Thank you for trying Sticky AMP!!

বাংলাদেশে আসতে ভিসা লাগবে—ইমরানকে বলেছিলেন সৈয়দ আশরাফুল

মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসে উজ্জ্বল উপস্থিতি আছে এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনেরও। স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা ফিরে তাকাব সেই দিকে। শুনব খেলার জগতের মানুষের ত্যাগ আর বীরত্বের কথা

ইমরান খানকে কথাটা তিনি সোজাসাপটাই বলে দিয়েছিলেন, ‘অচিরেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে। এরপর তুমি যদি ঢাকায় আসতে চাও, তাহলে অবশ্যই তোমাকে পাসপোর্ট নিয়ে ভিসাসহ আসতে হবে।’ কথাটা বলেছিলেন সৈয়দ আশরাফুল হক।

৫০ বছর আগের কথা। তবে আশরাফুল হকের কাছে যেন এই সেদিনের ঘটনা। ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ঢাকায় এসেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিপক্ষে খেলতে। তিনি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের উদীয়মান ক্রিকেটারদের নিয়ে গড়া একটি দলের প্রতিনিধি। পূর্ব পাকিস্তান যুবদলে খেলেছিলেন আশরাফুল হক। ঢাকা তখন ফুটন্ত কড়াই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বানাতে রাজ্যের টালবাহানা চলছে।

নিজেদের অধিকার আদায়ে বাঙালি জাতি তখন এককাট্টা। খেলোয়াড়েরাও এর বাইরে ছিলেন না। সেই সময়ে একরাতে হোটেলে রাতের খাবার খাওয়ার সময় ইমরানের মুখের ওপর কথাটা বলে দিয়েছিলেন আশরাফুল, ‘কোনো কিছু না ভেবেই বলেছিলাম কথাটা। তখন তো ভেতরে-ভেতরে আমরা বাঙালিরা সবাই টগবগ করে ফুটছি। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু জিতেছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে তাঁর হাতেই ক্ষমতা তুলে দেওয়ার কথা। যেকোনো সভ্য দেশে সেটিই হবে। কিন্তু পাকিস্তানিরা সেটি হতে দিচ্ছিল না। মাঠে ক্রিকেটার হিসেবে খেলছিলাম ঠিকই, মন পড়ে ছিল রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে। বন্ধু-বান্ধবদের আড্ডায় এসব নিয়ে আলাপ হতো। ইমরান খানের সঙ্গেও এ কথা-ও কথার মধ্যে বলে ফেলেছিলাম কথাটা, ‘পূর্ব পাকিস্তান “বাংলাদেশ”হয়ে যাচ্ছে খুব শিগগির। এরপর তুমি যদি ঢাকায় আসতে চাও, তাহলে পাসপোর্টে ভিসা লাগিয়ে আসতে হবে। আমি পাকিস্তানে গেলে আমারও পাসপোর্ট-ভিসা লাগবে।’ ইমরান কথাটা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আরে দূর! তুমি মজা করছ। এ রকম কিছুই হবে না।’

আশরাফুল ইমরানকে মুখের ওপরই বলেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা।

আশরাফুল হক যে ইমরানের সঙ্গে ‘মজা’ করেননি, সেটি প্রমাণ হয়ে যায় দুই মাস পরই। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। সেটি ছিল দুই পাকিস্তান এক রাখার ব্যাপারে সামরিক জান্তা যে আন্তরিক নয়, তার প্রমাণ। এরপর মার্চ মাসজুড়েই চলল আলোচনা ও সমঝোতার নামে সময়ক্ষেপণ। বাঙালিদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার সব আয়োজন। এল ২৫ মার্চের কালরাত। ঢাকায় ঘুমন্ত, নিরীহ মানুষের ওপর বর্বরোচিত হামলা। একটি দেশের সেনাবাহিনী যে নিজ দেশের সাধারণ মানুষের ওপর এমন হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, বিশ্ববাসী সেদিন সেটি দেখেছিল অবাক বিস্ময়ে।

আশরাফুলের সঙ্গে সেই আলাপচারিতা পরে ইমরানকেও তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। ২০১১ সালে প্রকাশিত এই তারকা ক্রিকেটার ও রাজনীতিকের রাজনৈতিক আত্মজীবনী ‘পাকিস্তান: দ্য পার্সোনাল হিস্ট্রি’তে উঠে এসেছে আশরাফুল হকের সঙ্গে ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁর সেই আলাপের প্রসঙ্গটি, ‘আমি চমকে উঠেছিলাম এটা শুনে (বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার কথা আশরাফুলের মুখে শুনে)। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ভাবনা সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। এ জন্য দায়ী ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের গণমাধ্যমের ওপর সামরিক জান্তার অযাচিত নিয়ন্ত্রণ।’

ইমরান তাঁর বইয়ে ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে সেই সফরের কথা উল্লেখ করে তুলে এনেছেন বাঙালিদের ক্ষোভ ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রতি বাঙালিদের ঘৃণার প্রসঙ্গটা, ‘আমরা পূর্ব পাকিস্তান দলের বিপক্ষে খেলছিলাম। সবকিছুই সেদিন শত্রুভাবাপন্ন মনে হচ্ছিল। শত্রুভাবাপন্ন মনে হচ্ছিল ঢাকা স্টেডিয়ামের দর্শক, এমনকি পূর্ব পাকিস্তান দলের খেলোয়াড়দের।’

