বাংলাদেশ দলের চিন্তায় ডানহাতি-বাঁহাতি সমন্বয় অনেক প্রভাব রাখে
বাংলাদেশ দলের চিন্তায় ডানহাতি-বাঁহাতি সমন্বয় অনেক প্রভাব রাখে

সুনীল গাভাস্কার হয়ে দেখতে পারেন সাকিব–সৌম্য

বাংলাদেশ জাতীয় দলের এক বাঁহাতি ব্যাটসম্যানকে একজন সিনিয়র সাংবাদিক একবার রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘আপনি বাঁ হাতেই এত ভালো ব্যাট করেন! ডান হাতে খেললে জানি আরও কত ভালো খেলতেন!’

রসিকতাটা তাৎক্ষণিক ধরতে পারেননি ওই ব্যাটসম্যান। কথাটা শুনে চমকে উঠে বলেছিলেন, ‘আসলেই তো!’

বাঁহাতি ক্রিকেটারদের নিয়ে এ রকম মজার ঘটনার অভাব নেই ক্রিকেটে। আছে ইনিংসের মাঝখানে ডানহাতি ব্যাটসম্যানের হঠাৎ করে বাঁহাতি হয়ে যাওয়ার ঘটনাও। না, কেভিন পিটারসেন বা ডেভিড ওয়ার্নারের ‘সুইচ হিট’–এর কথা বলা হচ্ছে না।

ভারতীয় কিংবদন্তি সুনীল গাভাস্কার একবার বাঁহাতি বনে গিয়েছিলেন

ক্রিকেটে এমনও ঘটনা আছে, একজন ডানহাতি ব্যাটসম্যান তাঁর ইনিংসের শুরুতেই স্ট্যান্স নিয়েছেন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান হয়ে। বাঁহাতি হয়েই খেলেছেন পুরো ইনিংস।
বেঙ্গালোরে (বর্তমান বেঙ্গালুরু) ১৯৮২ সালের রঞ্জি ট্রফির সেমিফাইনাল। বম্বের (এখনকার মুম্বাই) সঙ্গে চার দিনের ম্যাচ খেলছে কলকাতা।

ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে বম্বের ব্যাটসম্যান সুনীল গাভাস্কার ডানহাতি থেকে হয়ে গেলেন পুরোদস্তুর বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। গাভাস্কারের মনে হয়েছিল কর্ণাটকের বাঁহাতি স্পিনার রঘুরাম ভাট ও বিজয়কৃষ্ণকে ঠেকাতে সেটাই সবচেয়ে কার্যকর কৌশল হবে। প্রথম ইনিংসে ১২৩ রানে ৮ উইকেট তুলে নিয়ে রঘুরাম ভাটই যে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন বম্বের ইনিংসটাকে, যেটা শেষ পর্যন্ত থেমেছে ২৭১ রানে। অন্য দুটি উইকেট নিয়েছিলেন বিজয়কৃষ্ণ।

১৯৯ রানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করতে নেমে আবারও বিপদে পড়ে বম্বে এবং এবারও তাণ্ডবটা চালাতে লাগলেন সেই ভাট আর বিজয়কৃষ্ণই। দিলীপ ভেঙ্গসরকার, সন্দ্বীপ পাতিল, রবি শাস্ত্রীরাও পারেননি বিপর্যয়ে বাঁধ দিতে। ১৬০ রানে পড়ে যায় বম্বের ৬ উইকেট। ভাটের দখলেই ৪টি, বাকি ২টি উইকেট নেন বিজয়কৃষ্ণ। ভাট পরে নেন আরও ১ উইকেট।

সৌম্য সরকার

জয়ের কথা ভুলে বম্বে তখন ম্যাচ বাঁচাতে পারলেই বাঁচে। গাভাস্কারও সে জন্যই নিলেন বাঁহাতি হয়ে যাওয়ার কৌশল। তিনি ভাবলেন, দলে তো সুরু নায়েক ছাড়া আর কোনো বাঁহাতি ব্যাটসম্যান নেই যে ভাট-বিজয়কৃষ্ণের ওভারগুলো পার করে দিতে পারবেন। এই ভেবেই ওই ইনিংসে ওপেনিংয়ে না নেমে গাভাস্কার নামলেন সাত নম্বরে, গার্ড নিলেন বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের মতো। দেখে তো কর্ণাটকের ক্রিকেটাররা হতভম্ব! চোখের সামনে এমন দৃশ্যের অবতারণা বিশ্বাস হচ্ছিল না দর্শকদেরও। ডানহাতি গাভাস্কার বাঁ হাতেও ব্যাট করতে জানেন!

গাভাস্কার কিন্তু সেদিন পেরেছিলেন ভাট আর বিজয়কৃষ্ণের উইকেট–সংহারী টার্ন ভালোভাবে সামলে নিতে। এ দুজন তো ননই, বাঁহাতি গাভাস্কারকে সেদিন আউট করতে পারেননি কর্ণাটকের কোনো বোলারই। অপরাজিত ১৮ রান করে মাঠ ছেড়েছেন তিনি, ম্যাচটাও হয়েছিল ড্র। গাভাস্কার পরে এ নিয়ে বলেছেন, কর্ণাটকের ওই দুই বাঁহাতি স্পিনারের টার্ন সামলাতেই সেদিন তাঁর বাঁহাতে ব্যাট করার কৌশল নেওয়া। তাতে ভাট, বিজয়কৃষ্ণের বলগুলো আসছিল ভেতরে, যেগুলো সামলাতে তেমন কোনো সমস্যাই হয়নি গাভাস্কারের।

