
মিসেস সাকিব নিউজিল্যান্ডেই আছেন। মাঠের বাইরে সাকিব আল হাসানের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। তবে ক্রিকেটীয় আড্ডায়-গল্পে তিনি শুধু নীরব শ্রোতা। এই জগৎটাই যেন তাঁর অচেনা।
বেসিন রিজার্ভে কাল ডাবল সেঞ্চুরি করার পর সাকিব দিলেন একটা ‘এক্সক্লুসিভ’ তথ্য। মিসেস সাকিব, মানে উম্মে আহমেদ শিশির একটু একটু ক্রিকেট বুঝতে শুরু করেছেন। এরপর যা বললেন, তাতে বহু পুরোনো মিথটাই আরেকবার সামনে এল। পুরুষের সাফল্যের পেছনে ছায়ার মতো থাকেন একজন নারী।
ডাবল সেঞ্চুরি কাকে উৎসর্গ করবেন—সে প্রশ্ন করা হয়নি সাকিবকে। করলে তিনি বলতে পারতেন তাঁর বাবা-মা বা কন্যার কথা। অথবা কোনো শিক্ষক, কোচ; কিংবা স্ত্রী শিশিরের কথাও বলতে পারতেন। বলতে পারতেন নয়, হয়তো শিশিরের কথাই বলতেন। কারণ তাঁর ২১৭ রান, বাংলাদেশ দলের হয়ে সবচেয়ে লম্বা টেস্ট ইনিংস খেলার পেছনে শিশিরেরও একটু ছোঁয়া ছিল।
ওয়েলিংটন টেস্টের প্রথম দিন ৪ রান করে স্কয়ার লেগে ক্যাচ দিয়ে বেঁচে যান সাকিব। অন্য সময় হলে এ নিয়ে খচখচানি মাঠেই ঝেড়ে ফেলতেন। কিন্তু বউ ক্রিকেট বোঝা শুরু করলে তা কি আর সম্ভব! হোটেল রুমে সাকিব দম্পতির ক্রিকেটীয় আলোচনার বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে সংবাদ সম্মেলনে সাকিব যেটুকু জানিয়েছেন তাতে এটা বোঝা গেছে যে, ২১৭ রানের মহাকাব্য তিনি বেসিন রিজার্ভে লিখলেও এর ভিত ফেদারস্টন স্ট্রিটের রিজেস ওয়েলিংটন হোটেলে গড়া, ‘কাল (আজ) মাঠে আমার ক্যাচ পড়ল। সন্ধ্যায় রুমে গেলাম...বউ ইদানীং ক্রিকেট বোঝা শুরু করেছে। অনেক কথা বলছিল। ওকে আমি কিছু বলিনি, তবে চিন্তা করে দেখলাম বড় খেলোয়াড়েরা এ রকম সুযোগ পেলে বড় রান করে। আমিও ভাবলাম দেখি করা যায় কি না। রাত থেকেই কেমন একটা আত্মবিশ্বাস ছিল ভেতরে।’
বড় কিছু করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে মাঠে নেমে পার করেছেন কঠিন সময়। ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির দাবি মেটাতে হয়েছে। সব হার্ডল পেরিয়েই দেখা মিলেছে সোনালি সাফল্যের। কঠিনকে জয় করার সে আনন্দ সাকিব লুকাতে পারেননি। এক কিউই সাংবাদিকের প্রশ্নে বেরিয়ে এল খুশির আভা, ‘নিউজিল্যান্ডে, বিশেষ করে ওয়েলিংটনে ডাবল সেঞ্চুরি করতে পারা দল এবং আমার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। ভালো খেলাটা দল আর আমার জন্য জরুরি ছিল। আমি খুশি যে সেটা করতে পেরেছি।’
সাকিব আসলে এক দিনে দুটি কীর্তি গড়েছেন। প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন, সেই সুবাদে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানের ইনিংসও এখন তাঁর। যাঁকে পেছনে ফেলে পরেছেন এই গৌরবের মালা, সেই তামিমের কাছ থেকেই পেয়েছেন প্রথম অভিনন্দন। ড্রেসিংরুম থেকে তামিমই প্রথম হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানান বন্ধু-সতীর্থকে। মজার ব্যাপার, তামিমের হাততালির আগ পর্যন্ত সাকিব জানতেনই না, দেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ইনিংস খেলার কীর্তি নতুন করে গড়ে ফেলেছেন, ‘আমি ভাবছিলাম ওর রান ২১৪। ওই সিঙ্গেলটা নেওয়ার পর যখন দেখলাম তামিম হাততালি দিচ্ছে, তখন বুঝলাম এখন এটাই সর্বোচ্চ।’
