Thank you for trying Sticky AMP!!

জীবনের সূচনা, রাজনীতির অভিমুখে

কিশোর বয়সে শেখ মুজিব। ফুটবল ছিল তাঁর প্রিয় খেলা। ১৯৪০

বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৭ মার্চ ১৯২০ সালে তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন টুঙ্গিপাড়া, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জে।

তাঁর বাল্যকাল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘ছোট সময়ে আমি খুব দুষ্ট প্রকৃতির ছিলাম। খেলাধুলা করতাম, গান গাইতাম এবং খুব ভালো ব্রতচারী করতে পারতাম।’ কিন্তু ১৯৩৪ সালে যখন তিনি সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন, তখন বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তাঁর পিতা তাঁকে কলকাতায় নিয়ে চিকিৎসা করান। তাঁর চিকিৎসক ছিলেন ডা. শিবপদ ভট্টাচার্য, ডা. এ কে রায় চৌধুরী প্রমুখ। ১৯৩৬ সালে তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান মাদারীপুর মহকুমায় সেরেস্তাদার পদে বদলি হন। তিনি তাঁর পুত্র মুজিবকে তাঁর নতুন কর্মস্থলে নিয়ে এসে স্কুলে ভর্তি করেন। তখনো মুজিব অসুস্থ থাকায় তাঁর মাকে মাদারীপুরে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু ১৯৩৬ সালে কিশোর মুজিবের চোখে গ্লুকোমা ধরা পড়ায় তাঁকে দ্বিতীয়বার চিকিৎসার জন্য কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। তখন সেখানকার বিখ্যাত চক্ষু চিকিৎসক ডা. টি আহমেদ তাঁর চক্ষু পরীক্ষা করে বলেন, ‘অবিলম্বে তার দুই চোখেরই অপারেশন করতে হবে, না হলে অন্ধ হয়ে যেতে পারে।’ অপারেশনের কথা শুনে মুজিব পালাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। তাঁকে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয় এবং ১০ দিনের মধ্যে দুই চোখেই অপারেশন করা হয়। সফল অপারেশনের পর তাঁকে চশমা দেওয়া হয়। তাই সেই ১৯৩৬ সাল থেকে তিনি চশমা পরেন।

কলকাতায় চোখের চিকিৎসার পর শেখ মুজিব ফিরে এলেন মাদারীপুরে। তিনি বাল্যকাল থেকেই রাজনীতিমনস্ক। তাঁর পিতা বাড়িতে সংবাদপত্র এবং সাহিত্য পত্রিকা রাখতেন। এই সব পত্রপত্রিকার মধ্যে ছিল কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, বসুমতী, আজাদ এবং মাসিক সওগাতমোহাম্মদী। রাজনীতিতে তাঁর আগ্রহ গড়ে ওঠে সংবাদপত্র পাঠে। এই রাজনীতি অনুরাগ প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয় তৎকালীন বাংলার ইংরেজ উপনিবেশবিরোধী রাজনীতির অনুষঙ্গে। তখন স্বদেশি আন্দোলনের চাপা উত্তেজনা মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের ঘরে ঘরে। মাদারীপুরে অধ্যক্ষ পূর্ণচন্দ্র দাস ছিলেন তখন ইংরেজের মূর্তিমান আতঙ্ক। তাঁকে ইংরেজ সরকার কারারুদ্ধ করেছিল। তাঁর কারামুক্তি উপলক্ষে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লেখেন ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ শীর্ষক কবিতা। কবির ভাঙ্গার গান কাব্যগ্রন্থের সেই কবিতার পঙ্‌ক্তিতে আছে, ‘জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র...স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারীপুরের মর্দবীর।’

তরুণ শেখ মুজিব বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বীজমন্ত্র ‘জয় বাংলাতো কিশোরকালেই নজরুলের ওই কবিতায় পেয়ে গিয়ে বুকের গভীরে লালন করেছিলেন। আর তাকেই পাকিস্তানি হানাদারদের বাংলা ছাড়ানোর জীবনপণ মুক্তিযুদ্ধে শত–সহস্র বজ্রের শক্তিতে ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করলেন তিনি মুক্তিকামী বাঙালিকে। মূলত ১৯৩৬ সালে মাদারীপুরে স্বদেশি আন্দোলনকারী এবং ভারতের মহান স্বাধীনতাসংগ্রামী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সমর্থকদের সংসর্গেই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত। বঙ্গবন্ধু এ বিষয়ে তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আমি সুভাষবাবুর ভক্ত হতে শুরু করলাম। [তাদের] সভায় যোগদান করতে মাঝে মাঝে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর যাওয়া-আসা করতাম।’

