
আরেকটি বিশ্বকাপ দুয়ারে। ২০১০ বিশ্বকাপে পল-এর ‘কীর্তি’ ফুটবলপ্রেমীদের এত শিগগির ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ফুটবল মাঠ থেকে সি লাইফ সেন্টারের দূরত্ব যা-ই হোক না কেন, ভিন্ন জগতের এই বাসিন্দার কথা ফুটবল ইতিহাসে অমর হয়েই থাকবে। ফাইনালসহ আটটি ম্যাচের ঠিক ঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল পল। এর মধ্যে ছিল স্পেনের প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জয়ের ভবিষ্যদ্বাণীও।
পলে এতটাই মজেছিলেন স্পেনের বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, দেশে ফেরার পর বিশ্বকাপ জয়ের উত্সব অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে হাতে ধরে রেখেছিলেন পলের একটা পুতুল!
পলের ‘অতিমানবীয়’ (নাকি অতি-অক্টোপাসীয়?) কোনো ক্ষমতা ছিল কি না, কে জানে। তবে তা নাড়া দিয়ে গিয়েছিল সারা বিশ্বের তথাকথিত আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্কসহ সব মানুষকেই। তবে সুসংস্কার বা কুসংস্কার যা-ই বলি না কেন, অক্টোপাস পলের মতো এতটা সর্বজনীন না হলেও ব্যক্তিগত বা দলগত পর্যায়ের ফুটবলে এই বিশ্বাস অতীতেও ছিল, বর্তমানেও আছে, হয়তো থাকবে ভবিষ্যতেও।
আসুন ফুটবলারদের এমনই কিছু কুসংস্কার সম্পর্কে জেনে নিই।
গ্যারি লিনেকার
কিংবদন্তি ইংলিশ স্ট্রাইকার গ্যারি লিনেকার দীর্ঘদিন ছিলেন স্প্যানিশ লিগে হ্যটট্রিক করা একমাত্র ইংলিশ খেলোয়াড়। ১৬ বছর এবং প্রায় ৬০০ ম্যাচের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে লাল কার্ড তো দূরের কথা, কখনো হলুদ কার্ড বা রেফারির সতর্কবার্তাও শুনতে হয়নি। সেই লিনেকার কিন্তু ছিলেন ভীষণ কুসংস্কারাচ্ছন্ন। লিনেকার ওয়ার্ম-আপ বা অন্য কোনো অগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে কখনোই গোলে শট নিতেন না। লিনেকারের অন্ধবিশ্বাস ছিল, তাঁর ভাগ্যে বরাদ্দকৃত মোট গোলের সংখ্যা সীমিত। যদি তিনি গা-গরমের ম্যাচেই তার সেই সীমিত বরাদ্দ থেকে গোল করে ফেলেন, তাহলে টান পড়ে যাবে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের গোল সংখ্যায়!
পেলে
ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলে একবার তাঁর জার্সি এক ভক্তকে উপহার দিয়ে দেন। দুর্ভাগ্যক্রমে এর পরপরই পেলে ফর্মহীনতায় ভুগতে থাকেন। পেলে তখন এক বন্ধুকে দায়িত্ব দেন, যেখান থেকে পারা যায় সেই ভক্তকে খুঁজে বের করে জার্সি ফিরিয়ে আনতে হবে। সপ্তাহ খানেকের চেষ্টার পর বন্ধুটি পেলেকে সেই জার্সিটি ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হন। পেলেও ফিরে পান হারানো ছন্দ! পেলে ধরেই নিয়েছিলেন, সেই জার্সির সঙ্গে সঙ্গে চলে গিয়েছিল তাঁর গোল করার সৌভাগ্যও!