সাকিবের কথাবার্তায় একটা বিষয় পরিষ্কার, বেসিন রিজার্ভের বাতাসে কাল নেশা ধরানো কিছু ছিল। রেকর্ড গড়ার নেশা। নিজেদের ছাড়িয়ে যাওয়ার নেশা। একটা লক্ষ্য পেরোনো গেছে তো আরেকটা লক্ষ্যের ভূত চেপেছে মাথায়। ৩৫৯ রানের রেকর্ড জুটি সেই ‘নেশা’রই ফল, ‘এত বড় জুটি হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ, কিছুক্ষণ পরপরই শুনেছি এই রেকর্ডটা ভাঙছি, ওই রেকর্ডটা হচ্ছে। এক শ রান, দেড় শ রান, দুই শ রান...শুনতেও ভালো লাগছিল। আমাদের দুজনের মনের মধ্যেই হয়তো ছিল জুটিটা আরেকটু বড় হোক, আরেকটু বড় হোক...।’
আর সেই ঘোরে ডাবল সেঞ্চুরির উদ্যাপনটাও ঠিকমতো করা হয়নি। শুধু একটু ব্যাট তোলা, মাঝ উইকেটে মুশফিকের সঙ্গে আলিঙ্গন—এই তো! উইকেটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হেলমেট ঠিক করে ধীর পায়ে ফিরে যান ক্রিজে। তাৎক্ষণিক অনুভূতিটাও নাকি তেমন কিছু ছিল না, ‘মনে হচ্ছিল দুই শ হয়ে গেছে। আর কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না।’ কিন্তু ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির পরও এতটা নির্লিপ্ত কীভাবে থাকেন একজন ব্যাটসম্যান! উত্তর সাকিবেরও জানা নেই, ‘জানি না কেন...হয়তো ভেতর থেকে আসেনি। মনে হয়নি ও রকমভাবে করার দরকার আছে। একটা অর্জন হওয়ার পর মনের ভেতর আরেকটা লক্ষ্য তৈরি হচ্ছিল। সেটার পর আরেকটা। এ জন্যই হয়তো হয়নি।’
‘একটার পর একটা’ করতে করতেই একসময় রানের পাহাড় গড়ে ওঠে বেসিন রিজার্ভে। নিউজিল্যান্ড দলের জন্য তা অদূরের মাউন্ট ভিক্টোরিয়ার চেয়ে কোনো অংশে কম মনে হচ্ছে না নিশ্চয়ই। এর পেছনে শিশির ছিলেন, ছিল নেশা আর দায়িত্ববোধ। সাকিবের ভাষায়, ‘আমরা দেশের হয়ে অনেক টেস্ট খেলেছি। দলের প্রয়োজনের সময় যত বেশি অবদান রাখার চেষ্টা করাটা আমাদের দায়িত্ব।’
মনের ভেতর এমন বোধ এলে কোনো ভীতিই আর থাকে না। সাকিব-মুশফিকও ভুলে গিয়েছিলেন প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড এবং দলটা ক্রিকেট খেলছে নিজেদের মাঠে। শেষ কথাটা ভুলে গিয়ে থাকবেন নিউজিল্যান্ডের বোলাররাও। নইলে এত পরিচিত উইকেটেও কেন বল ফেলার জায়গা খুঁজে পাবেন না! সাকিবের তাই মনে হচ্ছিল, ‘ওরা দীর্ঘ সময় এক জায়গায় বল করতে পারেনি। এত বড় একটা জুটি হলে যত বড় দেশই হোক আর যত বড় দলই হোক, অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।’
কিউই ক্রিকেটারদের স্ত্রীরা কি শুনলেন সাকিবের কথাগুলো?