Thank you for trying Sticky AMP!!

দেশে-বিদেশে নজর কেড়েছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়

>

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শিবরাম প্রাথমিক বিদ্যালয় শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষায় নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। তাদের শিক্ষা পদ্ধতি প্রশংসিত হয় দেশে–বিদেশে। ​এই ইতিবাচক প্রতিবেদনটি উঠে আসে ২০০৪ সালের ২৩ জানুয়ারির প্রথম আলোয়। 

.

দেশের সর্বত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যে জীর্ণরূপ ও মলিন ভাবমূর্তি, তাতে কোনো একটি বিদ্যালয় কি হঠাত্ কোনো অঘটন ছাড়া সংবাদপত্রের প্রধান শিরোনামের খবর হতে পারে? প্রথম আলো এমন খবরের জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্বাচন করেছে। সেটা গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় শিবরাম গ্রামে অবস্থিত ‘শিবরাম আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’।
কোনো অঘটন ঘটিয়ে নয়, স্থায়ীভাবে স্কুলটির পরিপাটি পরিবেশ, সুশৃঙ্খল পরিচালন, শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় শিক্ষণপদ্ধতি ও শিক্ষা-উপকরণের সমাবেশ, শিক্ষার মান, পাঠক্রমের অতিরিক্ত প্রতিভা বিকাশের অনুকূল সাংস্কৃতিক-সামাজিক কার্যক্রম ইত্যাদির জন্য শুধু জাতীয় পুরস্কারই পায়নি, স্কুলটি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থারও নজর কেড়েছে। দেশে এই মুহূর্তে ৩৭ হাজার ৬৭৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে শিবরাম বিদ্যালয় নানা দিক থেকে ব্যতিক্রমী।
বিদ্যোত্সাহী ব্যক্তিবর্গ এই বিদ্যালয়ে অবকাঠামো সম্প্রসারণে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। ছাত্র-শিক্ষকরা স্কুলকেন্দ্রিক সমবায়ী কার্যক্রমের মাধ্যমে স্কুলের জন্য আয় করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়েও এর আছে ছাত্রাবাস এবং সুনামের জন্য অন্য জেলার ছাত্ররাও এখানে পড়তে এসেছে।

প্রাথমিক শিক্ষায় অনন্য দৃষ্টান্ত রাখার স্বীকৃতি হিসেবে এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক নূরুল আলম ১৯৮৫ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে ইউনিসেফ স্কুলটিকে শ্রেষ্ঠ স্কুল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৯৬ সালে স্কুলটিও জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। ২০০০ সালে জাতীয় পদক লাভ করে স্কুলটির ম্যানেজিং কমিটি। স্কুলটির ছাত্রছাত্রীদের সমবায় সমিতিও বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে।

১৯৯০ সালে এ স্কুলটি নিয়ে ইউনিসেফ ‘আওয়ার স্কুল’ নামে এর পরিচিতি ছাপিয়ে প্রকাশ করে। এটি দেশের বিভিন্ন স্কুলে পাঠানোর পর বিভিন্ন এলাকা থেকে অভিভাবকরা এই স্কুলে যোগাযোগ করতে থাকেন। স্কুলটির সাফল্যগাথা এক সময়ে পৌঁছে যায় সীমান্ত পেরিয়ে বহির্বিশ্বেও। ইতিমধ্যে চীন, ফ্রান্স, পাকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশের অসংখ্য প্রতিনিধি স্কুলটি পরিদর্শন করেছেন। গত বছরের ৩ জুলাই বিশ্বব্যাংকের তত্কালীন আবাসিক পরিচালক ফ্রেডরিক টি টেম্পল স্কুলটি পরিদর্শন করেন। ওই বছর ১৭ আগস্ট ইন্দোনেশিয়া থেকে আসেন মজিদ ক্যাবন জাকাতা। একই বছর জাপানের শিক্ষা বিশেষজ্ঞ তুশিমা পরিদর্শন বইয়ে মন্তব্য লেখেন, ‘বাংলাদেশে এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেখে আমি অভিভূত।’

গোড়ার কথা : রংপুর থেকে পীরগাছার চৌধুরানী হয়ে কিছুদূর এগোলেই বামনডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন। এর পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে গাইবান্ধার বামনডাঙ্গা-সুন্দরগঞ্জ সড়কের ছাইতানতলার ডানদিকে শিবরাম গ্রাম। গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে তত্কালীন জমিদার সুনীতিবালা দেবী এখানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামের নামেই এর নাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে আরো অনেক স্কুলের সঙ্গে শিবরাম স্কুলও সরকারি হয়।