মজার ব্যাপার হলো, বন্ধুটি আসলে সেই ভক্তকে খুঁজে বের করতে পারেননি। যখন বুঝেছিলেন, এটা পেলের জন্য মানসিক একটা বাধা হয়ে উঠেছে, বুদ্ধি করে একই রকম দেখতে আরেকটি শার্ট পেলেকে ফেরত দেন। ভাগ্যিস বন্ধুটি সেদিন মিথ্যে বলেছিলেন কালো মানিকের কাছে। নইলে ফুটবলের ইতিহাসই হয়তো হতো অন্যরকম।
ববি মুর
আরেক ইংলিশ কিংবদন্তি ববি মুরের আবার ছিল অন্য বাতিক। মাঠে নামার আগে ড্রেসিং রুমে সবার পরে শর্টস পরতেন তিনি। তাঁর বিশ্বাস ছিল, এটা তাঁর মাঠের খেলায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। টিমমেট মার্টিন পিটারস অবশ্য বাগে পেলে ছাড়তেন না মুরকে। যখনই মুর সবার শেষে তার শর্টসটা পরে নিতেন, পিটার তখন খুলে ফেলতেন তার নিজেরটা। যাতে করে মুর সর্বশেষ হতে না পারেন। বলা বাহুল্য, মুরও ‘লাস্ট’ হওয়ার জন্য বাধ্য হতেন নিজের শর্টস আবার খুলতে।
জন টেরি
সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়ক এবং চেলসি সেন্টার-ব্যাক জন টেরি মাঠের সৌভাগ্যের প্রত্যাশায় সব সময় টিম বাসের একই সিটে বসেন, প্যাডের চারিদিকে তিনবার করে টেপ আঁটেন, অনুশীলনে যাওয়ার সময় গাড়িতে একই গান শুনে থাকেন এবং গাড়িটি পার্কিংয়ের একই জায়গাতেই পার্ক করে থাকেন। এমনকি বার্সেলোনার সঙ্গে চ্যাম্পিয়নস লিগের একটি ফিরতি ম্যাচে হারিয়ে ফেলার আগ পর্যন্ত একই শিন প্যাড ১০ বছর ধরে ব্যবহার করেছেন! এই ২৯ বছর বয়সী বর্তমানে তার চেলসি সতীর্থ ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের কাছ থেকে ধার করা এক জোড়া ‘লাকি’ প্যাড ব্যবহার করছেন।
সার্জিও গয়কোচিয়া
গোলকিপাররা একটু খ্যাপাটে হয়েই থাকেন। যেমন আইরিশ আন্তর্জাতিক গোলরক্ষক শে গিভেন খেলা চলাকালীন এক শিশি ‘পবিত্র পানি’ গোল পোস্টের পাশে রেখে দিতেন। তার পূর্বসূরি প্যাকি বোনারও জন্মস্থানের এক মুঠো মাটি রেখে দিতেন তাঁর গ্লাভস ব্যাগে। তবে খ্যাপামোর চূড়ান্ত করেছেন বিখ্যাত আর্জেন্টাইন গোলকিপার সার্জিও গয়কোচিয়া। সার্জিও পেনাল্টি শট ঠেকানোর জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। আর এ পেনাল্টি ঠেকাতে গিয়েই তিনি জন্ম দেন ফুটবলের বিখ্যাত এবং অদ্ভুত কুসংস্কারগুলোর একটির।
প্রতিটি পেনাল্টি শুটআউটের পূর্বেই গয়কোচিয়া মাঠে মূত্র ত্যাগ করতেন! এবং ঠিকঠাক ঠেকিয়ে দিতেন পেনাল্টি। তবে তাঁর বক্তব্য, ‘আপনারা জানেন খেলাটির নিয়ম অনুসারে ম্যাচ শেষ হবার আগে আপনি মাঠ ত্যাগ করতে পারেন না। এবং আপনার যদি কোনো ‘জরুরি শারীরিক তাড়া’ থাকে, তবে আপনাকে মাঠের পাশেই কাজ সারতে হবে। ঠিক এই ঘটনাটিই ঘটেছিল যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে (১৯৯০ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে)। খেলার শেষদিকে আমার সত্যিই প্রচণ্ড চাপ দেখা দিয়েছিল। মাঠের পাশেই এটা করা ছাড়া কোনো গতিও ছিল না। এবং আমরা জিতে গেলাম। তাই সেমিতে ইতালির বিপক্ষে ম্যাচটিও যখন পেনাল্টিতে গেল আমি আবারও একই কাজ করলাম—এবং এটা আবারও কাজে দিল! এর পর থেকে আমি প্রতি শুটআউটেই এটা করতাম। এটা ছিল আমার সাফল্যের মূলমন্ত্র!’
