Thank you for trying Sticky AMP!!

স্বপ্ন পাড়ি দিয়েই আজকের বাংলাদেশ

’৯৯–এর িবশ্বকাপ খেলার সুেযাগ িদয়েছিল েয ট্রফি

একটা স্বপ্নপূরণ আরেকটা স্বপ্নের ছবি এঁকে দেয়। তখন ইচ্ছা হয় এই ছবিটাকেও বাস্তব করে তুলি। আমাদের ক্রিকেট ঠিক এভাবেই একটা একটা করে স্বপ্ন পাড়ি দিয়ে আজকের জায়গায় এসেছে। বাংলাদেশের ক্রিকেট আজ যে জায়গায়, ১৯৯৯-এর বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পেয়ে আমরা এই স্বপ্নটাই দেখেছিলাম। বাংলাদেশ একদিন বড় বড় দলের সঙ্গে খেলবে, ওদের হারাবে, সবাই বাংলাদেশকে ভয় পাবে।

১৯৯০ সালেও আমাদের সুযোগ তৈরি হয়েছিল বিশ্বকাপে যাওয়ার। আইসিসি ট্রফিতে একটি ম্যাচের ৪০-৫০ ভাগ সময়ই আমাদের জয়ের সম্ভাবনা ছিল। জিম্বাবুয়ে তখন খুব ভালো দল ছিল। ৬০-৭০ রানের মধ্যে ওদের ৪-৫ উইকেট পড়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেখান থেকে আমরা ম্যাচটা হেরে যাই। পরেরবার, অর্থাৎ ১৯৯৪ সালে আরও ভালো সুযোগ হলো। আইসিসি ট্রফি থেকে প্রথম তিনটি দল বিশ্বকাপ খেলবে। আমরা সেবার ফেবারিট ছিলাম। আমি তো বলব ১৯৯৭–এর চেয়ে ১৯৯৪-এর দলটাই বেশি ভালো ছিল। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক, কেনিয়ায় সেবার আমরা ভালো খেলতে পারিনি। ওই ব্যর্থতার খুব নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটে। অনেকে ভাবল, আমাদের ক্রিকেট বুঝি আর আগাবে না।

১৯৯৪ সালের ওই আইসিসি ট্রফির পর বছরের শেষ দিকে আমি জাতীয় দলের অধিনায়ক হই। আমার অধিনায়কত্বে বাংলাদেশ সার্ক টুর্নামেন্টে শ্রীলঙ্কা ও ভারতকে হারিয়ে ফাইনাল খেলে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ফাইনাল দেখতে ৪০ হাজারের মতো দর্শক এসেছিলেন। তা দেখে আমার মনে হয়েছিল, বাংলাদেশের ক্রিকেট মরে যায়নি। আমরা ভালো খেললে তাঁরা নিশ্চয়ই আমাদের এভাবেই সমর্থন দিয়ে যাবেন। তখন থেকেই নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু।

ওই সময় সুযোগ–সুবিধা এত ছিল না। ক্রিকেট বোর্ডেরও অত সামর্থ্য ছিল না। তবে আমাদের ছিলেন ক্রিকেট–অন্তঃপ্রাণ কিছু সংগঠক, যাঁরা নিঃস্বার্থভাবে ক্রিকেটের জন্য কাজ করে গেছেন। একটা সময়ে শুনলাম, মালয়েশিয়ার আইসিসি ট্রফিতে খেলা হবে এস্টোটার্ফে। আমরা তো ভয়ই পেয়ে গেলাম! এস্টোটার্ফে আমরা জীবনে খেলিনি। ক্রিকেট বোর্ডেরও অত টাকা ছিল না যে এস্টোটার্ফ কিনবে। তারপরও সবার সহযোগিতায় এস্টোটার্ফের ব্যবস্থা হয়ে যায় এবং সেটাতে অনুশীলন করেই আমরা আইসিসি ট্রফি খেলতে যাই।

অধিনায়ক হিসেবে আমার বড় সুবিধা ছিল, দলের সিনিয়র-জুনিয়র সব ক্রিকেটারই আমাকে পছন্দ করত। আমাদের লক্ষ্যই ছিল দল হিসেবে খেলা। কারও ওপর ভরসা করে বসে থাকতাম না আমরা। নির্দিষ্ট একজনের ওপর নির্ভরতা থাকলে সে যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে একটা ধস নামে। সবাইকে প্রস্তুত রাখতে যারা পরে ব্যাটিং করত অনুশীলনে, আমি তাদেরও ব্যাটিং করার সুযোগ দিতাম।