১৯৮৪ সালে এই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন নূরুল আলম নামে এক স্বপ্নদর্শী, সৃজনশীল যুবক। আত্মবিশ্বাসে টগবগে এই যুবকের চেষ্টায় স্কুলটি নতুনরূপে হয় ‘শিবরাম আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। তার মেধা ও শ্রম এবং কিছু উদ্ভাবিত, কিছু অনুসৃত বিভিন্ন আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষণপদ্ধতির প্রয়োগে একটি মামুলি প্রাথমিক স্কুল রূপান্তরিত হয়ে সাফল্যের উচ্চ শিখরে উঠেছে।

স্কুল যেমন : সম্প্রতি একদিন বেলা সাড়ে ১১টায় গিয়ে দেখা গেল শত শত শিশুর পাঠাভ্যাসে মুখরিত স্কুল চত্বর। মাঠে ছোট ছোট দলে ছাত্রছাত্রীদের বসিয়ে গ্রুপভিত্তিক পাঠদান চলছে। শিক্ষক কঙ্কন কুমার সরকার ও শফিকুল ইসলাম বললেন, শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য পাঠ্যবইয়ের বাইরেও জ্ঞানচর্চার নানা রকম ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পাঠাগারে হাজার চারেক বই আছে; শিশু সাময়িকী ও জাতীয় পত্রিকাও রাখা হয়। বিভিন্ন কক্ষে নানা শিক্ষণীয় বিষয় শিশুদের উপযোগী করে সাজানো হয়েছে।

একটি ঘরে নদ-নদী, আগ্ন্নেয়গিরি, জলপ্রপাত, বন, মরুভূমি, শহর, বন্দর, গ্রামের প্রতিকৃতি থরে থরে সাজানো। আলোছায়ার ব্যবহারে এগুলোর বাস্তব পরিবেশ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অনেকখানি। স্কুলের সব ছাত্রছাত্রীর প্রিয় এই কক্ষটির নাম ‘ভৌগোলিক’। পাশের ‘উপকরণ কক্ষে’ আছে বাঘ, ভল্লুক, হরিণ, পাখি, গাড়ি-ঘোড়াসহ বিভিন্ন প্রাণীর মডেল ও নানা ধরনের খেলনা। এ রকম মডেল উপকরণের সংখ্যা ১ হাজার। আছে ১০টি গ্লোব ও ৩০টি মানচিত্র। আছে দেশ-বিদেশের বরেণ্য কবি-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী-রাষ্ট্রনেতা প্রমুখের ছবি। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরত্চন্দ্র বা সুকুমার সেনকে শিশুরা চিনে নিচ্ছে এখান থেকেই। সভা, ইনডোর খেলা, চিত্রাঙ্কন, সঙ্গীত শিক্ষা, চিকিত্সা এবং নামাজ পড়ার জন্যও রয়েছে পৃথক পৃথক ঘর।

সহকারী শিক্ষক কামরুন্নাহার বেগম বলেন, একঘেয়েমি কাটানোর জন্য প্রতিদিন ক্লাসের ফাঁকে শিক্ষার্থীদের একবার এসব কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। ছবি ও মডেল দেখিয়ে, গল্প বলে শিশুদের নানা বিষয়ে ধারণা দেওয়া হয়। শিশুরা ভীষণ মজা পায়।

তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র শহিদুল ও পঞ্চম শ্রেণীর দুলাল জানায়, দিনে একবার এসব কক্ষে তাদের আসতে হয়। আর কক্ষগুলো সবারই খুব প্রিয়।

স্কুলে আছে সরকারি উদ্যোগে তৈরি একটি দোতলা পাকা ভবন। এ ছাড়া স্থানীয় উদ্যোগে নয়টি আধাপাকা ভবন, একটি ইটের ঘর ও একটি টিনশেড ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের এবং অফিসকক্ষ পৃথক।

প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত স্কুলের শ্রেণীকক্ষ ২০টি। স্কুলের আছে মোট ২৫টি টয়লেট, দুটি স্টোর রুম, একটি কাপড় ইস্ত্রি করার কক্ষ, তিনটি পানির পাম্প ও পাঁচটি নলকূপ। বিদ্যুত্ না থাকলে স্কুলের নিজস্ব জেনারেটর চলে।