 দুই

১৯৩৮ সালে বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক, শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং সমবায়মন্ত্রী মুকুন্দবিহারী মল্লিক গোপালগঞ্জ সফরে আসেন। তাঁদের সংবর্ধনায় তরুণ স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। মূল সংবর্ধনা সভা ও প্রদর্শনী উদ্বোধন শেষে হক সাহেব গোপালগঞ্জ পাবলিক হল দেখতে যান, শহীদ সাহেব আসেন মিশন স্কুল পরিদর্শনে। মুজিব তখন ওই স্কুলের ছাত্র। শহীদ সাহেবকে স্কুলে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তিনি সংবর্ধনা সভায় মুজিবের একনিষ্ঠ কর্মতৎপরতা লক্ষ করে স্কুল পরিদর্শন থেকে ফিরে যাবার সময় তাঁকে কাছে ডেকে নিয়ে আদর করেন এবং নাম–পরিচয় জিজ্ঞেস করে নোটবুকে লিখে নেন; এবং গোপালগঞ্জে মুসলিম লীগ এবং মুসলিম ছাত্রলীগ করা হয়েছে কি না জানতে চান।

এ কে ফজলুল হক ও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গোপালগঞ্জ আগমন হিন্দু প্রধান শহরবাসী ভালো চোখে দেখেনি এবং কংগ্রেস দলের নির্দেশে এতে তারা সাড়া দেয়নি। এ নিয়ে ওই ১৯৩৮ সালেই স্থানীয় হিন্দু মহাসভার সঙ্গে এক সাংঘর্ষিক ঘটনায় তরুণ মুজিব সাত দিনের জন্য কারাবরণ করেন। গ্রেপ্তার এড়াতে তাঁকে পালানোর পরামর্শ দেওয়া হলে তিনি রাজি হননি। আজীবন এটাই ছিল তাঁর স্বভাব। পৃষ্ঠপ্রদর্শন-প্রবণতা তাঁর রক্তধারায় ছিল না।

বিস্ময়কর ব্যাপার, গোপালগঞ্জে সভা করে কলকাতায় ফিরে যাবার কিছুদিন পরেই সোহরাওয়ার্দী সাহেব পত্র লিখে গোপালগঞ্জের সভা ও প্রদর্শনী আয়োজন এবং ব্যবস্থাপনায় একাগ্র শ্রমনিষ্ঠা ও চমৎকার নেতৃত্বের জন্য শেখ মুজিবকে ধন্যবাদ জানান এবং কলকাতা গেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। সেই সূত্র ধরে ১৯৩৯ সালে কলকাতা বেড়াতে গিয়ে তরুণ মুজিব তাঁর সঙ্গে দেখা করেন এবং ধীরে ধীরে সোহরাওয়ার্দী তাঁর রাজনৈতিক গুরু হয়ে ওঠেন। সেই সফরে তিনি নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সভাপতি ও তখনকার বিখ্যাত ছাত্রনেতা আবদুল ওয়াসেকের সঙ্গে আলাপ করে তাঁকেও গোপালগঞ্জে আসতে অনুরোধ করেন। মুজিব শহীদ সাহেবকে বলেন, ‘গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ এবং মুসলিম লীগ দুই–ই গঠন করা হবে।’ যে কথা সেই কাজ। গোপালগঞ্জে ফিরেই তিন এমএলএ ও মুসলিম লীগ সদস্য খন্দকার শামসুদ্দীনকে সভাপতি করে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের ফরিদপুর শাখা গঠন করেন এবং মুসলিম লীগও গঠন করা হয়। মুজিব ছাত্রলীগের সম্পাদক এবং মুসলিম লীগের ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। এভাবেই তাঁর প্রত্যক্ষ দলীয় রাজনীতির সূত্রপাত। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি এ বিষয়ে লিখেছেন, ‘আমি আস্তে আস্তে রাজনীতির মধ্যে প্রবেশ করলাম। আব্বা আমাকে বাধা দিতেন না, শুধু বলতেন, “লেখাপড়ার দিকে নজর দেবে।” লেখাপড়ায় আমার একটু আগ্রহও তখন হয়েছে...স্কুলেও আমি ক্যাপ্টেন ছিলাম।...আমাদের হেডমাস্টার তখন ছিলেন বাবু বসন্তরঞ্জন সেনগুপ্ত। আমাকে তিনি প্রাইভেট পড়াতেন।’