১৯৯৭-এর আইসিসি টুর্নামেন্টে গিয়ে ছোট দলগুলোর সঙ্গে আমরা ভালোভাবেই জিতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে ম্যাচটা বৃষ্টির কারণে টাই হয়ে যায়। পরের ম্যাচটাই ছিল হল্যান্ডের সঙ্গে। ওই ম্যাচে হারতে হারতেই জিতে গিয়েছিলাম আমরা। এরপর আমাদের আত্মবিশ্বাস ভীষণ বেড়ে গেল এবং সেটাই ট্রফি জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে দিল বাংলাদেশকে।

ওই সময় বড় দল, ছোট দল কোনো ব্যাপার ছিল না। ব্যাপার ছিল কন্ডিশন। কারণ, আপনি কোন ধরনের উইকেটে খেলছেন, তা তো আগে থেকে জানেন না। প্রতিপক্ষ কেমন, ছোট না বড়, সেটাও ছিল অজানা। তখন কম্পিউটার অ্যানালিস্টও ছিল না যে প্রতিপক্ষের ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে আমাদের দেখাবে। আমরা খেলতে যেতাম অন্ধের মতো। কে কেমন বল করে, ব্যাট করে—কিচ্ছু জানতাম না। মনে আছে, হল্যান্ডের ৩-৪ জন খুবই ভালো ক্রিকেট খেলত। ইউরোপের দলগুলোর সুবিধা ছিল, ওরা ইংল্যান্ডে গিয়ে কাউন্টি বা অন্যান্য টুর্নামেন্ট খেলতে পারত, যেটা অন্য দলের খেলোয়াড়েরা পারত না। আবার অনেক দলে ভারত, পাকিস্তানের খেলোয়াড় খেলত। তাদের শক্তি আমাদের চেয়ে বেশি ছিল।

১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফিসহ আমি মোট তিনটি আইসিসি টুর্নামেন্ট খেলেছি। কিন্তু ১৯৯৭–এর আগে আমরা ঠিক দল হিসেবে খেলিনি। ১১ জন মিলে যে ম্যাচ জেতা যায়, এটা আমরা ভাবতামই না। অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর আমি এই জিনিসটা নিয়েই কাজ করি। দলের ১৫ নম্বর খেলোয়াড়কে আমি যেভাবে মূল্যায়ন করতাম, নান্নু ভাই (মিনহাজুল আবেদীন) তখন বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন; তাঁকেও আমি একইভাবে মূল্যায়ন করতাম। দলটাকে একটা পরিবারের মতো গড়ে তুলেছিলাম। আমার মনে হতো, যে দেশে ক্রিকেট এত জনপ্রিয়, সেই দেশ কেন বিশ্বকাপ খেলবে না! স্বাধীনতার এত বছর পরও কেন আমরা পিছিয়ে থাকব!

বাংলাদেশ দল এখন অন্যদের হারানোর জন্য খেলে। তারা চেষ্টা করছে বিশ্ব ক্রিকেটে কীভাবে আধিপত্য বিস্তার করা যায়। কিন্তু আমাদের সময়ে চেষ্টা ছিল কীভাবে এই পর্যায় পর্যন্ত আসা যায়। আমাদের ক্রিকেটের এই উত্থানে সবচেয়ে বেশি অবদান দর্শকদের। এখন তো দর্শকেরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দেখতে মাঠে আসেন। কিন্তু তখন ক্লাব ক্রিকেট দেখতে যত মানুষ গ্যালারিতে আসতেন, তত দর্শক অনেক আন্তর্জাতিক ম্যাচেও হতো না।

সংবাদমাধ্যমের অবদানের কথা না বললেই নয়। আমি তো বলব আমাদের ক্রিকেট খুব ভালো মানে পৌঁছানোর আগেই তাঁরা আমাদের সমর্থন দিতে শুরু করেন এবং ভালোভাবে তুলে ধরতে থাকেন। এটা অবশ্য দেশের একজন সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমী থেকে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত একই রকম ছিল। আইসিসি ট্রফি জয়ের পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে আমাদের যে বিশাল সংবর্ধনা দিয়েছিলেন, সেটা আমরা ক্রিকেটাররা কোনো দিনই ভুলব না। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সেদিন জেনেছিল, বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলেও বড় কিছু হওয়া যায়। বড় কিছু অর্জন করা যায়।

আকরাম খান, জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমানে বিসিবি পরিচালক