আকর্ষণীয় শিক্ষণ পদ্ধতি : শ্রেণীকক্ষ ও ছাত্রাবাস কক্ষের পৃথক নামকরণ করে শিক্ষার্থীদের সামনে মেলে ধরা হয়েছে শব্দচয়নের দৃষ্টান্ত। ‘গানে গানে’, ‘পাতায় পাতায়’, ‘দীপের আলোক’, ‘ঊর্মিমালা’, ‘নয়নের নীর’, ‘মমতার মিলন’— প্রভৃতি একেকটি শ্রেণীর নামকরণ।

ছাত্রাবাসটির নাম ‘দীপশিখা’। আলাদা নামকরণ হয়েছে এর বিভিন্ন কক্ষের, যেমন ‘প্রতিভা’, ‘বিকাশ’, ‘পল্লবী’, ‘উল্কা’, ‘মোহনা’, ‘মনোরমা’— আরো কত কী নাম!

শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার ঢালিকান্দি গ্রামের ব্যবসায়ী জহুরুল হকের ছেলে দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র আনোয়ারুল ইসলাম ও কুড়িগ্রামের উলিপুরের জাহের আলীর ছেলে চতুর্থ শ্রেণীর রেজাউল করিম বলে, ‘এখানে আমাদের কোনো অসুবিধা হয় না। আপা ও স্যাররা সঙ্গে থাকেন। পড়াশোনা, খেলাধুলার মধ্য দিয়ে আনন্দে দিন কেটে যায়।’

আবাসিক ছাত্রদের জন্য রয়েছে একটি ডাইনিং রুম। প্রতিটি টেবিলে চারটি করে চেয়ার। ছাত্রাবাস পরিচালক রাশেদুল ইসলাম জানান, পর্যায়ক্রমে ১০ জন শিক্ষক শিশুদের সঙ্গে ছাত্রাবাসেই থাকেন। তারা খাবারও খান শিশুদের সঙ্গে।

মেধাবী, সাধারণ ও দুর্বল তথা সব মানের শিক্ষার্থীদেরই স্কুলটিতে ভর্তির সুযোগ রয়েছে। দুর্বল ও সাধারণ শিক্ষার্থীরাও যাতে সমান শিক্ষা লাভ করতে পারে সেজন্য কয়েকটি শ্রেণীকক্ষ বিশেষভাবে সাজানো হয়েছে। যেমন দুর্বল ছাত্রদের সঙ্গে এক বা দুজন ভালো ছাত্র নিয়ে চারজন ছাত্রের একটি গ্রুপ করা হয়। ভালো ছাত্রটি শিক্ষকের মতোই তার সহপাঠীদের পাঠদান করে থাকে। সবলদের সহযোগিতায় দুর্বল ছাত্ররাও এগিয়ে যায়।

শিক্ষক ক্লাসে যদি বুঝতে পারেন অনেক শিক্ষার্থী পড়া বুঝতে পারছে না, তাহলে তিনি বিষয়টি ম্যানেজিং কমিটিকে জানান। তারপর শিক্ষক-পরিচালক মিলে একটি সমাধান বের করে সেইভাবে ছাত্রদের পড়ানোর ব্যবস্থা করেন। একে বলা হয় ‘সমন্বয় পদ্ধতি’।

সপ্তাহে একদিন বসে বৈঠকি আসর। শিশুরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে মাঠে মাদুরে বসে, পাঠ্যপুস্তকের বিভিন্ন বিষয় আড্ডার ছলে আলোচনা হয়। কবিতাগুলো গানের সুরে কিংবা অভিনয়ের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়, যেন কঠিন বিষয়গুলোতেও তারা আনন্দ পায়।

যেসব শিক্ষার্থী পড়ালেখায় অমনোযোগী তাদের জন্য রয়েছে আরেকটি পদ্ধতি। যেমন শিশুটি যা করতে ভালোবাসে তার মাধ্যমেই পাঠ্যবিষয়টিকে আত্মস্থ করানো হয়। এভাবে শিশুটি একসময় স্বাভাবিক পড়ালেখায় অভ্যস্ত হয়ে উঠে। একে বলা হয় ‘আদর্শ পদ্ধতি’।

শিশুদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে তিন মাস পরপর ‘দীপশিখা’ নামের একটি দেয়ালপত্রিকা প্রকাশ করা হয়। এতে শিক্ষার্থীদের লেখা গল্প-কবিতা-কার্টুন-ছবি স্থান পায়। মাঝে মাঝে বিশেষ সংকলনও প্রকাশ করা হয়। বিশিষ্ট লেখকদের গল্প, উপন্যাস, ছড়া, জীবনী, শিক্ষামূলক বই পাঠাগারে পড়ার সুযোগ রয়েছে।

