বিদায়, ফিল হিউজ

ফিল হিউজের কফিন বয়ে নিলেন ভাই জেসন (বাঁয়ে), বাবা গ্রেগরি (ডানে) এবং দুই সতীর্থ মাইকেল ক্লার্ক ও অ্যারন ফিঞ্চ। কাল অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের ম্যাকসভিলে
ফিল হিউজের কফিন বয়ে নিলেন ভাই জেসন (বাঁয়ে), বাবা গ্রেগরি (ডানে) এবং দুই সতীর্থ মাইকেল ক্লার্ক ও অ্যারন ফিঞ্চ। কাল অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের ম্যাকসভিলে

দক্ষিণ আফ্রিকায় অভিষেক টেস্ট সিরিজটা খেলে ২০০৯ সালের মার্চে যখন ম্যাকসভিলে ফিরেছিলেন ফিল হিউজ, গোটা শহর রাস্তায় নেমে এসেছিল তাঁকে বরণ করতে। যেন সমুদ্র গর্জেছিল তাঁর নামে। সেই হিউজ কাল আরেকবার ফিরলেন তাঁর শহরে। গোটা শহর এবারও রাস্তায়। কিন্তু গর্জন নেই। নিস্তব্ধ, পিনপতন নীরবতা!
বছর পাঁচেক আগের সেই দিনটিতে ছাদখোলা গাড়িতে পুরো শহর ঘুরেছিলেন হিউজ। ‘ফিলি’, ‘হিউজি’ এমন আরও কত নামে ডাকছিলেন তাঁকে সবাই। হাত নেড়ে নেড়ে সবার অভিনন্দনের জবাব দিয়েছিলেন। কাল ‘বিএল-৯৫৪’ নম্বরের বড় গাড়িটি খুব ধীরগতিতে তাঁকে বয়ে নিয়ে গেল। দুপাশের রাস্তায় কত শুভাকাঙ্ক্ষী, কিন্তু তাঁদের ‘হিউজি’ হাত নাড়লেন না। নাড়বেন না আর কোনো দিন। গাড়িতে রাখা কফিনে চিরশয্যায় ফিল হিউজ। এ তাঁর অন্তিমযাত্রা!
বিএল-৯৫৪। শহরবাসীর কেউ কি খেয়াল করলেন—৯ আর ৫৪ যোগ করলে হয় ৬৩। যে রানে জীবনের শেষ ইনিংসে অপরাজিত রয়ে গেছেন হিউজ। ঘটনাচক্র কি?
টেনেটুনে আড়াই হাজার লোকের বসতি নিউ সাউথ ওয়েলসের ম্যাকসভিল শহরে। কিন্তু হিউজের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিলেন শহরের জনসংখ্যার দ্বিগুণ মানুষ। বোঝাই যাচ্ছিল কতটা প্রিয় ছিলেন তিনি সবার। ছোট্ট শহরটা যেন থমকে গিয়েছিল কাল। জেঁকে বসেছিল বিষাদ। আপন শহরে এমনভাবে ফিরবেন ফিলিপ হিউজ, কে ভেবেছিল! কাঁধে কফিন নিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় বাবা গ্রেগরির চোখ থেকে জল ঝরল অঝোরে। পিতার কাঁধে সন্তানের মৃতদেহ। এ কফিনের ভার কত, তাঁর চেয়ে ভালো কে জানে! ভার বইলেন হিউজের ভাই জেসন, বন্ধু ও অস্ট্রেলিয়া দলের দুই সতীর্থ মাইকেল ক্লার্ক আর অ্যারন ফিঞ্চও। অশ্রুসিক্ত, বেদনাক্রান্ত তাঁরাও। ভাই আর বন্ধুর কফিনও যে কম ভারী নয়!
হিউজকে বিদায় জানাতে ম্যাকসভিল হাইস্কুল মিলনায়তনে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়া দলের সবাই। সিডনি ক্রিকেট মাঠে যাঁর বাউন্সারে দুর্ঘটনা, সেই শন অ্যাবট যেন সবচেয়ে বেশি আবেগাক্রান্ত। ছিলেন স্যার রিচার্ড হ্যাডলি, মার্ক টেলর, স্টিভ ওয়াহ, ব্রায়ান লারা, শেন ওয়ার্ন, গ্লেন ম্যাকগ্রা, অ্যাডাম গিলক্রিস্টদের মতো সাবেক ক্রিকেটাররা। হিউজের অকালমৃত্যু পিছিয়ে দিয়েছে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ। সেই ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে শেষকৃত্যে যোগ দিলেন ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক বিরাট কোহলি, কোচ ডানকান ফ্লেচার ও ক্রিকেট পরিচালক রবি শাস্ত্রী।
ম্যাকসভিলের সেন্ট প্যাট্রিক প্রাথমিক বিদ্যালয়, যেখানে ক্রিকেটের হাতেখড়ি হয়েছিল হিউজের, সেই স্কুলের সহকারী অধ্যক্ষ জুলি রায়ান স্মৃতিচারণা করলেন তাঁর ছাত্রকে নিয়ে, ‘সে খুবই মজার ছেলে ছিল। খেলতে ভালোবাসত, বন্ধুদের ভালোবাসত। আমি তাকে নিয়ে গর্বিত।’ ম্যাকসভিলের জুনিয়র ক্রিকেট দল, যে দলের হয়ে একসময় খেলেছেন হিউজ, সেটির ১২ বছর বয়সী খেলোয়াড় লোগান জোনস বলেছে, ‘ফিলি মাঝে মাঝে এসে আমাদের উৎসাহ দিতেন। বয়সে বড় হয়েও তিনি আমাদের বন্ধু ছিলেন। আমরা ওঁর মতো হতে চাই।’
আর মাইকেল ক্লার্ক? বন্ধু হারানোর ধাক্কা এখনো সামলে উঠতে পারেননি অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক। হিউজের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বক্তৃতায় সজল চোখে বললেন, ‘বৃহস্পতিবার রাতে আমি হেঁটে হেঁটে এসসিজির (সিডনি ক্রিকেট মাঠ) ক্রিজে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। পায়ের তলায় সেই একই ঘাসের ডগা—যেখানে হিউজের সঙ্গে আমার, এখানে উপস্থিত আরও অনেকের কত জুটি হয়েছে। সেই সীমানা যেখানে সে কত বল পাঠিয়েছে, সেই স্ট্যান্ড যেখানে দাঁড়িয়ে কত মানুষ তার নামে চিৎকার করেছে। শেষবারের মতো সে সেই ক্রিজেই পড়ে গিয়েছিল। আমি সেখানে দাঁড়িয়েছিলাম অনেকক্ষণ, তারপর হাঁটু গেড়ে বসেছি, হাত দিয়ে ছুঁয়েছি ঘাস। বিশ্বাস করুন, হিউজ আমার সঙ্গেই ছিল। যেন আমাকে তুলে ধরে জিজ্ঞেস করছিল, আমি ঠিক আছি কি না। আমাকে বলছিল, আমাদের জুটিটা আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, অন্তত চা-বিরতি পর্যন্ত যেতে হবে।’
বিদায়ী বক্তৃতার শেষেও সবাইকে সেই অনুরোধই করলেন ক্লার্ক। শোককে শক্তিতে রূপ দিয়ে ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। সিডনি মর্নিং হেরাল্ড, এএফপি।