Thank you for trying Sticky AMP!!

খাদ্য জোগানো গবেষণা প্রতিষ্ঠান

গাজীপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭০ সাল বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ভাতে–মাছে বাঙালির কাছে বছরটি আরেক কারণে স্মরণীয় থাকার যোগ্য। বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য ভাতের জোগানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) জন্ম ওই বছরে, যে সংস্থার বিজ্ঞানীদের হাত ধরে এ দেশের কৃষকেরা ১০০টি ধানের নতুন জাত পেয়েছেন। দেশের ভাতের সিংহভাগের জোগান আসছে ব্রি উদ্ভাবিত জাতগুলো চাষ করে।

রাজধানীর সীমানা ছাড়িয়ে টঙ্গী পেরিয়ে গাজীপুরের চৌরাস্তা ধরে কিছুদূর এগোলেই রাস্তার পাশে বড় করে লেখা বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) বড় সাইনবোর্ড। টঙ্গী থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ভাঙা সড়ক, সড়কের পাশে জমে থাকা পানি আর তীব্র যানজট পেরিয়ে পৌঁছাতে হবে সেখানে। মূল ফটকে প্রবেশ করলেই অবশ্য মন ভালো হয়ে যাবে। সারি সারি ধানের জমি, মাঝখানে ছোট ছোট ভবন। কোনোটাতে বোরো, কোনোটায় আমন ও আউশের নতুন জাত উদ্ভাবন নিয়ে গবেষণা চলছে। কোথাওবা পোকামাকড়, কৃষিপ্রযুক্তি উদ্ভাবনে মেতে আছেন সেখানকার বিজ্ঞানীরা।

ব্রি প্রতিষ্ঠার বছর ১৯৭০ সালে দেশে ধানের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন। জনসংখ্যা ছিল সোয়া সাত কোটি। ১৯৭২ সালে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে বলেছিলেন তলাবিহীন ঝুড়ি। ওই দেশেরই বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা ৪১ বছর পর ২০১৩ সালের ২৮ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধান গবেষণা নিয়ে এক সেমিনারে গিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, ধানে উপচে পড়া দেশ।’ ওই বক্তব্যের পেছনে কারণ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর ধানবিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী কয়েক বছর ধরে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দ্রুত হারে ধানের উৎপাদন বাড়ছে বাংলাদেশে। ২০১৭ সালে হাওরে ফসল বিপর্যয় বাদ দিলে বাংলাদেশ চার বছর ধরে ধান উৎপাদনে উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হয়েছে। আর তা সম্ভব হয়েছে ব্রির নতুন নতুন ধানের জাতের চাষ জনপ্রিয় হওয়ার কারণে। ১৯৭০ সালে যেখানে প্রতি হেক্টরে ধান হতো এক টন, ব্রির জাত উদ্ভাবনের পর তা এখন দাঁড়িয়েছে সাড়ে চার টনে। সংস্থাটির উদ্দেশ্য প্রতি হেক্টরে উৎপাদন ১৪ টনে উত্তীর্ণ করা।

শুধুই কি ধানের জাত, ব্রির বিজ্ঞানীরা ধানের চাষ কৌশল থেকে শুরু করে পোকা-মাকড় দমনের কৌশল উদ্ভাবনের মতো কাজ ধারাবাহিকভাবে করে যাচ্ছেন। দেশে একসময় চাষ হওয়া আট হাজার ধানের জাতের সংগ্রহ আছে সংস্থাটিতে। ওই জাতগুলো থেকে নিত্যনতুন ধানের জাত উদ্ভাবন করছেন বিজ্ঞানীরা। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংস্থাটির ২৪৯ জন বিজ্ঞানী কাজ করছেন। গাজীপুরের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছাড়াও সারা দেশে তাদের রয়েছে ১৯টি গবেষণাকেন্দ্র।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক শাহজাহান কবির বললেন, ‘২০৩০ সালের মধ্যে দেশের জনসংখ্যা ২০ কোটি ছাড়াবে। এদিকে কৃষিজমি কমছে ১ শতাংশ করে। দ্রুত শিল্পায়নের কারণে কৃষিজমি আরও দ্রুত কমবে। এই পরিস্থিতিতে দ্রুত ও বেশি উৎপাদনক্ষম জাত উদ্ভাবনে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি।’
ব্রির উদ্ভাবন করা জাতগুলোর মধ্যে বিআর–২৮ ও বিআর–২৯–কে বিশ্বসেরা ধানের জাত হিসেবে মনে করা হয়। এই দুটি জাত চাষ করেই বাংলাদেশে বছরে দেড় কোটি টনের বেশি চাল উৎপাদিত হয়।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রায় সমবয়সী এই প্রতিষ্ঠানকে আমরা দেশের সবচেয়ে সফল গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলতে পারি। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবন শুধু ল্যাবরেটরির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, তারা দেশের মানুষের মুখে আহার জোটানোর কথা চিন্তা করে গবেষণা করছে।’
ব্রির বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত লবণসহিষ্ণু ১০টি, খরাসহিষ্ণু ৩টি, জলসহিষ্ণু ৪টি, পুষ্টিমানসমৃদ্ধ ৫টি ও রপ্তানিযোগ্য সরু চালের ৪টি জাত উদ্ভাবন করেছেন।

এত সব গবেষণার স্বীকৃতিও কম পায়নি সংস্থাটি। এ পর্যন্ত তারা ২২টি দেশি ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। বিশ্বের ধান গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় সংস্থাটি আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) থেকে তিনবার সেরা প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার পেয়েছে। স্বাধীনতা পদক পেয়েছে তিনবার।

ইফতেখার মাহমুদ প্রথম আলোর সাংবাদিক