কোমলমতি শিশুরা যাতে প্রকৃতির সাহচর্যে বেড়ে উঠতে পারে, সেজন্য ৮০০টি ফলজ, কাঠ ও ঔষধি গাছ লাগানো হয়েছে। স্কুলটির প্রশাসনিক ভবনের সামনে রয়েছে একটি ফুলের বাগান।

কত ছাত্রছাত্রী? : শিবরাম গ্রামের ছয় বছরের ওপরে শিশুদের স্কুলে ভর্তির হার শতকরা ৯৯ ভাগ। শিবরাম আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোট ৭২৫ জন ছাত্রছাত্রীর বেশির ভাগই ওই গ্রাম ও আশপাশের কয়েকটি গ্রামের। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ছাত্র ১৭৭ জন। এরা থাকে ছাত্রাবাসে। মোট শিক্ষার্থীর ৪৬৪ জন ছাত্র, বাকিরা ছাত্রী। ছাত্রাবাসে শুধু ছাত্ররাই থাকার সুযোগ পায়। শিক্ষার্থী প্রথম শ্রেণীতে ১১৫, দ্বিতীয় শ্রেণীতে ১২২, তৃতীয় শ্রেণীতে ১৫৭, চতুর্থ শ্রেণীতে ১৭৬ ও পঞ্চম শ্রেণীতে ১৫৫ জন। এ ছাড়া শিশু শ্রেণীতে ১০১ জন শিক্ষার্থী আছে।

২০০২ সালে বিদ্যালয়টির আটজন ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। চলতি বছর বৃত্তি দিয়েছে ৩৭ জন। এই স্কুল থেকে বেরোনো ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই ক্যাডেটসহ দেশের নামীদামি বিদ্যালয়ে অনায়াসে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়।

স্কুলে সরকার অনুমোদিত ১১ জন শিক্ষকের সঙ্গে ৫০ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা বেসরকারিভাবে কর্মরত আছেন। কর্মচারী ২৩ জন। এ জন্য প্রতি মাসে বাড়তি ব্যয় লক্ষাধিক টাকা। আবাসিক ছাত্রদের মাসিক ফি ১ হাজার ৮০০ টাকা করে। এ অর্থ এবং বিভিন্ন উপার্জনমুখী প্রকল্পের আয় থেকে বেসরকারিভাবে নিয়োগকৃত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা জোগাড় হয়ে থাকে। একজন বেসরকারি শিক্ষক ১৬০০ টাকা থেকে ২২০০ টাকা পর্যন্ত বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন। কর্মচারীরা বেতন-ভাতা পান ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা।

ব্যবস্থাপনা : বিদ্যালয়ের সার্বিক কর্মপরিকল্পনা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা ও সাফল্যের ধারাকে আরো এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির পাশাপাশি শিক্ষক-অভিভাবক সমিতি, উপদেষ্টা পরিষদ, ছাত্রাবাস ব্যবস্থাপনা পরিষদ, নিরীক্ষা পরিষদ, কল্যাণ সমিতি ও সমবায় সমিতি পরিচালনা কমিটি রয়েছে। কমিটিগুলো বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।

বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আলহাজ আবদুল জলিল আকন্দ জানান, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অভিভাবকরা তাদের ছেলেমেয়েদের এই স্কুলে ভর্তি করছেন। এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে বাইরে থেকে আরো অনেক ছাত্র আসত।

কমিটির সভাপতি আরো বলেন, এই স্কুলটি নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে ও ব্যবস্থাপনা কমিটিতে কোনো রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত নেই।

প্রধান শিক্ষক : স্কুলের প্রধান শিক্ষক নূরুল আলমের জন্ম (৫৩) গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার রামজীবন গ্রামে। তারা বাবাও ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। দারিদ্র্যের কারণে নূরুল আলম উচ্চবিদ্যালয়ে পড়েছেন অন্যের বাড়িতে জায়গির থেকে। মেধাবী নূরুল আলম ছেলেবেলায়ই সৃজনশীল ছিলেন। গান, কবিতা কিংবা নাটক লিখে লোকজনের মধ্যে বিলি করেছেন। ছেলেবেলা থেকেই নতুন কিছু করার চিন্তা তাকে তাড়া করত। দেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি অংশগ্রহণ করেন।