এর কিছু আগে আরেকজন বিজ্ঞান শিক্ষক ও ব্রিটিশ উপনিবেশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামী সমাজসেবক তাঁকে প্রাইভেট পড়াতেন। তাঁদের বাড়িতেই থাকতেন তিনি। তাঁর নাম ছিল কাজী আবদুল হামিদ। এই দুই শিক্ষকের প্রভাবও তাঁর ওপর পড়েছিল।

>রাজনীতিতে নিমগ্ন এই তরুণ নেতা খেলাধুলা, সংস্কৃতিচর্চা এবং সামাজিক ও দুস্থ মানবতার সেবামূলক কর্মকাণ্ডে আগ্রহী ছিলেন। ১৯৪০ সালে শেখ মুজিবকে খেলাধুলায় বিশেষ ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। ভলিবল ও হকি খেলতেন, তবে ফুটবলে ছিল তাঁর প্রচুর আসক্তি। এ খেলায় বেশ পারদর্শিতা ও সাংগঠনিক উদ্দীপনা ছিল তাঁর।

রাজনীতিতে নিমগ্ন এই তরুণ নেতা খেলাধুলা, সংস্কৃতিচর্চা এবং সামাজিক ও দুস্থ মানবতার সেবামূলক কর্মকাণ্ডে আগ্রহী ছিলেন। ১৯৪০ সালে শেখ মুজিবকে খেলাধুলায় বিশেষ ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। ভলিবল ও হকি খেলতেন, তবে ফুটবলে ছিল তাঁর প্রচুর আসক্তি। এ খেলায় বেশ পারদর্শিতা ও সাংগঠনিক উদ্দীপনা ছিল তাঁর। শেখ মুজিব ও তাঁর পিতার দলের ফুটবল খেলার তীব্র প্রতিযোগিতা গোপালগঞ্জ শহরে তখন বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। পরবর্তীকালেও ফুটবল খেলায় তাঁর আকর্ষণ লক্ষ করা যায়। তবে রাজনীতিই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান এবং সার্বক্ষণিক চিন্তাচেতনার বিষয় হয়ে ওঠে।

 তিন

১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করে শেখ মুজিব ওই বছরই কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হন। সেই সুবাদে বেকার হোস্টেলে আবাসিক ছাত্র হবার সুযোগ মেলে। অল্প দিনেই তিনি কলেজে ও হোস্টেলে জনপ্রিয় ছাত্রনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। উল্লেখ্য যে রাজনীতি তাঁর সর্বক্ষণের চিন্তাচেতনার বিষয় হলেও রাজনীতির শক্তিশালী ভিত্তি নির্মাণে যে সংস্কৃতির সংযোগ অপরিহার্য, এ বিষয়টিও তিনি মাথায় রেখেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৪০ সালে তিনি স্বাধীনতাপূর্ব নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের ফরিদপুর জেলা সম্মেলনে শিক্ষাবিদ ও সংস্কৃতিজগতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানান। তাঁরা ছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক নেতা হুমায়ুন কবির এবং অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খাঁ। নজরুল এবং হুমায়ুন কবির সম্মেলনে যোগ দেন। মুসলিম লীগের বিরোধিতায় ইব্রাহীম খাঁ আসেননি। সেই ছাত্র সম্মেলনে নজরুল তাঁর উদ্দীপনাময় গানে ছাত্রদের করে তোলেন প্রবলভাবে আলোড়িত।

বঙ্গবন্ধু ছাত্রজীবনেই রাজনীতি ও সংস্কৃতির যে মেলবন্ধন ঘটান, আজীবন তা রক্ষা করেছেন। ফলে যৌবনকালে কবি জসীমউদ্‌দীন, শিল্পী জয়নুল আবেদিন এবং সরদার ফজলুল করিম, মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার প্রমুখ তুখোড় বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক ও শিল্পী হয়ে ওঠেন তাঁর বন্ধু; তেমনি পরবর্তীকালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, আবুল ফজল প্রমুখ মনীষী স্থান লাভ করেন তাঁর শ্রদ্ধেয়জনের আসন এবং শিক্ষা-সংস্কৃতি বিষয়ের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উপদেশক। শুধু নাগরিক সুধী-বুদ্ধিজীবীই নন, গ্রামীণ ও লোকশিল্পীদের সঙ্গেও তাঁর সখ্য ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ উষ্ণতায় অনন্য। আব্বাসউদ্দীন, আবদুল লতিফ, নির্মলেন্দু চৌধুরী, শাহ আবদুল করিম, মহিন শাহর সঙ্গে তাঁর সাংস্কৃতিক সংযোগ ছিল হার্দিক।

