>সময়ের হিসাবে কমবেশি দুই বছর। তিন ক্রিকেটারকে ফৌজদারি মামলায় যেতে হয়েছে কারাগারে। এলেবেলে নন, তিনজনই বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটার—রুবেল হোসেন, শাহাদাত হোসেন এবং আরাফাত সানি

জেলখানার অন্ধকার কুঠুরিতে যে একচিলতে আলো আসছে, সেদিকে তাকিয়ে আরাফাত সানি ভাবছেন কী থেকে কী হয়ে গেল! ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর, এ রকমই গরাদের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলেছিলেন শাহাদাত হোসেন। এরও মাস কয়েক আগে রুবেল হোসেনের নীরব অশ্রুর সাক্ষী ছিল কারাগার।
সময়ের হিসাবে কমবেশি দুই বছর। তিনজন ক্রিকেটারকে ফৌজদারি মামলায় যেতে হয়েছে কারাগারে। এলেবেলে ক্রিকেটার নন। ক্রিকেটটা এঁরা ভালোই খেলেন। তাই ঘরোয়া ক্রিকেটে শীর্ষে পৌঁছে দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। সেখানেও সামর্থ্যের শীর্ষবিন্দু ছুঁয়ে কোটি মানুষকে কখনো কখনো বিলিয়েছেন জয়ের আনন্দ। বাংলাদেশের আপামর ক্রিকেট জনতার কাছে এঁরা ছিলেন নায়ক। পাদপ্রদীপের আলোর নিচে ছিল বিচরণ। সেই তাঁরাই হঠাৎ কালো দাগ মাখিয়ে নিলেন নিজেদের শুভ্র পোশাকে। সেই কালো মানুষের ভালোবাসার শক্তিশালী ডিটারজেন্টও পুরোপুরি মুছতে পারে না।
আলোচিত তিন ক্রিকেটারের দুজনের অপরাধ প্রায় একই গোত্রীয়। ফাস্ট বোলার রুবেলের বিরুদ্ধে প্রেমের ফাঁদে ফেলে প্রতারণার অভিযোগ এনেছিলেন তাঁর কথিত এক বান্ধবী। বৈধ স্ত্রী দাবি করে বাঁহাতি স্পিনার আরাফাত সানিকে কাঠগড়ায় তুলেছেন এক তরুণী। অভিযোগ, প্রতারণা ও যৌন হয়রানি। তথ্যপ্রযুক্তি আইনে অভিযুক্ত সানি এখন কারাগারে। নাবালিকা গৃহকর্মীকে নির্মম শারীরিক অত্যাচার করার অভিযোগে সস্ত্রীক কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছে আরেক ফাস্ট বোলার শাহাদাতকে।
এই তিন ক্রিকেটারের নামে স্টেডিয়ামে উঠত জয়ধ্বনি। সংবাদমাধ্যম এঁদের পৌঁছে দিয়েছিল বাঙালির ড্রয়িংরুমে। কিন্তু তাঁরা যখন গরাদের অন্তরালে, এঁদের মুক্তি চেয়ে স্লোগান ওঠেনি। সমবেদনায় ভেজেনি ভক্তের হৃদয়। প্রায় সবাই চেয়েছেন ন্যায্য বিচার। নীতি আর নৈতিকতাই বড়। আইনই সেখানে জাজ্বল্যমান সত্য। ব্যক্তির পদস্খলন কেউ মানতে চায় না। সেখানে নায়ক মুহূর্তেই খলনায়ক হয়ে যায়। সেখানে ব্যক্তি বড্ড একা ও নির্বান্ধব।
এই নির্মম বাস্তব প্রথমে রুবেল বুঝেছেন। পরে বুঝেছেন শাহাদাত। এখন উপলব্ধি করছেন সানি। কিন্তু কেন হঠাৎ করেই আলোর বৃত্ত ছেড়ে তাঁদের এক টুকরো অন্ধকারে ডুব দেওয়া?