লিটন

সুনীল গাভাস্কারের কৌশলের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছিলেন ভাট ও বিজয়কৃষ্ণ। ভাট পরে সে ম্যাচ নিয়ে বলেছেন, ‘আমি আমার সব কৌশলই কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছি। জোরে বল ছুড়েছি, আর্মার দিয়েছি, চায়নাম্যান, ইয়র্কার—সবই দিয়েছি। রাউন্ড দ্য উইকেট বল করেছি, ওভার দ্য উইকেট বল করেছি, ক্রিজ ব্যবহারের চেষ্টা করেছি। কিন্তু গাভাস্কার প্রতিটি বলই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে খেলেছে।’

মজার ব্যাপার হলো ওই ইনিংসের আগে বা পরে আর কখনোই বাঁহাতি স্পিনারদের বিপক্ষে বাঁহাতি ব্যাটসম্যান হওয়ার কৌশল নেননি গাভাস্কার, হয়তো প্রয়োজনই মনে করেননি সেটি করার।

তবে সেই ঘটনার প্রায় ৪০ বছর পর বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট বারবারই হাঁটছে গাভাস্কারের পথে। প্রতিপক্ষের ব্যাটিংয়ে যখন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান থাকবেন, তখন বল দেওয়া যাবে না বাঁহাতি বোলারকে। ওপেনিং জুটিতেও চাই একজন ডানহাতি ও একজন বাঁহাতি। দুজন বাঁহাতি একদমই নয়।

বাঁহাতি ব্যাটসম্যান এলেই আর বোলিংয়ে দেখা যায় না সাকিবকে

শারজায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুপার টুয়েলভে নিজেদের প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কার দুই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান চারিত আসালাঙ্কা ও ভানুকা রাজাপক্ষের ব্যাটিংয়ের সময় ‘লুকিয়ে’ রাখা হলো দলের সেরা বোলার সাকিব আল হাসানকেই। যেন সাকিব কখনো বাঁহাতিদের বিপক্ষে বোলিং করেননি কিংবা করলেও সফল হননি। এই সুযোগে অন্য বোলারদের ওপর চড়াও হয়ে শ্রীলঙ্কার দুই ব্যাটসম্যান ঠিকই সফল হলেন। সঙ্গে লিটন দাসের দুবার ক্যাচ ফেলার সৌজন্যে বাংলাদেশের হাত থেকে ম্যাচটাই ছিনিয়ে নিলেন তাঁরা। আর বাঁহাতি স্পিনার হওয়ায় সাকিব মাঠ ছেড়েছেন তাঁর বোলিংয়ের কোটা পূরণ না করেই।

ডানহাতি-বাঁহাতি সমন্বয় নিয়ে বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্টের ভাবনাটা এতই বেশি যে এর প্রভাব পড়ে ব্যাটিংয়েও। আর টিম ম্যানেজমেন্ট শুধু কেন, দল–নির্বাচনী টেবিল থেকেই তো এই ভাবনা গ্রাস করে রাখে সবাইকে! বাঁহাতি মোহাম্মদ নাঈমের সঙ্গে ওপেনিং জুটিতে একজন ডানহাতিই রাখতে হবে—এই যুক্তিতে লিটন ম্যাচের পর ম্যাচ রান না পাওয়া সত্ত্বেও সৌম্য সরকারকে বসিয়ে রাখা হচ্ছে ডাগআউটে।

নাঈম রান পেলেও অন্য প্রান্তে দ্রুত রান তোলার কাজটা করতে পারছেন না কেউ

গত বছরের মার্চে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অপরাজিত ৬০ রানের পর গত ১২টি ইনিংসে লিটনের ব্যাট থেকে এসেছে সর্বোচ্চ ৩৪ রান। সৌম্যও যে গত জুলাই মাসের জিম্বাবুয়ে সফরের পর খুব ভালো কিছু করেছেন, তা নয়; তামিম ইকবালের অনুপস্থিতিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঘরের মাঠের সিরিজের সব ম্যাচ খেলেও জ্বলে উঠতে পারেননি। নিউজিল্যান্ড সিরিজে এক ম্যাচ খেলে ব্যর্থ, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভালো করতে পারেননি স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে দলে থেকেও।

টি-টোয়েন্টির সঙ্গে নাঈমের ব্যাটিংটা যায় কি না, সে প্রশ্ন রেখেও তিনি যেহেতু রান পাচ্ছেন, ওপেনিং জুটিতে একটা প্রান্ত আগলে রাখছেন এই বাঁহাতিই। তাঁর জায়াটা ঠিক রেখেই বেছে নেওয়া হচ্ছে আরেক ওপেনার, ডানহাতি হওয়ার সুবাদে সেই নির্বাচনে বারবারই এগিয়ে থাকছেন লিটন এবং সেটা বারবার ব্যর্থ হওয়ার পরও! বাংলাদেশের হয়ে দুই বাঁহাতি ইনিংস শুরু করলে সেটা যেন বিরাট এক অন্যায়ই হয়ে যাবে!

এখন বোধ হয় সময় এসেছে এক ডজন ম্যাচে সুযোগ পেয়ে কোনোটিই কাজে লাগাতে না পারা লিটনকে একটু ‘বিশ্রাম’ দেওয়ার। কে জানে, বসে থেকে থেকে সৌম্যের মধ্যেই হয়তো এখন রানের ক্ষুধাটা বেশি জমা হয়েছে।

তাও যদি টিম ম্যানেজমেন্ট তাদের চিন্তা থেকে সরে না আসে, শেষ চেষ্টা হিসেবে সুনীল গাভাস্কারের মতো ‘সব্যসাচী’ হয়ে দেখতে পারেন সাকিব-সৌম্যরা।