 চার

১৯৪২ সালে মুসলিম লীগের প্রধান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমায় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সম্মেলনে যোগদান করেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দীও এ সম্মেলনে এসেছিলেন। তরুণ ছাত্রনেতা ও দক্ষ সংগঠক শেখ মুজিব ফরিদপুর থেকে বিরাট দল নিয়ে যোগ দেন এই সম্মেলনে। ১৯৪৩ সালে বাংলায় নজিরবিহীন দুর্ভিক্ষ হয়। সে সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন বাংলা সরকারের সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নির্দেশে তখন কলকাতা শহরে বেশ কিছু লঙ্গরখানা খোলা হয়। মুজিব ওই বছরই প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। পার্টির নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে তিনি বাঙালি জীবনের এই ভয়াবহ দুর্দিনে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের মধ্যে রাত–দিন রিলিফের কাজ করেন।

শেখ মুজিবের উদ্যোগে গোপালগঞ্জে ১৯৪৩ সালে দক্ষিণ বাংলা পাকিস্তান কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়। তিনি ছিলেন অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি। এর কিছু পরেই কুষ্টিয়ায় অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গ মুসলিম লীগ সম্মেলনেও তাঁর অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য কর্মতৎপরতায় উজ্জ্বল। তরুণ বয়সে মুসলিম লীগের কর্মকা‌ণ্ডে তাঁর এই উদ্দীপনাময় অংশগ্রহণের মূলে ছিল এই ধারণা যে ১৯৪০ সালের মূল লাহোর প্রস্তাবের মর্মানুযায়ী দুটো (স্টেটস) পাকিস্তান হবে; একটা বাংলা ও আসাম নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান (স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র); এবং পশ্চিম পাকিস্তান—পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধুকে নিয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। লাহোর প্রস্তাবের প্রস্তাবক শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক সেই মর্মেই প্রস্তাবটি উপস্থাপন করেন। কিন্তু জিন্নাহ শঠতা ও কূটকৌশল করে অবাস্তব ও ভৌগোলিকভাবে অসম্ভব এক পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে স্টেটস শব্দের ‘এস’কে কেরানির ভুল বলে বোম্বে কনফারেন্সে বাদ দিয়ে স্টেট পাস করিয়ে নেন। এ বিষয়ে সোহরাওয়ার্দী, বিশেষ করে আবুল হাশিমের প্রতিবাদ গ্রাহ্য করা হয় না।

১৯৪৩ সালের ৭ নভেম্বর আবুল হাশিম বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সংগঠনটি তখন দুই ধারায় বিভক্ত ছিল, একটি প্রগতিশীল ধারা—তার নেতৃত্বে ছিলেন সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম; আর রক্ষণশীল ধারায় ছিলেন ঢাকার নবাব পরিবার তথা খাজা নাজিমুদ্দীন, ইস্পাহানিরা, মওলানা আকরম খাঁ ও দৈনিক আজাদ পত্রিকা। আবুল হাশিম বাংলার নবাব-নাইট-জমিদার ও রক্ষণশীল রাজনীতিকদের কবজা থেকে মুক্ত করে মুসলিম লীগের মাধ্যমে এক নবযুগ সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করেন। শেখ মুজিব এই প্রগতিশীল ধারার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। হাশিম সাহেব ১৯৪৫ সালে আধুনিক ও গণতান্ত্রিক চেতনার অধিকারী তরুণদের মধ্যে সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি সম্পর্কে গভীরতর ধ্যান-ধারণা সৃষ্টি করার লক্ষে লীগ অফিসে একটি স্টাডি সার্কেল গঠন করেন। এই স্টাডি সার্কেলে পাকিস্তান সৃষ্টির ব্যাখ্যায় তাঁর মৌলবোধ ও প্রত্যয় যুক্তিতর্কসহ ব্যক্ত করেন এই ভাষায়, ‘পাকিস্তান হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়, হিন্দু-মুসলমানের মিলনের জন্য এবং দুই ভাই যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সুখে বাস করতে পারে, তারই জন্য। শুধু হিন্দুদের গালাগাল করলে পাকিস্তান আসবে না।...মুসলিম লীগকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে। গ্রাম থেকে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।...জমিদারদের পকেট থেকে প্রতিষ্ঠানকে বের করতে হবে।’