বাংলাদেশে ক্রিকেট তো আর শুধু একটি খেলার সীমানায় আটকে নেই। এটি এখন জাতীয় সংস্কৃতির বাহন। ক্রিকেটে সারা দেশ হাসে, কাঁদে গোটা জাতি। এ দেশের আত্মপরিচয়েরই অংশ হয়ে উঠেছে ক্রিকেট। সেই ক্রিকেটের যাঁরা শীর্ষ খেলোয়াড়, তাঁরা সহজেই মানুষের অন্তরে পৌঁছে যান। তাঁদের ঘিরে ধরে অসংখ্য-অজস্র ভক্ত। তরুণ ক্রিকেটারের জন্য হৃদয়ের অর্ঘ্য সাজিয়ে নিভৃতে এসে দাঁড়ায় কত তরুণী। ক্রিকেটারের হাতে থাকে অজস্র টাকা, একটু বেহিসাবি কারও কারও কাছে তা মনে হতে পারে খোলামকুচি। সব মিলিয়ে দুটি তরুণ হৃদয়ের অভিসার হতে বাধা কোথায়?
কিন্তু কে বলতে পারে অভিসারের পথে লুকিয়ে নেই চোরাবালি! কে নিশ্চিত করতে পারে, পথ ভরে নেই অগণন চোরকাঁটা! একটু পদস্খলন হলে, একটু দৃষ্টিবিভ্রম হলেই যেখানে গায়ে মেখে যায় কলঙ্কের কালি। নায়ক থেকে খলনায়ক বনে যাওয়ার রাস্তাটা একেবারেই তাকিয়ে থাকে মুখোমুখি। ক্যারিয়ারের এই আলোকিত রাস্তায় পা ফেলে রুবেল-সানি কি ওই লুকিয়ে থাকা চোরাবালি কিংবা চোরকাঁটাগুলো বুঝতে পারেননি?
অনেকেই বলবেন, খ্যাতি আর স্তুতি মাথা ঘুরিয়ে দেয় অনেক ক্রীড়াতারকার। তাঁদের মস্তিষ্কে তখন খেলা করে এক অলীক দম্ভ। তাঁরা তাই নিজেরা মেপে মেপে পথ চলতে জানেন না। ভুল করে ফেলেন। পারিবারিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি এ ক্ষেত্রে এক রক্ষাকবচ। কিন্তু যাঁদের পারিবারিক আবহে এসবের খামতি আছে, পদস্খলন তাঁদের হতেই পারে।
রুবেল-সানির ক্ষেত্রে কি এমনটাই ঘটল? বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের অন্যতম পরিচালক, মিডিয়া কমিটির প্রধান জালাল ইউনুস এ প্রশ্নে অনির্দিষ্ট উত্তর দেন। তার মানে, এমনটা ঘটতে পারে, আবার না-ও পারে! তবে এ কথা তিনি অস্বীকার করতে পারেননি, পারিবারিক শিক্ষা-সংস্কৃতি একটি বড় বিষয়।
রুবেল-শাহাদাত-সানি কাণ্ডের বেশ কয়েক বছর আগে সফিউদ্দিন নামে বাংলাদেশ দলের সাবেক এক ফাস্ট বোলারের বিরুদ্ধে উঠেছিল তাঁর বান্ধবীর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ। অপরাধের দায় মাথায় নিয়ে ফেরার ছিলেন তিনি দীর্ঘদিন।
সফিউদ্দিনের সেই ঘটনাটা প্রায় ফিকে হয়ে যেতে না-যেতে গত দুই বছরের ব্যবধানে তিন ক্রিকেটার দেখা পেয়ে গেলেন কারাগারের। তাহলে কি ধরে নেব বাংলাদেশের ক্রিকেট যে গতিতে ওপরে উঠছে, সেই গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না ক্রিকেটারদের জীবন? যে জীবনে সুস্থিতি নেই, শুভবুদ্ধি নেই, আছে শুধু এলোমেলো অলীক চিন্তা!
সোয়া শ কোটি মানুষের দেশ ভারতে ক্রিকেট একটা ধর্ম, ক্রিকেটাররা দেবতা। সেখানে রুপালি জগতের লাস্যময়ী-মোহময়ী নায়িকাদের জড়িয়ে ক্রিকেটারদের কত কাহিনিই রূপকথার মতো ভেসে বেড়ায় বাতাসে। কই, এত এত ক্রিকেটারের পদস্খলনের কথা তেমন শোনা যায় না তো! আইপিএলে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের দায়ে এক শ্রীশান্ত ছাড়া শোনা যায়নি ‘হাইপ্রোফাইল’ আর কোনো ক্রিকেটারের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে কারাগারের।
বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা এটা জানেন তো?