
এই দর্শকদের সালাম জানাই। তাঁরা একটা টিকিটের জন্য আগের রাত থেকে দাঁড়িয়ে থাকেন ব্যাংকের সামনে। কী নারী, কী পুরুষ। রাত কাটে, দাঁড়িয়ে পা অবশ হয়, সকালের সূর্য মাথার মগজ ফুটিয়ে দিতে চায়, টিকিট মেলে না, মেলে পুলিশের লাঠি। তারপরও তাঁরা হাজির হন সকাল থেকেই, স্টেডিয়ামের আশপাশে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় খেলা, গতকাল রোববার সাড়ে চারটায় স্টেডিয়ামের গেটে গিয়ে দেখি দীর্ঘ লাইন, চারপাশে অগণন মানুষ। পাঁচটায় দুয়ার খুললে ভেতরে প্রবেশ। অনেকের পরনেই বাংলাদেশের জার্সি, হাতে লাল-সবুজ পতাকা, গালেও পথশিল্পীদের এঁকে দেওয়া প্রিয় পতাকার নকশা। কারও হাতে বাঘ, কেউবা এসেছেন বাঘের সাজে। ঢাকঢোল বাজছে, সাজ সাজ রব।
সকাল থেকেই তো ফেসবুকে মজার ছবি এঁকে বোঝানো হচ্ছে, দর্শকদের কত অধীর অপেক্ষা খেলা শুরুর মুহূর্তটির জন্য। অন্য দিন নাকি সময় যায় খরগোশের পায়ে পায়ে, ৬ মার্চে সময় হাঁটছে শামুকের গতিতে। গ্যালারিভরা দর্শকদের অপেক্ষার সুন্দর মুহূর্তগুলো ভেসে গেল ঝড়ের তোড়ে। প্রচণ্ড ধূলিঝড়, তারপর অবিরল বৃষ্টি। যে দর্শকেরা কষ্টার্জিত টিকিট হাতে নিয়ে সূর্যের দিকে মুখ করে রোদে পুড়ছিলেন, তাঁরা এবার ভিজতে লাগলেন বৃষ্টিধারায়। তবু কেউ স্টেডিয়াম ছাড়লেন না। সাড়ে সাতটার খেলা শুরু হলো দুই ঘণ্টা পরে, বৃষ্টি ধরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই গ্যালারি ভরে গেল দর্শকে। এঁদের অনেকেরই পরনের কাপড় ভেজা। টস ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, টসে হারার পরেই আসলে হেরে গেল বাংলাদেশ। কিন্তু দর্শকদের খেলোয়াড়সুলভ আচরণে বিন্দুমাত্র কমতি দেখা গেল না। সৌম্য-তামিম অল্প রানে আউট হয়েও তালি পেলেন, ব্যাপার না, ভালো খেলেছ। হবে হবে, পরের বার। সাকিবও ফিরে আসছেন ক্যাচ দিয়ে, তবু তিনি পাচ্ছেন করতালির অভ্যর্থনা। আর রিয়াদকে তো দেওয়া হলো রীতিমতো বীরের সংবর্ধনা। ১২০! খারাপ পুঁজি কি?
পাশের দর্শক এসে সাহস দিচ্ছেন, জিতে যাব, জিতে যাব। বাংলাদেশ একটা বাজি ধরেছিল, তুরুপের তাস ছিল আবু হায়দার, তিনি বেধড়ক মার খেলেন কপালের দোষে, নইলে বল তিনি খারাপ করেননি। কিন্তু ভারত তো টি-টোয়েন্টি র্যা ঙ্কিংয়ে এক নম্বর দল। খেলল মাথা ঠান্ডা রেখে। তারা যে নিশ্চিত জয়ের দিকেই এগোচ্ছে, গ্যালারির দর্শকেরা তা আগেভাগেই বুঝতে পারছিলেন। তাই বলে কেউ গ্যালারি ছেড়ে উঠে যাচ্ছিলেন না। ক্রিকেট তো অনিশ্চয়তার খেলা। যদি একটা কিছু হয়েই যায়। হলো না। ছক্কার পর ছক্কা মেরে ধোনি জয় নিশ্চিত করলেন। দর্শকেরা তখন দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানালেন বিজয়ীদের। বাংলাদেশ দল করমর্দন সেরে ফিরছে নিজেদের ডেরায়, তখনো দর্শকেরা তালি দিচ্ছেন—ভালো খেলেছ, ওয়েল প্লেড, বয়েজ।
আসল তালি তাই এই দর্শকদেরই প্রাপ্য। গত এশিয়া কাপের ফাইনাল শেষে সাকিব-মুশফিকের চোখে ছিল অশ্রু, তা কাঁদিয়েছিল সমস্ত দেশকে। এ বছর ম্যাচে উত্তেজনা হয়নি, ছোট দৈর্ঘ্যের ম্যাচে পরে বল করে প্রতিরোধ গড়া যে মুশকিল, দর্শকেরা তা বুঝেছেন। তাঁদের প্রিয়তম দলটি যে পাকিস্তান আর শ্রীলঙ্কার মতো দলকে আগেভাগেই বিমানে তুলে দিতে পেরেছে, সে অর্জনটাকেই তাঁরা উদ্যাপন করলেন।
আশা ছিল, এবার বোধ হয় অধরা এশিয়া কাপ হাতে উঠবে মাশরাফির। ওঠেনি। কিন্তু খেলোয়াড়ি মনোভাবের অপরূপ নিদর্শন দেখিয়ে বাংলাদেশের দর্শকেরা চ্যাম্পিয়নের শিরোপা অর্জন করে নিয়েছেন নিজেরাই। দর্শক হিসেবে, স্বাগতিক হিসেবে বাংলার দর্শকেরাই চ্যাম্পিয়ন।
এত সুন্দর দর্শক আছে যে দেশে, সে দেশের ক্রিকেট অনেক দূর এগিয়ে যাবেই। আজই বিশ্বকাপ খেলতে বিমানে উঠবে মাশরাফি বাহিনী, ১৬ কোটি মানুষের শুভেচ্ছা সঙ্গী হবে তাঁদের। এই দর্শককে তাই অভিবাদন জানাতেই হবে, বারবার। শাবাশ, বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রিয় মানুষেরা! হেরে গিয়ে তাঁদের মন খারাপ, কিন্তু মানসিকতা? অপূর্ব!