সচিবালয়ের ১ নম্বর গেটে ছাত্রদের অবস্থান ধর্মঘটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ মুজিব (x চিহ্নিত)। ১১ মার্চ, ১৯৪৮

বঙ্গবন্ধু এ সম্পর্কে তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেছেন: ‘তিনি আমাদের কিছুসংখ্যক কর্মীকে বেছে নিয়েছিলেন। তাদের নিয়ে রাতে আলোচনা সভা করতেন মুসলিম লীগ অফিসে। হাশিম সাহেব আমাদের বললেন, একটা লাইব্রেরি করতে হবে ও তোমাদের লেখাপড়া করতে হবে।’

আবুল হাশিমের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ অফিস যেমন প্রগতিশীল মুসলিম রাজনীতির মূল কেন্দ্র ছিল, তেমনি ইসলামিয়া কলেজ ছিল তরুণ ছাত্রদের রাজনীতিচর্চা কেন্দ্র। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিব বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ইসলামিয়া কলেজের জনপ্রিয় ছাত্রনেতা এবং ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ইসলামিয়া কলেজর স্নাতকও বটে।

সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম সাহেবদের পক্ষে কোনো পত্রপত্রিকার জোরালো সমর্থন ছিল না। এই সমস্যা দূর করার জন্যে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের অর্থানুকূল্যে ছাপাখানা স্থাপন করে মিল্লাত নামে একটি সাপ্তাহিক কাগজ বের করা হলো। হাশিম সাহেব হলেন সম্পাদক। কাজি মুহম্মদ ইদরিস প্রমুখ সাংবাদিককে যুক্ত করা হলো পত্রিকায়। এই পত্রিকাটি প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য হিন্দু-মুসলমান দুইয়েরই প্রশংসা পায়। শেখ মুজিবসহ তরুণেরা এ পত্রিকা রাস্তায় রাস্তায় হকার হিসেবে বিক্রি করতেন।

 পাঁচ

শেখ সাহেবের মানস-গঠন ও রাজনৈতিক চিন্তাধারার বিকাশে এই সব বিষয়ের সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে। মাদারীপুরে স্বদেশী আন্দোলনকারী এবং তাঁদের নেতা অধ্যক্ষ পূর্ণচন্দ্র দাসের মুক্তিতে নজরুলের কবিতা ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ এবং তাতে ‘জয়বাংলার’ উল্লেখ ও নেতাজি সুভাষ বসুর দলের সঙ্গে সংযোগ, ইংরেজ ঔপনিবেশিক আমলে তাঁদের পরিবারের সঙ্গে ওই বিদেশি শাসকদের বৈরিতার ইতিহাস শোনার প্রতিক্রিয়াজনিত সং‌ক্ষোভ, বাল্যকালে বাড়িতে রাখা বিখ্যাত দৈনিক, মাসিক পত্রিকা পাঠ, কবি নজরুল, হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে সম্পর্ক, আবুল হাশেমের প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও তাঁর সাপ্তাহিক মিল্লাত পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা তাঁর প্রগতিশীল রাজনৈতিক মানস গঠনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

১৯৩৯-৪৩ তাঁর জীবনের এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রকৃত প্রস্তাবে মনোজগতে মাদারীপুরের যে বিপ্লবী রাজনৈতিক চেতনার ছাপ নিয়ে তিনি কলকাতায় আসেন, সেখানে একই সঙ্গে তিনটি কিছুটা পরস্পরবিরোধী ধারাকেও তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবন গঠনে সমন্বিত করতে সক্ষম হন। এই ধারাগুলো ছিল: এক. সোহরাওয়ার্দীর আধুনিক পাশ্চাত্য রাজনীতির পরিশীলিত নিয়মতান্ত্রিক ধারা; এর সঙ্গে শরৎ বসু, সোহরাওয়ার্দী, কিরণশঙ্কর রায় এবং আবুল হাশিমের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদভিত্তিক যুক্ত বাংলা আন্দোলনের ধারা; দুই. নেতাজি সুভাষ বসু ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের রাজনীতির প্রতি গভীর আকর্ষণ; এবং তিন. রাজনীতি ও সংস্কৃতির সমন্বয়ের ক্ষেত্রে নজরুল, আবুল হাশিম ও হুমায়ুন কবিরের প্রভাব।

 শামসুজ্জামান খান: গবেষক ও বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গত বছর ‘ঐ মহামানব আসে’ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছিল প্রথম আলো। ক্রোড়পত্রের সেই লেখাগুলো পাঠকের সামনে তুলে ধরা হলো।