১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে পূর্ব পাকিস্তান অনূর্ধ্ব–১৯ দল। এই দলটিই খেলছিল ইমরানের পশ্চিম পাকিস্তান অনূর্ধ্ব১৯–এর বিপক্ষে। ছবির সামনের সারিতেডান দিক দিয়ে দ্বিতীয় আশরাফুল। বাম দিক দিয়ে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ক্রিকেটার আবদুল হালিম জুয়েল। তাঁর পাশে রকিবুল হাসান। আশরাফুলের ডান দিকে তানভীর মাজহার তান্না।

স্বাধীনতার তিন বছর পর ইংল্যান্ডে ইমরানের সঙ্গে আবারও দেখা আশরাফুল হকের। তিনি ইমরানকে জানান, পাকিস্তান সেনাবাহিনী কীভাবে লাখ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে, কীভাবে তারা নারীদের ধর্ষণ করেছে, শিশুদেরও রেহাই দেয়নি। কতটা ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সেটিই ইমরানকে বোঝাতে চেয়েছেন আশরাফুল, ‘১৯৭৪ সালে ওর সঙ্গে আমার আবার দেখা হয়। আমি দেখলাম, বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কী ধরনের অপরাধ করেছে, কতটা নৃশংসতার আশ্রয় নিয়েছে, সেসব সে জানে না। আসলে পাকিস্তানিরা এমনই ছিল। চোখে টিনের চশমা পরে থাকা আর কি! নিজ দেশের সেনাবাহিনী আরেকটা অংশে গণহত্যা চালাচ্ছে, তারা সেটার কিছুই জানবে না, এটা হয় নাকি! তখন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম তাদের জন্য নিষিদ্ধ কিছু ছিল না। কিন্তু তারা সেসব খবর বিশ্বাস করত না। ইমরান নিজেও ইংল্যান্ডে অনেকের সঙ্গে এসব নিয়ে তর্ক করত। তবে আমার কথায় সে রীতিমতো ধাক্কা খেয়েছিল।’ আশরাফুল হক ইমরান খানকে বলেছিলেন, ‘তুমি কি জান না, তোমাদের সেনাবাহিনী কী কী অপরাধ করেছে, কতজন নারীকে ধর্ষণ করেছে। ক্রিকেট অঙ্গনের লোকেরাও রেহাই পায়নি। আমি আবদুল হালিম জুয়েলের কথা বলেছিলাম তাঁকে, বলেছিলাম মুশতাক হোসেনের কথা। জুয়েল তো ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে পূর্ব পাকিস্তান অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অন্যতম খেলোয়াড় ছিল। ইমরান তাঁর বিপক্ষে খেলেছিল। জুয়েলকে সে খুব ভালোই জানত।’

বাংলাদেশের ক্রিকেটের উত্থানে আশরাফুলের আছে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা। ছবিটি ২০০০ সালে বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার দিনে তোলা।

সৈয়দ আশরাফুল হক মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাই ঢাকায় ছিলেন। সেই স্মৃতি মনে করে তিনি বলেন, ‘ক্র্যাক প্লাটুনের অনেক গেরিলাই আমার বন্ধুবান্ধব ছিল। ওদের নানাভাবে সাহায্য করেছি। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বড় ছেলে শহীদ রুমি ছিলেন আমার খুব পরিচিত। স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে অনেক সময় একসঙ্গে কাটিয়েছি আমরা। কতবার যে নিজে গাড়ি চালিয়ে ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদের রসদ নানা জায়গায় পৌঁছে দিয়েছি ! একবার তো প্রায় ধরাই পড়ে গিয়েছিলাম। মোহাম্মদপুর থেকে কিছু স্টেনগান আর গ্রেনেড তুলেছি গাড়িতে। ওগুলো ছিল বাজারের চটের ব্যাগে। পথে একটা সেনা চেকপোস্টে গাড়ি দাঁড় করাতে হলো। আমি ভেতরে-ভেতরে শেষ। কিন্তু মাথা ঠান্ডা রেখে সৈনিককে বললাম, “আমি ক্রিকেটার। পূর্ব পাকিস্তান দলে খেলি।”এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ছাড়া পেয়ে গেলাম।’

শহীদ ক্রিকেটার আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েলকে খুব মনে পড়ে আশরাফুলের, ‘জুয়েল খুব প্রতিশ্রুতিশীল ক্রিকেটার ছিল। আর কিছুদিন পাকিস্তান থাকলে সে নিঃসন্দেহে টেস্ট খেলতে পারত। আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল সে। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি বিয়ে করি। জুয়েল ছিল আমার বিয়ের সাক্ষী। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে আমি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়ি। কিন্তু জুয়েল বলেছিল, “নতুন বিয়ে করেছিস। যুদ্ধে যাওয়ার দরকার নেই। তুই ঢাকায় থেকেই মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখতে পারিস।” এই একটা ব্যাপারে জুয়েলের ওপর আমার সামান্য অভিমান আছে। আমি যুদ্ধে যেতে পারলাম না, আর দেখুন সে দেশের জন্য কত বড় ত্যাগ স্বীকার করল!’