলে একুশের গানের অধিকাংশই রয়ে গেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে—পত্রপত্রিকা ও সংকলনের পাতায়।

গানগুলো সংগ্রহের বিষয়ে উদ্যোগী না হলে অনেক গানই হারিয়ে যাবে কালের অতলে।