দারিদ্র্যের কারণে এসএসসি দ্বিতীয় বিভাগে পাস করার পর তার আর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সুযোগ হয়নি। যোগ্যতাবলে মাত্র সাত বছরের মাথায় ১৯৮০ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি পান তিনি। পদোন্নতি লাভের পরই নূরুল আলমের কর্মস্পৃহা যেন বহুগুণে বেড়ে যায়। অবশেষে শিবরাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি তার স্বপ্ন ও মেধার সবটুকু ঢেলে দেন।

তবে নূরুল আলম মনে করেন, যোগ্য ব্যবস্থাপনা কমিটি, দাতা ও শিক্ষানুরাগীসহ এলাকার সর্বস্তরের মানুষের আন্তরিক সহযোগিতার ফল আজকের এই শিবরাম আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। তার স্কুলের কিছু সমস্যার কথাও নূরুল আলম প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শিক্ষার্থী অনুপাতে আরো ভবন প্রয়োজন। এ ছাড়া যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার, পাঠাগারের বই সংকট রয়েছে। পুরাতন ভবনের মেঝেও জরুরিভিত্তিতে পাকা করা দরকার।

বইয়ের বাইরে : শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবিষয়ের বাইরেও পারিবারিক ও সামাজিক নানা বিষয়ে সচেতন করে তোলা হয়। এর মধ্যে আছে পানি বিশুদ্ধকরণ, খাবার স্যালাইন তৈরি, বাড়িতে স্যানিটেশন ব্যবস্থা, পাঁচটি ব্যাধি থেকে রক্ষায় শিশুদের টিকা গ্রহণ, র্যালির মাধ্যমে এলাকাবাসীকে উদ্বুদ্ধকরণ প্রভৃতি। ১৫ দিন পরপর শিক্ষার্থীরা শিবরামসহ পার্শ্ববর্তী বৈদ্যনাথ ও ফতেখাঁ গ্রামে র্যালি করে নানা বিষয়ে গ্রামবাসীকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করে থাকে। তারা গ্রামে গ্রামে স্যানিটেশন ও খাবার স্যালাইনের উপকারিতা নিয়ে নাটকও করে।

শিক্ষার্থীদের নানা রকম উপার্জনমুখী কর্মকাণ্ডেও সম্পৃক্ত করা হয়ে থাকে। দুস্থ ও গরিব ছাত্রছাত্রীদের কল্যাণে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে একটি সমবায় সমিতি। সমিতির বর্তমান তহবিল ১ লাখ টাকা। এ ছাড়া রেশম চাষ, মত্স্য চাষ, সেলাই প্রশিক্ষণ, বৃক্ষরোপণ, হাঁস-মুরগির খামার, গাভী পালন, সমবায় সমিতিসহ বিভিন্ন প্রকল্পও গড়ে তোলা হয়েছে। আবাসিক ছাত্ররা নিজেদের সমবায় দোকান থেকে বই-খাতা, কলম-পেন্সিল, সাবানসহ প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে থাকে।

নিজস্ব ১ একর ১৩ শতাংশ জমিতে স্কুল ভবন ও মাঠ করা হয়েছে। তাই ম্যানেজিং কমিটি গ্রামের রাস্তার পাশে উপার্জনমুখী প্রকল্পগুলো গড়ে তোলার সুযোগ করে দিয়েছে। স্থানীয় অভিভাবকদেরও প্রকল্পগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। বিনিময়ে তারা সামান্য কিছু সম্মানী পেয়ে থাকেন। তিন একর আয়তনের একটি পুকুর লিজ নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় একটি মসজিদ ও মাদ্রাসা কমিটি এটি পরিচালনা করে থাকে। সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে পাওয়া চারটি সেলাই মেশিন স্থানীয় কয়েকজন মহিলা ব্যবহার করে থাকেন। শিক্ষার্থীদের ১২টি গাভী রয়েছে। স্থানীয় অভিভাবকরাই এগুলো লালনপালন করে থাকেন। গাভীগুলোর দুধ বিক্রি করা হয়, দুধের একটি অংশ আবাসিক ছাত্ররা পেয়েও থাকে। পুকুরপাড়ে হাঁস-মুরগির একটি ছোট খামার করা হয়েছে। এসবের আয়ের ভাগ পেয়ে থাকে শিক্ষার্থীরাও।

আরও পড়ুন :