রোমিও আনকন্তানি
বিপদে লবণ ছিটানো বেশ পুরোনো কুসংস্কার। তাই বলে ফুটবল মাঠে? তা-ও আবার ২৬ কেজি? ঠিক এ কাজটিই করেছিলেন সাবেক পিসা প্রেসিডেন্ট রোমিও আনকন্তানি। প্রতিটি ম্যাচের আগে রোমিও নিজ মাঠ অ্যারেনা গ্যারিবল্ডিতে ইচ্ছেমতো লবণ ছিটাতেন। এতে নাকি সব বাধা দূর হয়ে ম্যাচ জয়ের পথ সুগম হতো! যত গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ, তত বেশি লবণ। তো একবার নগর প্রতিদ্বন্দ্বী সেসেনার সঙ্গে মহা গুরুত্বপূর্ণ এক ম্যাচের আগে আনকন্তানি ২৬ কেজি পর্যন্ত লবণ ছিটানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত মাঠের অবস্থা যেন ফুটবল খেলার চেয়ে স্কি খেলার জন্যেই বেশি উপযোগী হয়েছিল!
মিডল্যান্ড পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট
নিজের বা দলের ভাগ্যের শিকে ছিঁড়তে অনেকেই অনেক কিছুই করে থাকেন। জিম্বাবুয়ের ক্লাব মিডল্যান্ড পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট দলের ম্যানেজমেন্টও মঙ্গলই চেয়েছিল নিশ্চয়ই। দলের মাঝে লুকিয়ে থাকা ‘অশুভ আত্মা’ ধুয়ে ফেলার জন্য পুরো স্কোয়াডকে তারা নামিয়ে দেয় ভিক্টরিয়া জলপ্রপাতের কাছে জাম্বেজি নদীতে। ক্লাব কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করেই এমনটি করেছিল, নাকি ভুলে গিয়েছিল তীব্র স্রোত এবং জলহস্তী আর কুমিরে পরিপূর্ণ এ নদীতে সাঁতারের ওপর নিষেধাজ্ঞার কথা, কে জানে। ফলও পেয়েছিল হাতেনাতেই, ১৬ জন গিয়েছিলেন নদীতে, ফিরেছিলেন ১৫ জন। অশুভ আত্মা দূর করতে গিয়ে তাঁরা হারিয়ে ফেলেছিলেন জলজ্যান্ত এক খেলোয়াড়কেই!
অ্যালান কর্ক
১৯৯২-৯৩ মৌসুমে শেফিন্ড ইউনাইটেডের স্ট্রাইকার অ্যালান কর্ক করলেন এক কঠিন পণ। শেফিল্ড ইউনাইটেড এফএ কাপ থেকে বাদ না পড়া পর্যন্ত তিনি আর শেভ করবেন না। এমনিতে শেফিল্ড ইউনাইটেডের যে শক্তিমত্তা, তাতে দ্রুতই দলের বিদায়ই ছিল স্বাভাবিক। তবে সে বছর হিসাব পাল্টে গিয়েছিল। শেফিল্ড ওয়েন্সডের সঙ্গে ওয়েম্বলির সেমিফাইনাল ডার্বির ম্যাচে যখন তিনি খেলতে নামেন, তাঁর টেকো মাথার তুলনায় মুখ ঢাকা ছিল একগাল দাড়িগোঁফে!